সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কর্মী ও প্রশিক্ষণ মন্ত্রক এক নির্দেশে জানিয়েছে, অবসরের পরও সরকারি কর্মচারীদের বই কিংবা পত্রপত্রিকায় কোনও লেখা বা মতামত দিতে গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের কর্তাদের অনুমতি নিতে হবে। বলা হয়েছে, নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করেন বা করেছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা চাইলেই লিখতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি অনুমতি দেয়, তবেই তাঁরা লিখতে বা মতামত দিতে পারবেন।
নির্দেশনামা জারি করতে গিয়ে সরকার দেশের নিরাপত্তার কথা বললেও কিছু প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। প্রাক্তন সেনাকর্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানেরা পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’ অনুসারে বাইরে কী কথা বলা যায় না, বর্ষীয়ান অফিসাররা তা এমনিতেই জানেন। এর অন্যথা বিশেষ ঘটেছে বলে শোনাও যায়নি। তা সত্ত্বেও পেনশন আইনে এই বদল আনতে হল কেন?
পেনশন আইনে এই সংশোধনী কি দেশের মানুষের জন্য সত্যিই জরুরি হয়ে পড়েছিল, নাকি কিছুদিন ধরেই সরকারের জনবিরোধী নানা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রাক্তন আমলা মুখ খুলছিলেন বলেই এই সতর্কতা? সেজন্যই কি তাঁদের মুখ বন্ধ করার জন্য সরকারি নির্দেশ চাপিয়ে সরাসরি পেনশন বন্ধ করার হুমকি?
অনেকেরই স্মরণে রয়েছে, গত ২০ মে ১১৬ জন প্রাক্তন আমলা (এঁদের মধ্যে প্রতিরক্ষা দপ্তর ও অন্যান্য দপ্তরের পদাধিকারীরা রয়েছেন) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। তাতে তাঁরা করোনা মোকাবিলা এবং সরকারের অন্যান্য কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দেশের সকল নাগরিককে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনদেওয়া এবং করোনা পরীক্ষার জন্য গ্রাম ও শহরে বাধ্যতামূলক আরটিপিসিআর পরীক্ষার আবেদন জানিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থাকা সত্তে্বও পি এম কেয়ার ফান্ড করার দরকার হল কেন? পিএম কেয়ারের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও জানতে চেয়েছেন। সেন্ট্রাল ভিস্টার পিছনে বিপুল ব্যয় বন্ধ করা এবং রোজগারহীন প্রত্যেক পরিবারকে মাসে ৭ হাজার টাকা দেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে এই চিঠিতে। স্বাভাবিকভাবেই চিঠির প্রশ্নগুলি সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। তার উপর অবসর গ্রহণের পরে সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করে বহু সরকারি কর্তা সংবাদমাধ্যমে যে মতামত দিচ্ছেন, তা বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের কানে আদৌ মধুবর্ষণ করছে না! প্রাক্তন আইএএস হর্ষ মান্দার, জহর সরকার, প্রাক্তন আইপিএস জুলিও রিবোইরো সরকারের নানা অনৈতিক কাজকর্মের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছেন তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাক্তন আইপিএস এবং মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রিবোইরো সহ ৯ জন আমলা দিল্লি গণহত্যা নিয়ে দিল্লি পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রিবেইরো প্রশ্ন তোলেন, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর এবং প্রবেশ ভার্মা যারা ক্রমাগত ধর্মীয় উস্কানিমূলক বার্তা ছড়িয়েছে দিল্লি গণহত্যার সময়, তাদের বিচার হচ্ছে না কেন? শান্তিপূর্ণভাবে সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মুসলিম মহিলাদের ধরে ধরে গারদে পোরা হচ্ছে কেন? এক্ষেত্রে হর্ষ মান্দার ও অপূর্বানন্দের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা দাখিল পুলিশের পরিকল্পিত ছক বলে মন্তব্য করেন তিনি। রিবেইরো দিল্লি পুলিশ প্রধান শ্রীবাস্তবকে চিঠি লিখে এই গণহত্যার তদন্ত জাত-পাত ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং নিরপেক্ষ করার দাবি জানান। নাগরিকত্ব হরণকারী সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘উচিত শিক্ষা দিতে’ বিজেপি