ভিন রাজ্য থেকে আসা সেই রাজ্যের শ্রমিকদের আখ্যায়িত করা হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে৷ পূর্ব প্রস্তুতি ছাডা লক ডাউন ঘোষণার পর এই শ্রমিকরা পডেছেন আতান্তরে৷ দূর দূরান্ত থেকে ঘরে ফেরার সমস্ত রাস্তাই বন্ধ৷ তা সত্বেও হাঁটা পথে, সাইকেলে, মালবাহী লরিতে মালপত্রের মধ্যে, সাধ্যাতীত অর্থ ব্যয় করে গাড়ি বা বাসে, অনেক পরে ট্রেনে, অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্যে এঁদের ঘরমুখী মিছিল প্রত্যক্ষ করেছে সমগ্র বিশ্ববাসী৷ সরকারের অপরিণামদর্শিতা ইতিমধ্যে কেড়ে নিয়েছে বহু শ্রমিকের প্রাণ৷ তাদের জীবন–জীবিকাকে ঠেলে দিয়েছে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের পানে৷
ঘরে এসেও রেহাই নেই৷ ঘর, নিজের এলাকা, নিজের গ্রাম এঁদের আপন করে নিচ্ছে না৷ এ কেবল করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দৈহিক দুরত্ব রক্ষার কারণে নয়, এর পেছনে রয়েছে নানা অজ্ঞতা, অন্ধতা, দীর্ঘ দিন ধরে লালিত নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা–চেতনা৷ তাই দৈহিক দূরত্বের সাথে রচিত হয়েছে সামাজিক দুরত্বও৷ রোগ নিয়ে সতর্কতা অবশ্যই প্রয়োজন৷ কিন্তু তাই বলে রোগীকে একঘরে করা– এ তো মেনে নেওয়া যায় না৷ এ তো পিছিয়ে পড়া চিন্তা–ভাবনার পরিণাম৷
সম্প্রতি এ রাজ্যের ঝাড়গ্রাম জেলার জঙ্গলমহলের দুটি গ্রাম আমাদের কাছে সে শিক্ষাই তুলে ধরল৷ এখানে ভিন রাজ্য থেকে ফিরে আসা নিভৃতবাসে থাকা শ্রমিকদের এলাকার মানুষ যত্ন নিয়েছেন৷ এলাকার মানুষ তাঁদের সুযোগ–সুবিধা–স্বাচ্ছ দিকে খেয়াল রেখেছেন, আপনজন হিসাবে উষ্ণ সম্পর্কের কোনও ঘাটতি রাখেননি৷
ঝাড়গ্রাম ব্লকের মানিকপাড়া পঞ্চায়েতের লোধা–শবর অধ্যুষিত পূর্বশোল খাতায়–কলমে পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম৷ গত নভেম্বরে ঝাড়খণ্ডের ইটভাটায় শ্রমিকের কাজে গিয়েছিলেন গ্রামের শবর ও কুড়মি সম্প্রদায়ের ৮ জন৷ এক শবর দম্পতি তাঁদের সাত বছরের ছেলেকেও নিয়ে গিয়েছিলেন৷ ২২ মে প্রথমে গাডিতে, তার পর দীর্ঘ পথ হেঁটে মানিকপাড়ায় পৌঁছান ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা৷ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষা করিয়ে গ্রামে ফেরেন৷ স্থানীয় ক্লাব, স্ব–সহায়ক দলের সদস্য ও গ্রামবাসীরা মিলে বৈঠক করে স্ব–সহায়ক দলের কর্মশালা ভবনেই ৮ জনের থাকার ব্যবস্থা করে দেন৷ এখন সবাই যে যার ঘরে ফিরে গেছেন৷ স্ব–সহায়ক দলের নেত্রী তমসী মাহাতো জানালেন, ১৪ দিনের নিভৃতবাস শেষে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে মাংস–ভাত–মিষ্টি খাইয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে পরিযায়ীদের৷ শবর দম্পতি মনোরঞ্জন ও রিঙ্কু ভুক্তা বলেছেন, ‘ফেরার আগে ভয় ছিল, গ্রামে ঢুকতে পারব কিনা৷ এমন আতিথেয়তা পাব সত্যি ভাবিনি৷’ (সংবাদ সূত্রঃ পরিযায়ী পর নন, শেখাচ্ছে বাংলার পিছিয়ে পড়া গ্রাম, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭/০৬/২০২০)৷
ওই জেলারই বিনপুরের দহিজুড়িতে আবার নিভৃতবাসে সম্প্রীতির বন্ধন দেখা গেল৷ তামিলনাড়ু ফেরত ৭ পরিযায়ীর মধ্যে ১ জন ছিলেন হিন্দু, বাকিরা সবাই মুসলিম৷ শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের ভবনে একসঙ্গে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন স্থানীয়রাই৷ পরিযায়ী শ্রমিক বিজয় মহন্তের খাবার এসেছিল নিভৃতবাসে থাকা মেহবুব আলি, আসগর আলি, সাদ্দাম খাঁ, শেখ রসিদ বক্সদের বাড়ি থেকে৷ সাদ্দাম, বিজয়েরাও নিভৃতবাস থেকে বাড়ি ফিরেছেন৷ (সংবাদ সূত্রঃ ওই)৷
মানুষে মানুষে সম্পর্কের বাঁধন যখন ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদের প্রাচীরকে রাষ্ট্রের মদতে যখন দেশজুড়ে দৈর্ঘ্য–প্রস্থ–উচ্চতা বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত, এ নিয়ে অসহিষ্ণুতা যখন মানবিক মূল্যবোধকে নির্মমভাবে নিষ্পেষণ করছে, তখন এই অতিমারির সময়েও এর বিপরীত চিত্র আমাদের ভিন্ন ভাবনায় ভাবিত করে, নতুন আশায় উজ্জীবিত হতে শক্তি যোগায়৷ মনে হয়, মতলববাজদের লক্ষ্য পূরণের পথে বাধার শক্তিও রয়েছে এই সমাজ অভ্যন্তরে, যাকে পুষ্ট করার দায়িত্ব যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সমাজ সচেতন মানুষের৷
গৌরীশংকর দাস
খড়গপুর