তৃণমূল নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দেদার চুরি-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন জেলেও গিয়েছে। সম্প্রতি আর জি করের নারকীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখনও নাগরিক আন্দোলন চলছে। তবু তারা একের পর এক ভোটে জিতছে। ছয়টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও তারা বিপুল ভোটে জিতল। এর কারণ কী?
–প্রশ্নটা চা দোকানদার রতনের। রিটায়ার্ড বিমলদা তার রেগুলার কাস্টমার। তিনি তখন চা শেষ করে নস্যি নিচ্ছিলেন। তড়িঘড়ি রুমাল দিয়ে নাক মুছে জবাব দিলেন, ‘একেই বলে মমতা ম্যাজিক, বুঝলে’? রতন ঠিক স্বস্তি পেল না। ওভেনের আঁচটা একটু কমিয়ে দিয়ে স্থির পলকে বিমলদার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে উনি ফের বললেন, ‘আসলে কী জানেন, ওসব চুরি, দুর্নীতি, ধর্ষণ, মূল্যবৃদ্ধি –এখন আর কোনও সিরিয়াস ইস্যুই নয়। মানুষ সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে, সিপিএম কংগ্রেস তৃণমূল নামে আলাদা হলেও কাজ তারা একই করে, জনতাকে ঠকায়। ভেবে দেখ দেখি, বিজেপি কী করে ভোট পায়! ওটার মতো কোরাপ্ট পার্টি আর আছে? কোরাপশনের জন্য ওদের তো নোবেল দেওয়া উচিত। শুধু এরাই নয়। একটু খোঁজ নিলেই দেখবে, এখন ঠগ বাছতে শুধু গাঁ নয়, পুরো দেশটাই উজাড় হয়ে যাবে। ফলে, ওগুলো কোনও ইস্যু না।’ রতন জানতে চাইল, কিন্তু ‘আর জি কর’? বিমলদা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ঘটনা মারাত্মক। সেজন্য তৃণমূল সরকারের দুর্নীতিপরায়ণতাই মূল দায়ী। কিন্তু উপায় কী? রাজনীতি এখন ডোলের কোলে দোল খাচ্ছে। জীবন-জীবিকায় জেরবার মানুষ ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি স্কিমের গ্রাসে চলে যাচ্ছে। আর জি কর নিয়ে চাপে পড়ে মমতা তবু কিছুটা আলাপ-আলোচনার পথে গেছে, জ্যোতিবাবু তো জুনিয়র ডাক্তারদের পুলিশ এবং পার্টির মাস্তান পাঠিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন।’
রতন জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে ইস্যুটা কী’? উত্তর এল, ‘ইস্যু কিছু নেই। জোর যার মুলুক তার। যে যত বড় উন্নয়নের কাণ্ডারী সাজতে পারবে, কুর্সি তার।’ রতন একটু হতাশ সুরে বলল, ‘তাহলে এসব অন্যায়ের কোনও প্রতিকার নেই বলছেন’? বিমলদা খুব সহজেই জবাব দিলেন, ‘আলবাত আছে। যেদিন এ ধরনের দলগুলো ধ্বংস হবে সেদিন চুরি-দুর্নীতি-ধর্ষণ সব বন্ধ হবে।’ রতন হাসার চেষ্টা করল। বিমলদা বললেন, ‘মনে রেখো, নেহেরুর মতো শিক্ষিত ভদ্রলোকও কিন্তু চুরি-দুর্নীতির সঙ্গে অনায়াসে আপস করেছেন। এমনকি দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের মন্ত্রীসভাতেও ঠাঁই দিয়েছেন। তিনিও শিল্পপতিদের থেকে অকাতরে পার্টি ফান্ডে টাকা নিয়েছেন, তাদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। তিনিও ভোটে জিততে বারবার জনতাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই পথেই কংগ্রেস রাজত্ব করেছে, শাসন শোষণ চালিয়েছে। খুন-খারাপি দাঙ্গা দুর্নীতি সব করেছে। আগে এত সহজে জানা যেত না, এখন অনেক কিছু জানা যায়, পার্থক্য এটুকুই।’
প্রৌঢ় স্বপনদা পেপারটা ভাঁজ করে রেখে বললেন, ‘মুড়ি মিছরি এক করবেন না তো। সিপিএম আমলে এসব হয়নি। আমাদের নেতারা কেউ চোর নয়। ইলেক্টোরাল বন্ডে আমরা টাকা নিয়েছি’? বিমলদা হেসে বললেন, ‘কোনটা হয়নি সিপিএম আমলে ভাই? তাছাড়া, টাকা চুরি তো নেহাত সহজ কাজ হে। তোমরা তো কতগুলো প্রজন্মের ভবিষ্যতই চুরি করে নিয়েছ। এ অপরাধ কী মারাত্মক, বোঝো তা? সরকারি শিক্ষার সর্বনাশ করে মদের ঢালাও লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেছিল কারা? তার সাথে রান্নাঘর থেকে রাইটার্স পর্যন্ত দলতন্ত্রের বিষও তোমরাই আমদানি করেছ। কন্ট্রাক্টর, প্রোমোটার রাজের হোতা কারা? বিরোধীদের কীভাবে তোমরা মারতে, খুন করতে, কীভাবে ভোট লুঠ করতে সেসব কি মানুষের অজানা? ক্ষমতা হারিয়ে এখন সাধু সাজতে চাইলে হবে? কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়েকে ফেসবুকে বিপ্লবী সাজিয়ে প্রেজেন্ট করছ, যেদিন ওরা তোমাদের ইতিহাস জানবে সেদিন ঘেন্না করবে তোমাদের, মিলিয়ে নিও। আর, ইলেক্টোরাল বন্ডে এখনও টাকা নাওনি ঠিকই কিন্তু কর্পোরেট ফান্ড ঝুলি ভরে নিচ্ছ। কাদের স্বার্থে? মানুষ বোঝে না? এমনি এমনি তোমরা শূন্য হয়েছ ভাবো? পিকে ডেকেও শিকে ছিঁড়বে না, জেনে রেখো।’