সরকার এটা পরিকল্পনামাফিক করেছে এবং গণহত্যায় জড়িতরা শাসক দলের মদতপুষ্ট বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। পাল্টা সরকার ঘনিষ্ঠ আমলারা ‘পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দেওয়া হোক’ এবং দেশের সংহতি নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই বলে সোচ্চার হন। পুলিশের আর এক প্রাক্তন কর্তা দিল্লি গণহত্যার তদন্তকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেন। এই গণহত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগে জেএনইউ-এর ছাত্র উমর খালিদের গ্রেপ্তারি প্রসঙ্গে বিচারপতি এম বি লোকুর বলেন, ‘সমালোচনা বন্ধ করতে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে সরকার।’ (দ্য প্রিন্ট -২০.৯.২০)
২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার সময় কীভাবে তিন হাজার সেনাকে দু’দিন বসিয়ে রেখে শত শত মানুষের হত্যালীলা চালাতে দিয়েছিল মোদি সরকার, তা উঠে এসেছে তৎকালীন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জমিরউদ্দিন শাহের লেখায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি যেদিন সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ শুরু হয়, তৎক্ষণাৎ জমিরউদ্দিন শাহ গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দেখা করে জরুরি হস্তক্ষেপের দাবি জানান। কিন্তু পরিবহণের সমস্যার কারণে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারছে না এই অজুহাত দিয়ে কার্যত গণহত্যা চলতে দেওয়া হয়। ২ মার্চ যখন সেনাবাহিনী পৌঁছয়, তখন যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমেদাবাদ শহরের চারিদিক অগ্নিদগ্ধ, হাজার হাজার মানুষ আহত, মারা গেছেন কয়েকশো মানুষ। সর্বোপরি মাত্র ৪৮ ঘ°টার মধ্যে প্রতিবেশীদের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। শাহ তাঁর লেখা ‘দ্য সরকারি মুসলমান’ বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে বিজেপি বিধায়করা থানায় বসে থেকে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে গণহত্যা কবলিত এলাকায় কারফিউ জারি না করে সংখ্যালঘু মানুষদের উপর পাশবিক আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।
গুজরাটের পুলিশ প্রধান সঞ্জীব ভাটের তৎপরতা ও সাহসী ভূমিকার কারণে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার কথা দেশ জানতে পারে। এর জন্য সঞ্জীব ভাটকে চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে তাঁকে। ড্রাগ পাচার সব নানা অসামাজিক কাজকর্মে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অবৈধ নির্মাণের অজুহাতে তাঁর বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাঁর পরিবারের সদস্যদের উপর প্রবল প্রশাসনিক-সামাজিক-মানসিক চাপ তৈরি করা হয়েছে। এভাবে একের পর এক পুলিশ প্রধান, সেনাবাহিনীর প্রধান, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অফিসারদের বিজেপি নেতা-মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অন্যায় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুখ খোলা, নানা পত্রপত্রিকায় লেখা ও বই প্রকাশে সরকার ভয় পেয়েছে কি?
যুগে যুগে অত্যাচারী শাসকরা যে কোনও রকম বিরোধিতা, বিপক্ষের কণ্ঠরোধ করেছে, চেয়েছে অন্ধ আনুগত্য। অনুগত না হলেই বিরোধী তকমা দিয়েছে। বিন্দুমাত্র সমালোচনারও কণ্ঠরোধ করেছে। সামাজিকভাবে কিংবা প্রশাসন যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে নিষ্পেষণ তীব্র করেছে। বর্তমানের অবক্ষয়িত এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা নিজেকে বাঁচানোর জন্য আশ্রয় করছে সরকারি দমন-যন্ত্রের উপর। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের আমলারা, যাঁরা একসময় সরকারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন, দমন-যন্ত্রের অঙ্গ ছিলেন, আজ তাঁদের উপরও সিডিশনের খড়গ নেমে আসছে। ক্ষমতায় আসীন বিজেপি প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদের দিকেই হাঁটছে। সরকারের এই ঘৃণ্য আচরণের তীব্র প্রতিবাদ দরকার দেশ জুড়ে।