সত্যিই অন্য এক ২৫ ডিসেম্বর কাটালাম এ বছর। কেক খাওয়া, ফিস্ট করা, গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা, সবই হল। তবে এক অন্য স্বাদে। এমন এক ‘বড়দিন’ জীবনে কাটাব, ভাবিনি কখনও।
শুরুটা বছর পাঁচেক আগে। সবে পুরুলিয়া থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এলাকার বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি। খবর পেলাম বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় ৫০ মিটারের মধ্যে দুটি মদের দোকান সরকারি অনুমোদন পেয়েছে। মদের নেশা সর্বনাশা। ক্ষুব্ধ ও আশঙ্কিত এলাকার মানুষ রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। যুক্ত হলাম আন্দোলনে। গড়ে উঠল মদ বিরোধী নাগরিক কমিটি। মিটিং, মিছিল, ডেপুটেশন, কেস-কাছারি, দীর্ঘ লড়াই শেষে জয়ের হাসি। দুটি মদের দোকানই অচিরে বন্ধ হল। বছর তিনেক আগে। তবুও মানুষজন আতঙ্কিত। হয়ত এলাকায় আবার এমনই দোকান গড়ে উঠবে। সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হবে। মহিলারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না। এলাকার ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা থাকবে না। যুবকরা বিপথগামী হবে। এলাকার গরিব মানুষেরা আরও আতঙ্কিত হলেন, বাড়ির লোকেরা সব শেষ করে ফেলবে মদ খেয়ে।
আশঙ্কা সত্যি করে গত নভেম্বরে প্রশাসন একটি মদের দোকান আবার খুলে দিল। শুরু হল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। মাসাধিক কাল প্রতিদিনই প্রশাসনিক দপ্তরে দাবিপত্র পেশ, গণস্বাক্ষর, মিটিং, মিছিল অবরোধ হতে থাকল। চলল লাগাতার মদবিরোধী পিকেটিং। প্রশাসনের চোখরাঙানি আর জনগণের আতঙ্ক-আবেদন আমাদের দৃঢ়বদ্ধ করল প্রতিবাদে প্রতিরোধে জোটবদ্ধ হয়ে থাকতে। শুরু থেকেই বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব, যারা এই পচাগলা সমাজেও মাথা উঁচু করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখেছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হল।
পিকেটিং চলতে চলতে সেদিন কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা, আমার ছাত্র, প্রস্তাব দিল ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর দিনভর মদবিরোধী পিকেটিং চলবে। সবাই রাজি হল। নতুন অভিমুখে, নতুন শক্তিতে শুরু হল আন্দোলন।
হতভাগ্য এই দেশ। এক দিকে ধনী-দরিদ্রের চূড়ান্ত বৈষম্য, অন্য দিকে সেই বৈষম্য আড়াল করতে শাসক শ্রেণি জনসাধারণকে অবুঝ করে রাখতে চায়। চায় ছাত্র-যুবসমাজ অপসংস্কৃতির জোয়ারে ভাসুক, মানুষ মদে বুঁদ হয়ে সাময়িক উত্তেজনায় দারিদ্রের জ্বালা ভুলে থাকুক। এই সব ধরনের মানুষের সাথেই আমাদের সারাদিনের কথাবার্তা চলল। কখনও আবেদন-নিবেদন, কখনও বচসা, কথা-কাটাকাটি। কর্তব্যে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। ঠিক করেছিলাম কিছুতেই হাল ছাড়ব না। এরই মধ্যে কথা উঠল ২৫ ডিসেম্বরের কেক খেতে হবে। এক বন্ধু উৎসাহে কিনে আনলেন কেক। সবাই মিলে চাঁদা তুলে খাওয়া-দাওয়াও হল। হয়তো অন্যদের মতো আউটিংয়ে যেতে পারলাম না বা মাইকে গান বাজিয়ে বনভোজনের স্বাদ নিতে পারলাম না। কিন্তু এই সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে সবাই মিলে রুখে দাঁড়িয়ে এক অনন্য২৫ ডিসেম্বর কাটালাম। এই দু’দিন আমিনুল, সূর্যদা, নজরুলদা, তরুণদা, অসীমাদি, হারুন ভাই, মাসিমা, প্রতাপদা, সঞ্জিত স্যার, নুরজামান, ইয়াসিন, মেহেবুব, কালীদা, ইয়াকুব, জিয়াবুল, জহুর হোসেন, কুতুব, মাসুদ, রিয়াজুল, প্রতিমা, সতীশদা, বলাইদা, পার্থ আরও অনেকে– সর্বোপরি শক্তিবাবু, কাউন্সিলর, সঞ্জয়দা, নিতাইবাবু, মোহাম্মদদা, নুরুলবাবু, প্রণবদা, মোহন– এঁদের সহযোগিতায় অন্য এক ২৫ ডিসেম্বর প্রত্যক্ষ করলাম।
লোকে বলে, ‘সমাজ পচে গেছে। আমি একা কী আর করতে পারি?’ কিন্তু না। প্রমাণ হল, এই পচাগলা সমাজকে নতুন রূপে গড়তে গেলে মানুষকে পাশে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। তা হলে সাধারণ মানুষও অসাধারণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শম্ভু মান্না
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর