বিশ্ব যখন ফুটবল জ্বরে কাঁপছে, এমনকী যখন একদল রাশিয়ানও ফুটবল বিশ্বকাপের উৎসবে মেতে উঠেছে তখন আলিশা, স্বেতলানারা তাতে গা ভাসাতে পারেনি৷ তাদের বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের ভিতরে নয়, ছিল বাইরে৷ নিজের দেশের জন্য গলা ফাটিয়ে নয়, অন্য দেশের সমর্থকদের আনন্দ–উচ্ছ্বাসে রঙ ছড়িয়ে৷ সেন্ট পিটার্সবার্গের আলিশা, ভলগোগ্রাদের স্বেতলানা, সোরি ইভা বা মস্কোর ডোমিনিকা এঁরা প্রত্যেকেই ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন শুধুমাত্র খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য চষে বেড়িয়েছেন পুরো রাশিয়া৷ স্টেডিয়ামের বাইরে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তুলি চালিয়ে কাউকে এঁকে দিয়েছে ব্রাজিলের পতাকা তো কাউকে ফ্রান্সের, কাউকে সিম্বল তো কাউকে ফুল৷ জ্বলতে থাকা চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও তা মোছার সময় ছিল না তাদের৷ না, এ কোনও কল্পিত ছবি নয়, লেনিন–স্ট্যালিনের দেশে এ ছবিই ফুটে উঠেছিল বিশ্বকাপ ২০১৮ কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকের কলমে৷
রাশিয়ার এই চিত্র আড়াল করতেই অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের মতো পুতিন প্রশাসনও মস্কো সহ দেশের বিভিন্ন শহরের আসল রূপ ঢেকে নকল রূপে সাজিয়ে তুলেছিল৷ বিশ্বকাপ শুরুর বহু আগে ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছিল ‘অপারেশন জাচিস্তিকি’৷ ‘রাস্তার পরিত্যক্ত আশ্রয়হীন রাশিয়ানরা সব গেলেন কোথায়’– এই শিরোনামে মস্কো টাইমসের এক প্রতিবেদনে উঠে এল এক হৃদয়বিদারক চিত্র৷ বড় বড় শহরের রাস্তা থেকে ভিখারি, আশ্রয়হীন, সহায়–সম্বলহীন, ফুটপাতবাসীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শহর থেকে অনেক দূরে৷ রাখা হয়েছে তাঁবুর দমবন্ধ করা পরিবেশে৷ এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন সেই লেখায়– ‘অনেক আশ্রয়হীন বৃদ্ধ–বৃদ্ধাকে ইনসুলিন দিতে হত নিয়মিত৷ অনেক দিন দেখা নেই৷ জানি না তাঁরা বেঁচে আছেন কি না’ আর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জানিয়েছে প্রতিদিন এক মেট্রো স্টেশনে কয়েকশো গরিব মানুষকে তাঁরা খাবার দিতেন৷ বিশ্বকাপ চলাকালীন এগুলি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার৷ তা হলে এঁরা খাবেন কী? তাই হয়তো মেট্রো স্টেশনে, বিশ্বকাপ ফ্যান জোনে বিক্রির জন্য ফুল হাতে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের ছবি আমরা দেখতে পাই৷
বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার নানা সংবাদ পরিবেশনার মাঝে পুঁজিবাদের সমর্থক এডিটোরিয়াল বোর্ডের নজর এড়িয়ে বর্তমান রাশিয়ার যতটুকু ছবি ফুটে উঠেছে তা খুব ভয়ঙ্কর৷ এই কি ছিল লেনিন–স্ট্যালিনের রাশিয়া? জারের আমলের চূড়ান্ত পশ্চাদপদ, শিক্ষাহীন, হতদরিদ্র, কৃষিপ্রধান একটি দেশকে গৃহযুদ্ধ, দুটি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সামলে জ্ঞান–বিজ্ঞান–শিল্প– সহ সমস্ত ক্ষেত্রে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল সমাজতন্ত্র৷ বিশ্বের প্রথম দেশ, যা সবার জন্য খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দিয়েছিল, দারিদ্র নিশ্চিহ্ণ করেছিল৷ এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করতে পারেননি অবিরত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দেওয়া বাংলার এক বিখ্যাত সংবাদ চ্যানেলের সাংবাদিকও৷ তাই তাঁর ভাষ্যে উঠে এসেছে একটি ঘটনা–‘সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলস ক্রেমলিনে লেনিনের সঙ্গে দেখা করেন৷ লেনিন তাঁকে বোঝান যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাশিয়ার আর্থিক উন্নতি ঘটাতে দেশের প্রতিটি কোনায় তিনি বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চান এবং তাঁর স্বপ্ন মাত্র ১০ বছরের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ গুণ বাড়ানো৷ ওয়েলসের কাছে তা এক অবিশ্বাস্য স্বপ্ন৷ তিনি লিখেছিলেন ‘দ্য ড্রিমার ইন দ্য ক্রেমলিন’৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত লেনিনের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়’৷ সেই রাশিয়ার এমন করুণ পরিণতি প্রতিটি মানব কল্যাণকামী মানুষের চোখে জল আনে বইকি!
মস্কো টাইমসের আর একটি প্রতিবেদনকে উল্লেখ করে এক বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক লিখলেন, ‘বিখ্যাত রেড স্কোয়ারে বিভিন্ন দেশের সমর্থকদের হাতে হেনস্থা হতে হচ্ছে স্থানীয় তরুণীদের’৷ সারা বিশ্বের মানুষ যখন মহামিলনের এই আসরে মেতে উঠেছে তথন মস্কোর ভ্যালেন্তিনারা কোথায় যেন একটু আলাদা৷ এঁদের কারও জীবনের লক্ষ ছিল ভাল নার্স হওয়া তো কারওর চিত্রশিল্পী হওয়া৷ কিন্তু তাঁদের জীবনের পথ এসে থেমেছে মস্কো সহ নানা জায়গার ‘পাব’–এ৷ পুঁজিবাদী রাশিয়া তার স্বপ্নকে সফল করা তো দূরের কথা একটা সম্মানের চাকরিও দিতে পারেনি৷ বরং যে পতিতাবৃত্তিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল সমাজতন্ত্র, তাকেই ফিরিয়ে এনেছে পুঁজিবাদ৷ লেনিন–স্ট্যালিনের সোভিয়েত রাশিয়া নারী মুক্তির কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল সমগ্র মানবসমাজের কল্যাণের জন্য৷ আর তাই পশ্চিমী সভ্যতা যা পারেনি তা করে দেখিয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া৷
এমনই এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল সোভিয়েত রাশিয়া৷ যার প্রভাব আজও বিদ্যমান৷ রাস্তায়, মাঠে রাশিয়ানদের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জার্সি পরে রক্তপতাকা নাড়িয়ে উৎসাহিত করতে দেখা গেছে জাতীয় দলকে৷ তাই আজও বর্তমান শাসক পুতিনের পাশাপাশি যাঁদের ছবি সবচেয়ে বেশি মানুষ সংগ্রহ করে তাঁরা হলেন মহান লেনিন ও স্ট্যালিন৷ আর যাঁরা মহান এই দুই নেতাকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন শোধনবাদী সেই সব নেতাদের রাশিয়ার মানুষ স্থান দিয়েছে আঁস্তাকুড়ে৷ এমনকী শুধু দেশে নয়, বিদেশেও মহান লেনিন ও স্ট্যালিনের আবেদন কী প্রবল তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি বিশ্বকাপ চলাকালীন প্রতিদিন হাজার হাজার বিদেশি ক্রীড়ামোদী মানুষ ভিড় জমিয়েছেন লেনিন মুসোলিয়ামে, সামারায় স্ট্যালিনের নির্মিত বাঙ্কার দেখতে৷ যদিও আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম তা সযত্নে এড়িয়ে গেছে৷ উঠে এসেছে মস্কোর মেট্রোর কথা৷ লন্ডন, প্যারিস বা বার্লিনের অনেক পরে তৈরি হলেও ইতিহাসে–দর্শনে–শৈল্পিক সৌন্দর্যে মস্কো মেট্রো শুধু অনেক এগিয়ে তাই নয়, কমিউনিজমের ঐতিহ্য অনুসরণ করে আজও সমগ্র মেট্রো যাত্রাপথে ভাড়া এক৷ কখনও বাড়ে না৷ যা দেখে পুঁজিবাদী ভারতের সাংবাদিকও অবাক৷ এমনও হয় তাঁরা ভাবতেই পারেন না৷ ডাস্টবিন না থাকা সত্ত্বেও কোথাও এতটুকু নোংরা নেই৷ সর্বত্র পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন, শিল্পকর্মগুলি অটুট৷ অথচ প্রতিদিন ১০ হাজার ট্রেনে ৯০ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করেন৷ নাগরিক মানসিকতার এই ফারাক দেখে তিনি ঈর্ষান্বিত৷ এই মানসিকতাকে জানতে ও বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে৷ কমিউনিজমের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই তো সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় শ্রমিক–কৃষকরা দেশ গড়তে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছিলেন৷ এই আদর্শবোধ আজও ফল্গুধারার মতো জাতীয় জীবনে প্রবহমান যা একটি পুঁজিবাদী দেশে অকল্পনীয়৷
শোধনবাদী নেতৃত্বের হাতে পড়ে মহান এই সভ্যতার বিপর্যয় এক চরম দুর্ঘটনা৷ রাশিয়ার জনগণ তার মূল্য দিচ্ছেন৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতির হাত ধরে বেকারি–অনাহার–দারিদ-পতিতাবৃত্তি-স্বাস্থ্যহীনতা সহ নানা ব্যাধি রাশিয়ায় আজ প্রতিষ্ঠিত৷ রাশিয়ায় গিয়ে ‘শৃঙ্খলিত সমাজমুক্তির স্বপ্নের’ যে বাস্তবরূপ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সেখানে দেখেছিলেন সারাজীবন তাতে আবিষ্ট হয়েছিলেন৷ জীবন সায়াহ্ণে রাশিয়ার হাতে ফ্যাসিস্ট জার্মানির পরাজয় দেখে বলেছিলেন, ‘পারবে ওরাই পারবে’৷ সেই আশা আজ আবার মাথা তুলছে বিশ্বজুড়ে৷ সমাজতন্ত্রের এই বিপর্যয় সাময়িক৷ পুঁজিবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী৷ আসুন, মহান নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষায় আমরা নিজেদের গড়ে তুলি৷ সংগ্রামী বামপন্থাকে শক্তিশালী করি৷
(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)