৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনটি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দিবস হিসাবে পালিত হয়৷ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ–বজরং দল–আরএসএস সহ বিজেপির ধর্মীয় সংগঠনগুলির তাণ্ডবে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল সৌধটি৷ সৌধের নিচে মন্দির না মসজিদের ভগ্নাবশেষ রয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল তুঙ্গে৷ এই প্রেক্ষিতে ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ–রাম জন্মভূমি নিয়ে মামলার রায় দিয়েছে৷ গত প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে ওই জায়গায় বাবরি মসজিদ যে দাঁডিয়েছিল শীর্ষ আদালত তা মেনে নিয়েছে শুধু তাই নয়, কোর্ট বলেছে সাতাশ বছর আগে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার লোক জড়ো করে বর্বরদের মতো একটা পাঁচশো বছরের প্রাচীন সৌধ ভেঙে দেওয়াটা বেআইনি৷ রিপোর্টের ভিত্তিতে শীর্ষ আদালত বলল, ধ্বংস করে দেওয়া বাবরি মসজিদের নিচে অ–ইসলামিক ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেলেও তা হিন্দু মন্দিরের অবশেষ এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ এই রায়ের কোথাও সুপ্রিম কোর্ট বলেনি যে ওইখানে রামের জন্মস্থান৷ বলেছে এটা হিন্দুদের বিশ্বাস৷ বিশ্বাস আর প্রমাণ এক নয়৷ এর পর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে ভেঙে দেওয়া বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির হবে এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অযোধ্যার অন্যত্র ৫ একর জমি দেওয়া হবে৷
সাংবিধানিক নৈতিকতা ও প্রমাণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে সরিয়ে রেখে বিশ্বাসকেই বড় করে তোলা এই রায় নিয়ে জনমানসে নানা প্রশ্ন উঠছে৷ অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে এই রায়ের পুরাতত্ত্ব সংক্রান্ত দিকটি দেখা যাক৷
অযোধ্যা মামলার এই রায়দানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এর রিপোর্ট৷ খননের মধ্য দিয়ে মাটির বিভিন্ন স্তরে ছোট বড় পুরাকালের যা কিছু অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায় তার মধ্য দিয়ে পুরাতাত্ত্বিক সেই যুগের নানা বিষয় নিয়ে আমাদের একটা ধারণা তৈরি করে দেন৷ তাই ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ডিএনএ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেস্টের মতো পুরাতত্ত্ব আইনি পরিভাষায় কোনও ঘটনার ফ্যাক্ট বলতে যা বোঝায় তা কখনই নয়৷ অযোধ্যায় এএসআই প্রথম খনন কার্য করেছিল ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে৷ সেই সময় এএসআই এর ডিরেক্টর জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহামের নেতৃত্বে এই খননকার্য পরিচালিত হয়েছিল৷ রিপোর্টে কানিংহাম তিনটে স্তূপের কথা উল্লেখ করেছেন৷ যাদের দুটি বৌদ্ধস্তূপের মতো, অন্যটি বৌদ্ধ বিহারের মতো৷ এরপরের খননকার্য ১৯৬৯ সালে৷ বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ তার রিপোর্টে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছিল তা হল প্রাক মধ্যযুগীয় সময়ে ওই অঞ্চলে বসতি ছিল৷ অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জায়গায় তৃতীয় খননকার্যটি হয় ১৯৭৫–৮০ সালের মধ্যে৷ এ এস আইয়ের সেই সময় ডিরেক্টর জেনারেল বি বি লাল খনন করে যে রিপোর্ট জমা দেন (ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি ১৯৭৬–৭৭) তাতে কোথাও স্তম্ভ পাওয়ার কথা নেই৷ অথচ ১৯৯৯–এ এসে সেই তিনি আরএসএস–এর পত্রিকা ‘মন্থনে’ প্রথমবার বললেন যে, ওই বিতর্কিত স্থানে স্তম্ভের মতো কিছু পাওয়া গেছে৷ স্বভাবতই চিন্তাশীল মহলে প্রশ্ন ওঠে উনি যদি খননকার্যের সময় স্তম্ভ আবিষ্কার করে থাকেন তাহলে তা রিপোর্টে উল্লেখ না করে ১৪ বছর বাদে হঠাৎ আর এস এস–এর পত্রিকায় লিখলেন কেন?
