করোনা মহামারিতে ভারত নামক দেশটি কেমন আছে? প্রশ্নটা এক, উত্তরটা কিন্তু এক নয়। কারণ সঙ্গে সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন উঠে আসে– কোন ভারত? ১৪০ কোটি ভারতবাসীর ৯৯ শতাংশের ভারত, নাকি বাকি ১ শতাংশের ভারত?১ শতাংশের ভারত– উজ্জ্বলতার শেষ নেই তার। সে ভারতে ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকার সম্পদ বাড়ে একজনের। সে ভারতে নেই কোনও দুর্দশার চিত্র, নেই মন্দা, অনাহার, কর্মচ্যুতি, হাহাকার। সেখানে বেড়ে ওঠে বৈভব, বিলাস। সেখানে লকডাউনের বিরক্তি কাটাতে ভেসে পড়া যায় ব্যক্তিগত প্রমোদ তরীতে। উড়ে চলে যাওয়া যায় নির্জন নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরা বিদেশি রিসর্টে। সে ভারতের নাগরিককে কাজ হারিয়ে শত শত মাইল হেঁটে ঘরে ফিরতে হয় না, তৃষ্ণায় একবিন্দু জল পেতে ছটফট করতে হয় না। সে ভারতে সভ্যতার স্রষ্টাদের সব মান খুইয়ে লঙ্গরখানার লাইনে কাড়াকাড়ি করতে হয় না। আর অন্য ভারত? সেখানে মাত্র দু’মাসে বাঁধা বেতনের চাকরি হারায় ২ কোটির বেশি লোক। সাড়ে ১২ কোটি শ্রমিক কাজ থেকে নির্বাসিত হয়। ৪০ কোটি নতুন করে তলিয়ে যায় দারিদ্রের অতল খাদে। সে ভারতে কর্মক্ষম (১৫ থেকে ৬০ বছর) ১০৩ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৪০ কোটির কাজ করার সুযোগ মেলে। করোনা বিপর্যয়ে ওই ৪০ কোটি গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ২৮.৩ কোটিতে। যারা কাজ পায়, দিনে দিনে তাদেরও শ্রমের মূল্য কমে, তারা এবং তাদের পরিবার পরিজন এগিয়ে চলে ধ্বংসের পথে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আত্মনির্ভর ভারত’। কিন্তু কোন সে ভারত? সে কি ওই ১ শতাংশের ভারত? যেখানে করোনা সংকটের সুযোগ নিয়ে রিলায়েন্স কর্তা মুকেশ আম্বানির সম্পদ ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬ লক্ষ ৩৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। ঘণ্টায় বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৯০ কোটি টাকা। উইপ্রো, আদানি গোষ্ঠী, এইচসিএলের মালিকদের সাথে করোনা টিকার স্বপ্ন দেখিয়ে সিরামের মালিক সাইরাস পুনাওয়ালারও সম্পদ বেড়েই চলে। কত? ফোর্বস পত্রিকার তালিকা অনুযায়ী গৌতম আদানির সম্পদ বেড়েছে ৭১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। অন্যদেরও ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে শুধু করোনার প্রথম পাঁচ মাসে।
