১৪ মে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন নদিয়ার শান্তিপুরের বাবলা সর্দারপাড়া হাইস্কুল বুথে শাসক দলের হয়ে ছাপ্পা ভোট দিতে গিয়েছিলেন এমএ পাশ যুবক সঞ্জিত প্রামাণিক৷ চোখের সামনে ভোট লুট হতে দেখে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় মানুষ৷ গণপ্রহারে মৃত্যু হয় তাঁর৷
সদ্য পুত্রহারা, শোকে মুহ্যমান পিতার অভিযোগ, ‘ছেলে বলত এমএলএ–র সঙ্গে থাকলে নাকি চাকরি দেবে৷ সেই আশাতেই ওদের সঙ্গে থাকত৷ আমরা ওকে অনেক বারণ করেছি৷ এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ করেছিলেন সঞ্জিত৷ অভাবী পরিবার৷ একটা চাকরির প্রয়োজন ছিল তাঁর৷ কিন্তু তীব্র বেকার সমস্যার এই যুগে এমএ পাশ করেও যে এইট পাশের চাকরি জোটে না, তা অন্য অনেকের মতোই সঞ্জিতও বুঝেছিলেন৷ এ রাজ্যে শাসক দলের মন্ত্রী–নেতাদের ভাষণে ‘কৃত্রিম উন্নয়ন’ উপচে পড়লেও শিল্পায়ন নেই, কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই৷ সামান্য যে কটা সরকারি চাকরি হয় তা নিয়ে চলে তীব্র দলবাজি৷ আবার শাসক দলে থাকলেই চাকরি হবে না৷ অতিবিশ্বস্ততা এবং আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হবে৷ দিতে হবে আট–দশ–পনের লক্ষ টাকার সেলামি৷ তাঁত শ্রমিকের সন্তান সঞ্জিতের সে সামর্থ্য কোথায় ফলে তাঁকে আনুগত্য প্রমাণের রাস্তাই নিতে হল৷ নির্দেশ মতো জান কবুল করে তিনি যান ছাপ্পা মারতে৷ তাতেই গণরোষের বলি হয়ে মৃত্যু হয় সঞ্জিতের৷
এ মৃত্যুর দায় কার? শুধু কি সঞ্জিত একাই? তাঁর মতো আরও যে হাজার হাজার যুবক সন্ত্রাস কায়েম করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল – তা কীসের টানে? চাকরি–টাকা–পঞ্চায়েতি সুবিধা–লাইসেন্স পারমিট–প্রমোটারি–তোলাবাজি? না আদর্শ? খোঁজ নিলেই দেখা যাবে আর্থিক পাওনাগণ্ডা– যাকে রাজনৈতিক ভাষায় বলা হয় ঘৃণ্য–সুবিধাবাদ– তার টানেই এই সব বেকারি বিধ্বস্ত যুবকরা সন্ত্রাসী বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল৷ সিপিএমও তার ৩৪ বছরের শাসনে এই সুবিধাবাদ দিয়েই যুবকদের দলে টানত৷ তাদের দিয়ে বুথ দখল করা থেকে ছাপ্পা ভোট– সবই করাতো৷ মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র– এ সব উন্নত আদর্শের কথা কখনও কখনও তোতা পাখির মতো তারা আওড়াতো বটে, কিন্তু এই কথাগুলির তাৎপর্য কী তা জীবনে কী করতে বলে, কী করা থেকে বিরত থাকতে বলে এসব বিষয় নিয়ে কোনও চর্চা এই দলের মধ্যে ছিল না৷ স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে তারা আদর্শগত ভাবে পাল্টাতে পারেনি৷ ফলে ২০১১ সালে নির্বাচনে হারার পরই তাদের লোকেদের তৃণমূলে বা বিজেপিতে যেতে এতটুকু আদর্শগত বাধা কাজ করেনি৷
তৃণমূলও এই সুবিধাবাদের রাজনীতিই করছে৷ আর তা করতে গিয়ে দলের মধ্যে জন্ম দিয়েছে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর৷ বিরোধী রাজনৈতিক দল সহ এই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে নির্বাচনে হারাতে সন্ত্রাস কায়েম করতে তারা নামিয়েছে রাজ্যে হাজার হাজার সঞ্জিতদের৷
সঞ্জিতের মা লালী দেবীর অশ্রুভেজা চোখে ঘৃণার আগুন৷ পুত্র হারানোর শোক বুকে চেপে ধরে বলেছেন, ‘চাকরির লোভ দেখিয়ে ওরা আমার ছেলেকে নষ্ট করেছে’৷ এ আক্ষেপ শুধু সঞ্জিতের মায়ের নয়৷ সব মায়েরই৷ বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে যুবকদের এই গুন্ডামির পথে নামিয়ে শাসকদল তাদের মনুষ্যত্বকে হত্যা করেছে৷ মনুষ্যত্ব থাকলে যে তাকে দিয়ে পশুর কাজ করানো যায় না৷
৯০ শতাংশ আসনে তৃণমূল জয় লুট করেছে৷ এ জয় অগৌরবের৷ লজ্জার৷ লজ্জা গোটা বাংলার৷ বাংলা কি ভারতকে সন্ত্রাসের পথ দেখাবে? নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির চর্চার মধ্য দিয়েই এই দুর্বৃত্তায়ন রুখতে হবে৷
(৭০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা ২৫ মে, ২০১৮)