এরপর এলাহাবাদ হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে খননকার্য চালানো হয়৷ আদালত প্রথমে জিপিআর করতে বলে৷ জিপিআর হল পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য চালানোর একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি৷ মাটির ভিতরে রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়ে দেখা হয় যে তা কোনও বাধা পাচ্ছে কিনা৷ এরপর তার সূত্র ধরে খনন করে দেখা হয় সেই জায়গায় মাটির ভিতরে কী আছে৷ প্রথমে ১৮৪টি বাধা পাওয়া গেলেও যখন খনন শুরু হল তখন মাত্র ৩৯টি বিষয়কে নির্দিষ্ট করা হল৷ আশ্চর্যের বিষয় এর মধ্যে একটিও স্তম্ভ পাওয়া না গেলেও জি পি আর তার রিপোর্টে স্তম্ভ পাওয়ার কথা উল্লেখ করল৷ এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন এমন উঠল যে ২১ মার্চ ২০০৩ এ এস আই রিপোর্ট দিল, এই জিপিআর রিপোর্ট পরস্পরবিরোধী, এর থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এর উপর নির্ভর করা যাচ্ছে না৷
এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে ডঃ বি আর মনিকে প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে এ এস আই ‘রামলালা বিরাজমান’ এর চৌহদ্দির চারপাশে ১০ ফুট ছেডে খননকার্য শুরু করে এবং ৫৭৪ পাতার একটা রিপোর্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টে দাখিল করে৷ এ এস আই–এর রিপোর্টটি আগাগোড়া পড়লে দেখা যাবে যে সেটি আগাগোড়া ভ্রান্ত এবং অ–নির্ভরযোগ্য৷ শুধু তাই নয়, আদালতের নির্দেশে ওই খননকার্য চালানো হলেও প্রথম থেকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে মাটির নিচে একটি হিন্দু মন্দির আছে এবং সেটি রামলালার৷ কোনও পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে অনুসন্ধানকে আর যাই হোক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বলা যায় না৷ এই রিপোর্টেও একটা মনগড়া ধারণাকে প্রমাণ করার জন্য যা যা করার দরকার করা হয়েছে, যা যা বলার দরকার রিপোর্টে তা বলা হয়েছে৷ যে যে বিষয় এই পূর্বনির্ধারিত ধারণার সঙ্গে মেলে না তাকে রিপোর্টে দেখানো হয়নি৷ যেমন পশুর হাড়, চিত্রিত পাত্র, গ্লেজড টাইলস পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু তা রিপোর্টে উল্লেখ হয়নি৷ ডক্টর মনির নেতৃত্বে এএসআই প্রথম থেকেই পুরাতাত্ত্বিক খনন কার্যের সাধারণ নিয়মনীতির কোনও কিছুই মেনে চলেনি৷ শুধু তাই নয়, খননকার্য কীভাবে চালানো হবে সে সম্বন্ধে এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশও মানা হয়নি৷ খননকার্যের প্রক্রিয়া নিয়ে এমন অভিযোগ আসতে থাকায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাধ্য হয় ডঃ বি আর মনিকে এই খননকারী দলের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন কাউকে নিয়োগের জন্য এ এস আইয়ের ডিরেক্টর জেনারেলকে নির্দেশ দিতে৷ এ এস আই ৯০টি ট্রেঞ্চ খনন করেছিল এবং এর রিপোর্ট কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছিল৷ ২২ মে–৫ জুন ২০০৩ রিপোর্টে লেখা হল ৩ নং ড্রেঞ্চ খনন করে স্তম্ভ পাওয়া গেছে৷ অথচ কী আশ্চর্য দেখুন ৩ নং ট্রেঞ্চটির খননকার্য শুরু হয়েছিল ৮ জুলাই ২০০৩৷ অর্থাৎ ৮ জুলাই ২০০৩ এ খননকার্য করে কী পাওয়া যাবে তা এক মাস আগেই রিপোর্টে এ এস আই উল্লেখ করে দিয়েছে৷ এ যেন রাম না জন্মাতে রামায়ণ লেখার মতো ঘটনা৷ এএসআই এর রিপোর্টে স্তম্ভ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ খনন দেখছিলেন এমন প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেকেই তখন অভিযোগ করেছিলেন এধার ওধার থেকে পাওয়া ইট এক জায়গায় জড়ো করে স্তম্ভের তত্ত্ব খাডা করা হয়েছে৷ সেই স্তম্ভ কোনওভাবেই ভারবাহী স্তম্ভ নয়৷ মজার বিষয় হল ৫৭৪ পাতার এই এ এস আই রিপোর্টের কোথাও বলা হয়নি রাম মন্দিরকে ধবংস করেই বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছে স্ববিরোধিতায় ভরা এই এএসআই রিপোর্ট কোথাও মন্দিরের অস্তিত্বের কোনও উল্লেখ না থাকলেও একদম শেষের অধ্যায়ে রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার পরিচ্ছদে হঠাৎ করে মন্দিরের উল্লেখ করা হয়েছে৷ মজার বিষয় হল এর আগের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে যিনি লিখেছেন তাঁর সই থাকলেও শেষের অধ্যায়টি কে লিখেছেন তা জানা যায় না, কারণ এর শেষে কোনও সই নেই আর এইরকম একটি অধ্যায়কে পুরাতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী সঠিক তথ্য বলেও ধরা হয় না৷ বোঝাই যাচ্ছে যে এটি বিকৃত৷ সুরয ভান, আথার আলী, রামশরণ শর্মা, ডি এন ঝা, রোমিলা থাপারের মতো ইতিহাসবিদরা খননকার্যের সময় অযোধ্যায় গিয়েছিলেন৷ সমস্ত পুরাতাত্ত্বিক ও পাঠ্য নিদর্শন খতিয়ে দেখেছিলেন৷ তাঁরাও এ এস আই–এর এই দাবিকে উডিয়ে দিয়ে বলেছেন মসজিদের নিচে হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব নেই৷ সুপ্রিম কোর্ট বলেছে অ–ইসলামিক নিদর্শন পাওয়া গেছে বলে এএসআই বলছে৷ কিন্তু সেটা কী তা স্পষ্ট নয়৷ বিশেষজ্ঞরা এমনকি নিদর্শনগুলির কালনির্ণয় নিয়েও প্রশ্ণ তুলেছেন৷ ঐতিহাসিক ডি এন ঝা বলেছেন, বিচারবিভাগের উচিত ছিল রায়ের আগে ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত নেওয়া৷ বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্তিকে পিছনে ঠেলে দেওয়া সমাজের পক্ষে অকল্যাণকর৷ ফলে এইরকম একটি রিপোর্টকে ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আইনের সকল বিধি বিধান এবং বিচারব্যবস্থার সকল নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে কার্যত ন্যায়বিচারের প্রহসন ঘটিয়েছে৷