কিন্তু এমন অবিশ্বাস্য পরিমাণে সম্পদ বাড়ল কী করে? আত্মনির্ভর হয়ে? উৎপাদনে পুঁজি খাটিয়ে দেশি পণ্য বানিয়ে? পুঁজিবাদের ঘোর সমর্থকরাও তা বলতে ঢোক গিলছেন। যেমন, ১৩ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা মন্তব্য করেছে ‘পণ্যের ঠিক দাম আবিষ্কারের দক্ষতায় মরচে পড়েছে বাজারের’। যত রেখে ঢেকেই বলা হোক না কেন, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সের গবেষণার উল্লেখ করে যা বলেছে তার মানে দাঁড়ায়, পণ্য উৎপাদনে শ্রমশক্তি যে মূল্য যোগ করে তার অতি নগণ্য অংশই শ্রমিককে দেয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ওরা বলে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা কমছে, কিন্তু আর একটু চেপে ধরলেই বেরোয় জাতীয় আয়ে শ্রমিকের অংশ কমছে। আসলে যেটা বলতে চায় না, লুঠ হচ্ছে শ্রমিকের প্রাপ্য শ্রমশক্তির মূল্য। ওই গবেষণাই জানিয়েছে, বাজার ক্রমাগত দখল করছে দৈত্যাকার বড় পুঁজির মালিক মুষ্টিমেয় একচেটিয়া বহুজাতিক সংস্থা। ফলে পুঁজিবাদী বাজারে ‘প্রতিযোগিতা’ শব্দটির অর্থ প্রায় নেই বললেই আজ চলে। যত একচেটিয়াকরণ হয়, ততই কমে শ্রমিক নিয়োগ। কমে চলে শ্রমিকের প্রাপ্য। তাহলে পুঁজি ধরে আনলেই আত্মনির্ভর হবে ভারত? নাকি একচেটিয়া পুঁজিই পরজীবীর মতো শুষে নিচ্ছে সমাজের সম্পদ? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এশিয়া প্যাসিফিক রিপোর্ট-২০১৭ এবং আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষকের অনুসন্ধান দেখিয়েছে, ১৯৮০-৮১ সালে ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক তার শক্তি নিংড়ে ১০০ একক নতুন মূল্য উৎপাদন করলে তার ভাগে পড়ত ২৮.৫ শতাংশ। সেই পরিমাণ কমতে কমতে ২০১১ সালে দাঁড়ায় ১১.২ শতাংশ, ২০১৪-তে তা ৯ শতাংশের নিচে চলে গেছে।
তা হলে মোদী সাহেবের তথাকথিত আত্মনির্ভর ভারতের ধনবৃদ্ধির আসল নির্ভরতা কোথায়? এক নম্বরে আছে শ্রমশক্তির সীমাহীন লুঠ, নির্মম শ্রমিক শোষণ। আর দ্বিতীয় নির্ভরতা – এই বিপুল পুঁজি খাটাবার ধরন। বস্তুগত কিংবা পরিষেবা উৎপাদনে কি খেটেছে এই বিপুল পুঁজি? না, প্রধানমন্ত্রী যে ক্ষণে ক্ষণে ‘আত্মনির্ভরতা’ আর পুঁজি বিনিয়োগের কথা শোনান, তার আসল বৃদ্ধি হয়েছে শেয়ার বাজারে, ফাটকায়– কোনও উৎপাদনে নয়।
তাই অর্থনীতি যখন তলিয়ে গিয়ে বৃদ্ধি দেখায় শূন্যের ২৪ শতাংশ নিচে, তখনও ধনকুবেরদের মুনাফা-মেশিন ছুটতে থাকে। ছোট বড় অসংখ্য সংস্থায় লালবাতি জ্বলেছে। সরকারি হিসাবে প্রায় ৮০ হাজার। কিন্তু তাতে বড় কোম্পানির পোয়াবারো হয়েছে। ব্যাঙ্কে সুদ কমার ফলে যে মধ্যবিত্তরা সঞ্চয়ের জন্য শেয়ার বাজারে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের পকেট কেটে বিপুল দাম তুলেছে বড় বড় কোম্পানি। উৎপাদনে কিংবা শ্রমিকের মজুরিতে এক পয়সা খরচ না করেই বিপুল পুঁজিবৃদ্ধির সুফলে ধনকুবেরদের সিন্দুক উপচে পড়ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস পর্যন্ত বলছেন, শেয়ার বাজারের বিপুল বৃদ্ধির সাথে প্রকৃত অর্থনীতির কোনও যোগ নেই (ইন্ডিয়া টুডে, ৩.০৯.২০২০)। এই মহামারির আগেই অ’ফ্যাম ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সমীক্ষা দেখিয়েছিল ভারতের সাড়ে ৯৫ কোটি মানুষ সবাই মিলে যা আয় করেন, ১ শতাংশ করে তার চার গুণ। তাই প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের স্লোগান, পুঁজি ধরে আনা, বিনিয়োগ বাড়ানোর দাওয়াই– কোনও কিছুতেই সাধারণ মানুষের কোনও উপকার হয় না।