স্বপনদা বললেন, ‘ভিত্তিহীন কথা বলে কী লাভ? আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে’? বিমলদা মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই, নিজেরাই জানো তোমরা প্রমাণ তো আছেই, প্রমাণ থাকে না। এলাকায় এলাকায় স্কুল-কলেজগুলোতে তোমাদের আমলে কত যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়ে অযোগ্যরা ঢুকে বসে আছে, তা কি তোমরা জান না? সাজিয়ে প্রমাণ রেখে অপরাধ করে শখের গোয়েন্দা গল্পের ভিলেনরা। সারদা মামলায় তৃণমূলের সব অভিযুক্তই তো জামিন পেয়েছে। মুকুলবাবুকে তো সিবিআই ভুলে গিয়েছিল! গুজরাট দাঙ্গায় মোদিজিও তো ছাড় পেয়েছেন। সেখানে কী বলবে’? এটা শুনে রেগে গেলেন কার্তিকদা। কিন্তু রাগ চাপার চেষ্টা করে বললেন, ‘ছাব্বিশটা আসতে দিন, তার পর দেখবেন।’ বিমলদা আবার রুমাল দিয়ে নাক মুছে বললেন, ‘চোদ্দ থেকেই তো দেখছি ভাই। গুজরাটে বেকার যুবকরা কাজের জন্য মারামারি করছে। বস্তি ঢাকতে পাঁচিল উঠছে। কল-কারখানা বন্ধ হচ্ছে। দুর্নীতিও তো সীমাহীন। সিবিআই সুরাটের এবিজি শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগকে ভারতের ‘বৃহত্তম ব্যাঙ্কিং কেলেঙ্কারি’ বলেছে। তার মালিক গ্রেপ্তার হয়েছে? গুজরাটের নগরোন্নয়ন এবং রাজস্ব বিভাগ, পঞ্চায়েত এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কোনও তদন্ত পদক্ষেপ সরকার করেছে? কয়েক বছর আগে গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল কলেজের ভর্তিতে জালিয়াতি হয়েছে, তদন্ত বা শাস্তি হয়েছে? গুজরাটের সরকারি কর্মকর্তা এবং দালালরা রীতিমতো কিস্তিতে ঘুষ নেয়, তা জান? মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারির মতো ভয়ঙ্কর দুর্নীতি কটা হয়েছে ভারতে? প্রমাণ লোপাট করতে কতগুলো খুন পর্যন্ত হয়ে গেল। তারপর ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনা’য় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কোনও বিরোধী নয়, অভিযোগ করেছে ক্যাগ (সিএজি)। ওখানে জৈব চাষের প্রচারের জন্য বরাদ্দ করা কোটি কোটি টাকা লোকাল অফিসারেরা লুটেছে। ইডি, সিবিআই কোথায় ভাই? আরেকটা হল উত্তরপ্রদেশ। সেখানে অবস্থা কী? মুসলিম, দলিতদের ওপর নির্যাতন ছেড়ে দাও। মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের জন্য সরকারি বৃত্তি প্রকল্পে ৭৫ কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়নি? শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়নি? দুর্নীতির জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্ট ৬৯ হাজার শিক্ষকের প্যানেল বাতিল করে দেয়নি? সব জেনে কেন বাজে বকো’?
কার্তিকদা নিস্তেজ স্বরে বললেন, ‘আমি কোনও পার্টি করি না দাদা। মোদিজি একটা চেষ্টা করছেন, তাই ওনাকে ভালো লাগে।’ বিমলদা বললেন, ‘হ্যাঁ, চেষ্টা উনি আপ্রাণ করছেন। দেশের ঘটিবাটি যা আছে সব বেচে দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই উনি করছেন। তাতে সন্দেহ নেই। দুনিয়ার যত বড় চোর ডাকাত তো এখন মোদিজির দলেই আশ্রয় নিয়েছে! এবার একটু মন দিয়ে তৃণমূলের ঘোড়া বেশি করে কিনে পশ্চিমবঙ্গে আসা যায় কি না দেখো।’ রতন বলল, ‘ওদের টাকা আছে। ওরা তা করতে পারে। তবে, এসব অন্যায়ের কোনও প্রতিকার নেই, এটা আমার মনে হয় না। পথটা খুঁজতে হবে। ওই যে অনুপদা আছে না, এস ইউ সি করে, উনি একটা কথা খুব ভালো বলেছিলেন যে, ‘অন্ধকার হল আলোর অভাব। আলোটা বাড়াতে হবে, জোরদার করতে হবে। তাহলেই অন্ধকার শেষ হবে।’ রতন বলে চলে– এখন কালো বেশি কিন্তু আলোও তো আছে।