দেশে ঢালাও অনলাইন শিক্ষার প্রথম বলি হলেন কেরালার মল্লপূরম জেলার নবম শ্রেণীর ছাত্রী দেবিকা বালকৃষ্ণান৷ ১৪ বছরের ওই গরিব অন্ত্যজ পরিবারের ছাত্রীটির কোন স্মার্টফোন ছিল না৷ বাড়ির টেলিভিশন তিন মাস খারাপ৷ লকডাউন এর ফলে বাবার রোজগার কার্যত বন্ধ৷ তাই টিভি ও সারানো যায়নি৷ এ–দিকে অনলাইন ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে পুরোদমে৷ পড়াশোনায় আগ্রহী দেবিকা ক্লাস করতে পারছে না–এই হতাশা থেকেই গত ১ জুন আত্মহননের পথ বেছে নেয়৷ এই মর্মান্তিক সংবাদটিকে কেড কেড বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতেই পারেন৷ কিন্তু নিঃসন্দেহে এই ঘটনা ভারতের মতো বিশাল অথচ গরিব দেশে ঢালাও অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিল?
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে দেখা গেল, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির সাফল্য নিয়ে সন্দিহান৷ শুধু তিনি নন স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় অধিকাংশ শিক্ষক সংগঠন বিশেষত সর্বভারতীয় শিক্ষক সংগঠন ‘এআইফোকটো’ ও সর্বভারতীয় শিক্ষা আন্দোলনের মঞ্চ ‘অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি’ এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন এই পদ্ধতিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়েছেন৷ তাদের মতে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি আইআইটি ও আইসার এর মতো হাতে গোনা কিছু উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল কলেজে কিছুটা সাফল্য আনলেও, অধিকাংশ স্কুল–কলেজে বিশেষত সাধারণ সরকার পোষিত স্কুল–কলেজে যেখানে অধিকাংশ নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব ঘরের ছাত্ররা পড়াশোনা করে তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়াবে৷ ধনী–দরিদ্র এবং শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষায় বৈষম্য প্রকট হবে৷
আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার চিন্তা ভাবনায় মধ্যযুগীয় হলেও প্রধানমন্ত্রী থেকে শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করার কথা বলছেন৷ এ বারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রথাগত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে৷ কিন্তু কেন্দ্রের শিক্ষা বাজেটে ডিজিটাল শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ক্রমাগত কমছে– ২০১৯–২০তে ৬০৪ কোটি, ২০২০–২১–এ ৪৯৬ কোটি টাকা৷ ফলে অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না৷ আর ন্যূনতম পরিকাঠামো না গড়ে তুলে, নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যায়নের নামে সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার ফলে, স্কুল শিক্ষার কী চরম অবনতি হয়েছে তা আমরা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি৷ শিক্ষায় ছাত্রদের মধ্যে বেড়েছে বিভেদ ও বৈষম্য৷ এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে৷ অথচ কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ ডন্নয়ন মন্ত্রী সম্প্রতি প্রাচীন বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার কথা বলছেন, সাথে সাথে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পড়াশোনার কথা বলছেন৷ এই দুটোকে তারা কিভাবে মেলাবেন তারাই বলতে পারবেন, কিন্তু আমরা যারা সাধারন মানুষ তারা দেখতে পাচ্ছি অনলাইন শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি সাধারণ গরিব মানুষের ঘরের ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে৷ গরিব মানুষের ঘরে, শহরাঞ্চলেই হোক আর বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, ল্যাপটপ ও ভালো অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই৷ এ ক্ষেত্রে সরকারি তথ্য কী বলছে দেখা যাক৷ সারাদেশে ২৪ শতাংশ মানুষের কাছে স্মার্টফোন আছে আর ১১ শতাংশ বাড়িতে ইন্টারনেট যোগাযোগ, তার মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ বাড়িতে, যেখানে ৫–২৪ বছরের ছাত্র ছাত্রী আছে, নেটওয়ার্ক সহ কম্পিডটার আছে৷ তার উপরে ইন্টারনেট যোগাযোগ খুবই খারাপ৷ অন্তোদয় মিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৬ শতাংশ বাড়িতে ৮ ঘন্টা, ৩৩ শতাংশ বাড়িতে ৯–১২ ঘন্টা ও ৪৭ শতাংশ বাড়িতে ১২ ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ পরিষেবা পাওয়া যায়, তাও লোভোল্টেজের সমস্যা সহ৷ দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন যেখানে ১৫ শতাংশ বাড়িতে ইন্টারনেট আছে আর শহরে সে ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশ (NSSO Report ২০১৮)৷ আবার এই ইন্টারনেটের খরচ বহন করতে হবে ওই ছাত্রদেরই, সরকার বাহাদুর করবেন না৷ দীর্ঘ লকডাউন এর পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের অবস্থা অত্যন্ত করুণ৷ টাকা যোগাবে কে? গৌরী সেন? যদিও এর ফলে বহুজাতিক ইন্টারনেট কোম্পানিগুলি কোটি কোটি টাকার মুনাফা করবে এবং বেসরকারি ব্যবসায়িক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়বে৷ এ ছাড়া আমাদের দেশে রাজ্যে রাজ্যে ইন্টারনেট যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য আছে৷ যেখানে দিল্লি, কেরালা, কর্ণাটক, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, প্রভৃতি রাজ্যে ৪০ শতাংশ, সেখানে ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, বিহার, এম পি, ছত্তিশগড়, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে ২০ শতাংশের কম ইন্টারনেট যোগাযোগ আছে (IMOAI Report ২০১৯)৷ অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বক্ষেত্রে বিভেদ ও বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট৷ তাই করোনার আবহে লকডাডনের বাজারে অনলাইন শিক্ষা নিয়ে খুব হইচই হলেও, এ ব্যাপারে সাফল্য কিন্তু খুবই কম৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী পনেরো থেকে কুড়ি শতাংশ৷
এ ছাড়া আমরা জানি, শিক্ষাদান মানে তো কিছু তথ্যের আদান–প্রদান নয়৷ এটা জ্ঞানার্জন ও মানুষ গড়ার জীবন্ত প্রক্রিয়া যেটা একজন শিক্ষকের মাধ্যমে ছাত্ররা পেতে পারেন৷ ফলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে,‘ … শিক্ষা সম্বন্ধে একটা মহৎ সত্য আমরা শিখিয়াছিলাম৷ আমরা জানিয়াছিলাম, মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে, যেমন জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া উঠে, প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে৷ … গুরু–শিষ্যের পরিপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষাকার্য সজীব দেহের শোণিত স্রোতের মত চলাচল করিতে পারে৷ (‘শিক্ষাবিধি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, ষোড়শ খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা– ১৫৪) তাই আমাদের মতোদেশে প্রথাগত শিক্ষার বিকল্প অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষা হতে পারে না৷ এটা বড়জোর প্রথাগত শিক্ষার পরিপূরক হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়৷
এ ছাড়া আরেকটি বিষয় যা ভাবা দরকার তা হল অনলাইন ও দূরায়ত শিক্ষার উপর অত্যাধিক গুরুত্বদেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার, প্রচলিত সরকারি ও সরকার পোষিত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার আর্থিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করবে এবং সাধারণভাবে একদিকে দারিদ্র, অন্য দিকে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যায়ন এর নামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেওয়া সহ বিভিন্ন ভ্রান্ত নীতির ফলে সরকার পোষিত স্কুলগুলোতে যে ভাবে ড্রপ আডট বাড়ছে, সেই অজুহাতে বহু স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেবে৷ যা প্রায় সমস্ত রাজ্যেই শত শত স্কুল কলেজ ইতিপূর্বে বন্ধ করেদেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে৷
আশার কথা সাধারণ মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন৷ প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে প্রাক্তন ও বর্তমান ডপাচার্য৷ সম্প্রতি প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ২০১৪ সালে ভারতরত্নে ভূষিত প্রফেসর সিএনআর রাও এক বার্তায় বলেন,”I am not enthusiast about online teaching. We need human interface with students for good communication. That is how young minds can be inspired”. (www.ndtv.com) বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর সুরঞ্জন দাস ডপাচার্যের এক আলোচনা চক্রে বলেন, “E-learning can complement but not replace direct teaching-learning process.” (ABP EDUCATION .COM)
এই করোনা–আবহ ও দেশজুড়ে লকডাউন এর মধ্যেও সরকারের ঢালাও অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার বিরুদ্ধে গত ২৩ মে অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি অনলাইন প্রতিবাদ দিবস পালন করেছে এবং ৩০ মে বহু স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, শিক্ষাব্রতি ও শিক্ষাবিদ সহ হাজার হাজার মানুষের স্বাক্ষরযুক্ত অনলাইন স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর নিকট পাঠানো হয়েছে৷ শিক্ষার মতো একটি বিষয় নিয়ে অহেতুক তাড়াহুড়ো না করে শিক্ষা বিষয়ক এই কমিটির বক্তব্য, সারা দেশের অন্যান্য শিক্ষক, ছাত্র সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা মাথায়রেখে বিরোধী দলগুলো পরিচালিত রাজ্য সরকারের বক্তব্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য৷ আশা করব সরকার সেই কর্তব্য পালন করবে।
সংবাদ সূত্র : Scroll.in/article/960939h)
দেবাশিস রায়, ধর্মতলা রোড, বেলুড় মঠ, হাওড়া