একটা কথা বললেই করপোরেট সাহেবকুল আর তাদের খিদমদগার সরকারি কিংবা বিরোধী ভোটবাজ দলগুলির নেতাদের ভুরু কুঁচকে যাবে। কিন্তু মহান নেতা লেনিনের কথা এখানে স্মরণ না করে উপায় কী? লেনিন তাঁর ‘পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ নামক বিখ্যাত রচনায় দেখাচ্ছেন, পুঁজিবাদের সংকটগ্রস্ত দশা এবং সাম্রাজ্যবাদের যুগে মুনাফার প্রধান চাবিকাঠিটা রয়েছে ফিনান্স কারচুপির ‘প্রতিভাবানদের হাতে’। দেখিয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদের যুগে ফাটকা কারবারটাই পুঁজি মালিকদের মুনাফা শিকারের অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়। আজকের করোনা মহামারির সংকটের দিনে দেখা যাচ্ছে এ কথা কত বড় সত্য। সংবাদপত্রই বলছে, এই বিপুল লাভের উৎস প্রধানত শেয়ার বাজারের খেলা। আজ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের যুগে অনেক মাথা ঘামিয়ে বড় বড় সব অর্থনীতিবিদরা আবিষ্কার করছেন, অর্থনীতির বহর বাড়ছে, ‘গ্রোথ’ হচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষের আয় বাড়ছে না, কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বাজারে চাহিদা বাড়ছে না। আবার অর্থনীতি তলিয়ে গেলেও এক দলের আয় কমে না বরং বেড়ে যায়। পণ্ডিতরা অনেক মাথা চুলকেও কারণটা ধরতে পারছেন না।
সারা পুঁজিবাদী দুনিয়ার চিত্রটা আজ এই। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ দেখিয়েছেন খোদ মার্কিন মুলুকে ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় (মূল্যবৃদ্ধি ছাপিয়ে গিয়ে যতটা আয় হাতে থাকে) গত ৪০ বছরে বাড়েনি। প্রকৃত মজুরি বাড়েনি ৬৫ বছর। আমাদের ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এই করোনা মহামারির পাঁচ মাসে ভারতে ধনকুবের ১ শতাংশের আয় বেড়েছে ২১৩ শতাংশ। অন্য দিকে সাড়ে ৯৫ কোটির বেশি মানুষের আয় ১ শতাংশও বাড়েনি। সংবাদমাধ্যম সাফাই গায়, বৈষম্যটাই আসল শত্রু। সেটা হটাতে পারলেই আবার চাকা গড়াবে অর্থনীতির। কিন্তু বলতে সাহস পায় না– বৈষম্যটা আসলে কারণ নয়, ওটা হল রোগের লক্ষণ। বৈষম্যের আসল কারণটা হল পুঁজিবাদী অথনৈতিক ব্যবস্থা। ভাইরাসের মতোই যা সমাজের সব জীবনীশক্তিকে ধ্বংস করে।
রোগটাকে না সারিয়ে লক্ষণটা নিয়ে মাথা ঘামালে কি চিকিৎসা হয়? ‘আত্মনির্ভর’ তো আসলে শ্রমিক, সে সবচেয়ে অবহেলিত। পরজীবীর মতো তাকে শোষণ করে বেঁচে থাকে পুঁজিমালিক। এই পরজীবী সমাজটাকেই উচ্ছেদ করলে তবেই মিলবে সমস্যার সমাধান।