অবসরের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করতে চায় ফ্রান্সের ম্যাক্রঁ সরকার। রাজকোষে নাকি টাকার ঘাটতি। এ দিকে সাম্রাজ্যবাদী মুনাফার স্বার্থে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি ইউরো খরচ করতে ফরাসি সরকারের কিন্তু আপত্তি নেই! এর বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সে দেশের শ্রমিক-কর্মচারী-খেটে খাওয়া মানুষ।
ফ্রান্সের শ্রমিক সংগঠনগুলির ঐক্যবদ্ধ জোটের ডাকে ৩১ জানুয়ারি জনবিরোধী পেনশন নীতির বিরুদ্ধে পথে নামেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। গোটা দেশের আড়াইশোটিরও বেশি শহরে বিক্ষোভ হয়। প্যারিস, মার্সেইলস, তুলুস সহ দেশের বড় শহরগুলির রাজপথ কেঁপে ওঠে প্রতিবাদী মানুষের দৃপ্ত পদধ্বনিতে। বাদ থাকেনি ছোট ও মাঝারি শহরগুলিও। যেমন ব্রিটনির সমুদ্র তীরবর্তী ছোট একটি শহর দিনান, যেখানে বাসিন্দার সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার, সেখানেও বিক্ষোভ দেখাতে পথে নেমেছিলেন চার হাজার আন্দোলনকারী!
সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন বিশেষ করে সেই সব কর্মীরা যাঁদের সারাটা জীবন কেটে যায় কলে-কারখানায় উৎপাদনের কঠিন কঠোর কাজে। কর্মজীবনের পুরো সময়টা ধরেই তাঁদের অনেককে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, বসার সুযোগ মেলে না। অনেককে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়। অবসর গ্রহণের দিনটির দিকে এঁরাই অনেক বেশি আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকেন। সরকারি এই পেনশন-সংস্কারকে তাঁরা নিজেদের উপর শোষক মালিকদের চাপিয়ে দেওয়া অত্যাচার বলেই মনে করছেন।
অবসরের বয়স বাড়ানো চলবে না– এই দাবিতে এর আগে ১৯ জানুয়ারি প্রথমবার ধর্মঘট করেন ফ্রান্সের শ্রমজীবী মানুষ। সেদিন পথে নেমেছিলেন যতজন শ্রমিক-কর্মচারী, ৩১ জানুয়ারি সেই সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি।
সরকার দাবি মানতে রাজি না হওয়ায় শ্রমিক সংগঠনগুলির ঐক্যবদ্ধ জোটের ডাকে ৭ ফেব্রুয়ারি পেনশন-সংস্কার বিরোধী দেশজোড়া তৃতীয় শ্রমিক বিক্ষোভে পথে নামেন ২০ লক্ষেরও বেশি খেটে-খাওয়া মানুষ। প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। শ্রমিক-কর্মচারীরা এদিন নিজেদের হাতে তৈরি হ্যান্ডবিল বিলি করেছেন। আন্দোলনের তহবিল গড়তে পথচারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। প্রবল মূল্যবৃদ্ধি সহ অর্থনৈতিক সঙ্কটে দেশ যখন জেরবার, তখন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোট ন্যাটোর শরিক হয়ে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল টাকা খরচের সরকারি নীতির প্রবল বিরোধিতা করেছেন বিক্ষোভকারীরা। অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির জন্য দেশে দেশে শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
একই দাবিতে ১১ ফেব্রুয়ারিও দেশ জুড়ে বিক্ষোভ মিছিলের ঢল নামে। বিমান পরিষেবা, বিদ্যুৎ সহ নানা ক্ষেত্রের কাজকর্ম বন্ধ করে দেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিক-কর্মচারীরা। এ দিন দেশের ২৬০টি শহরে ২০ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী ম্যাক্রঁ সরকারের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৬ ফেব্রুয়ারি ২৫ লক্ষ মেহনতি মানুষ পঞ্চমবার দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখান।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলগুলিতে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস নিয়ে হামলা চালিয়েছে ম্যাক্রঁ সরকারের পুলিশ। অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীরাও সেই আক্রমণ থেকে বাদ পড়েনি। গ্রেফতারও হয়েছেন বেশ কিছু বিক্ষোভকারী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী সরকারের জনবিরোধী সংস্কার কর্মসূচির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ফ্রান্সের মেহনতি মানুষ।
এ কথা আজ স্পষ্ট যে, দেশে দেশে শোষিত মানুষ তাদের উপর মালিক শ্রেণির চাপানো শোষণ-বঞ্চনাকে চুপচাপ মেনে নিচ্ছে না, সংগঠিত ভাবে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে। কোথাও কোথাও তা অত্যন্ত শক্তিশালী আকারে ফেটে পড়ছে। কিন্তু একটা কথা আজ ফ্রান্স সহ প্রতিটি দেশের মেহনতি মানুষকে স্পষ্ট বুঝতে হবে যে, আন্দোলন যদি শুধুমাত্র কিছু দাবি আদায়ের লক্ষে্য সংগঠিত হয়ে থাকে তবে তাতে হয়তো দু-একটি দাবি আদায় হতে পারে, কিন্তু আগামী দিনে আরও অসংখ্য সঙ্কটের খাঁড়া তাদের উপর নেমে আসবে। তাই দাবি আদায়ের পাশাপাশি, যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সমস্যার বোঝা মেহনতি মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, সেই সমাজটাকে বদলানোও তাদের অন্যতম কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। না হলে শোষণ, সঙ্কটের বিষচক্র থেকে কোনও দিনই রেহাই মিলবে না।