শিক্ষায় ডিজিটাল বৈষম্যে আরও এক স্বপ্ন দেখা মেধাবী তরুণী আত্মঘাতী হলেন।
হায়দরাবাদের শাদনগরের বাসিন্দা ঐ তরুণী, জি ঐশ্বর্য রেড্ডি, উচ্চমাধ্যমিকে ৯৮.৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। স্বপ্ন পূরণ করতে দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পড়ার খরচ জোগাড় করতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের ‘ইন্সপায়ার’ বৃত্তির যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে লকডাউনে সেই বৃত্তির টাকা বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। প্রথম দিকে মোবাইলে সেই ক্লাস করতে পারলেও গণিত অনার্সের সেই পাঠের জন্য ল্যাপটপ আবশ্যক হয়ে পড়ে। বাবাকে জানিয়েও ছিলেন। কিন্তু লকডাউনে বাবার বাইক-মিস্ত্রির কাজ এবং মায়ের দর্জির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বোনের পড়া তার আগেই মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। মায়ের গয়না এবং এক কামরার বসতবাড়িটিও বন্ধক রাখতে হয়েছিল। চুরমার হয়ে যায় ঐশ্বর্যের স্বপ্ন। ২ নভেম্বর তিনি আত্মঘাতী হন। সুইসাইড নোটে তাঁর শেষ আবেদন ছিল, বৃত্তির প্রাপ্য টাকা দিয়ে যেন তাঁর পরিবারকে ঋণমুক্ত করা হয়।
এমনই মর্মান্তিক পরিণতি ঘটছে সারা দেশে আরও অনেক ছাত্রছাত্রীর। তার কিছু খবরে এসেছে, অনেকই আসেনি। দেশে অনলাইন পড়াশোনা চালু হয়েছে। কিন্তু ক’জনের আছে এই সঙ্গতি? ভারতে মাত্র ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর স্মার্টফোন এবং ৮ শতাংশের ল্যাপটপ আছে। ভারতের ৫৫ হাজার গ্রামেই নেই ইন্টারনেটের সংযোগ। ২৮ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎও নেই। ফলে খুবই স্বল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অনলাইন পাঠের আওতায়। ফলে, ঐশ্বর্যের মতো বহু মেধাবী অথচ আর্থিকভাবে পিছিয়ে-পড়া ছাত্রছাত্রী শিক্ষাবঞ্চিত হল। বৈষম্যমূলক অনলাইন শিক্ষার প্রথম বলি কেরলের মল্লপুরমের দশম শ্রেণির ছাত্রী দেবিকা বালকৃষান। ১ জুন তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ১০ জন ছাত্রছাত্রী এবং এক দিনমজুর অভিভাবক এই ডিজিটাল বৈষম্যে আত্মঘাতী হয়েছেন।
শুরু থেকেই সরকার সঠিক বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সাধারণ মানুষের বাস্তব অবস্থায় নজর না দিয়ে অবিবেচক প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ঐশ্বর্যের পরিবার তারই শিকার হল। এভাবে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে শিক্ষায় সার্বজনীনতাকে ধবংস করা হল। শিক্ষায় ডিজিটাল বৈষম্যকে প্রতিষ্ঠিত করা হল।
শুধু করোনা পরিস্থিতির জন্য নয়, লকডাউন ঘোষণার অনেক আগেই অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণে ১০০টা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশের শিক্ষাবাজারে অনলাইন ডিগ্রি প্রদানের সুযোগ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সরকারের বক্তব্য, উচ্চশিক্ষার হার (গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও) অর্থাৎ ১৮ থেকে ২৩ বছরের তরুণদের মধ্যে ছাত্রছাত্রীর শতকরা হার, যা বর্তমানে ২৬.৩ শতাংশ, তাকে চীনের সমান (৩৫ শতাংশ) করতে সরকার উদ্যোগী। কীভাবে তা করবে? এ দায়িত্ব সরকার নিজে পালন করবে না। বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে এ দায়িত্ব তুলে দিয়েছে সরকার। তারা কি এ দায়িত্ব বিনা পয়সায় করবে? এর আর্থিক দায়ভার ছাত্রছাত্রীকেই বহন করতে হবে। তাছাড়া আরও প্রশ্ন হল, অনলাইন শিক্ষা কি যথার্থই প্রথাগত ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হতে পারে? না, হতে পারে না। ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক প্রশ্নোত্তরের পরিবেশে যে শিক্ষা অর্জিত হয়, তা যন্তে্রর পাশে বসে শিক্ষার্থীর আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আসলে শিক্ষা তো শুধু কিছু ফর্মুলা শেখা বা প্রবলেম-সলভ করা নয়। এগুলির পাশাপাশি কিছু মানবিক শিক্ষা ছাত্রছাত্রীরা পায় শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে, যা তাদের বড় হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। তা কি কোনও স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ দিতে পারে! এখানেই প্রথাগত শিক্ষার গুরুত্ব। অথচ সরকার প্রথাগত শিক্ষাক্ষেত্রটিকে নানা অজুহাতে সঙ্কুচিত করে চলেছে। তাতে সরকারের শিক্ষার ব্যয়ভার কমবে। নতুন স্কুল-কলেজ খুলতে হবে না। শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না। বিপরীতে শিক্ষার বেসরকারিকরণকে আরও প্রসারিত করা সম্ভব হবে। এর ফলে গণতান্ত্রিক শিক্ষার টিকে-থাকা পরিসরটুকু থেকে হারিয়ে যাবে ঐশ্বর্য, দেবিকার মতো আরও অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী। তাতে পুঁজিবাদী সরকারের কী আসে যায়! পুঁজিপতি ও তার সেবাদাস সরকারের কাছে মানবসম্পদ নিছকই শোষণের কাঁচামাল।