অনলাইন শিক্ষা আই টি ব্যবসার মরা গাঙে লাভ আনতেই?

কোভিড-১৯ মারণ ভাইরাসের প্রকোপে সমগ্র দেশ স্তব্ধ। স্বজনহারাদের কান্না, রোজগার হারানো, অর্ধাহার ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষের হাহাকারদেশের আকাশ বাতাসকে ভারি করে তুলেছে। লকডাউনের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত। দেশের এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সময়ে ১মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯’ দ্রুত কার্যকর করা এবং অনলাইন শিক্ষা ও নির্দিষ্ট চ্যানেলে ক্লাস ভিত্তিক পাঠের সম্প্রচার সহ নানা প্রযুক্তি প্রয়োগের পক্ষে সওয়াল করলেন। ‘প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯’ একটি বিতর্কিত নীতি। এই নীতির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ উঠে এসেছে। দেশের মানুষ তথা শিক্ষা মহলকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে লকডাউনের সময় একতরফা ভাবে বিলটি কার্যকরী করার সরকারি সিদ্ধান্ত কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। লকডাউনে দেশের মানুষের হাত-পা যখন প্রায় বাঁধা, যখন মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে ব্যস্ত, রোগের প্রকোপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম রসদ সংগ্রহ করা ছাড়া প্রায় আর কিছুই মানুষ ভাবতে পারছেন না, তখন জনগণের এই অসহয়তার সুযোগ নিয়ে নতুন শিক্ষানীতি, চাপিয়ে দেওয়া কতটা গণতান্ত্রিক তার বিচার জনগণ নিশ্চয় করবে। দ্বিতীয়ত লকডাউনের অজুহাতে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন অনলাইনের মাধ্যমে হওয়ার সিদ্ধান্তও সমর্থনযোগ্য নয়। বিগত দিনে ও বর্তমান সময়ে বারবার আমরা এই সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর পক্ষে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করা কোনও মতেই সম্ভব নয়– এ কথা জানা সত্তে্বও এই ব্যবস্থা চালু করে সরকার আসলে শিক্ষার ব্যবসায়ীকরনের নীতি, অর্থাৎ টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতিকেই কার্যকর করতে চাইছে। অনলাইন শিক্ষার জন্য অপরিহার্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ব্রডব্যান্ড কানেকশন প্রভৃতির ব্যবস্থা করা এদেশের গরিব নিম্নবিত্ত ছাত্র-ছাত্রীদের রয়েছে কিনা তা বিবেচনা না করে এই পদ্ধতি চালু করলে কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রী অচিরেই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। আবার ‘প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯’-এ অনলাইন শিক্ষার বিষয়টি জোরালো ভাবে আলোচিত হওয়ার জন্য সুকৌশলে দুটি নীতিকে একই সাথে কার্যকরী করতে তারা তৎপর। বর্তমান সময়ে যখন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা চরম সংকটের সম্মুখীন, চাকরি ও কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, যখন দেশের ৫০ কোটি মানুষ স্থায়ীভাবে কাজ হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে, তখন নতুন করে অনলাইন শিক্ষার পিছনে খরচ করা বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে সম্ভব নয় ফলে অচিরেই দেশের কোটি কোটি গরিব ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। অন্য দিকে যখন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা গুলি ধুঁকছে এবং কর্মী সংকোচন নীতি গ্রহণ করছে তখন এই পদ্ধতিতে সংস্থাগুলিকে বাড়তি অি’জেন যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চলেছে মালিক তোষণকারী বিজেপি সরকার। ইতিমধ্যেই আইটি সংস্থাগুলি অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বড় উদাহরণ, কলকাতার প্রাইম ইনফোর্সড। ধুঁকতে থাকা এই সংস্থাটি সরকারি সিদ্ধান্তকে লুফে নিয়ে ‘অনলাইন কোলাবরেশন’ এর নতুন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। ইতিমধ্যেই তারা বিড়লা গোষ্ঠীর সমস্ত স্কুল, রামমোহন মিশন, জিআইএস গোষ্ঠীর সমস্ত স্কুল, অ্যাডামাস ও টেকনো ইন্ডিয়ার স্কুলগুলির সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। অনলাইনে পঠন-পাঠন, পরীক্ষা দেওয়া, এমনকি ভর্তি হওয়া, ফি জমা দেওয়া বা লাইব্রেরির সুযোগ পাওয়া যাবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। প্রয়োজন শুধু টাকার। দেশে বড় ছোট অসংখ্য সংস্থা এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবসার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চাইছে।

পিছিয়ে নেই এডুটেক স্টার্টআপগুলিও। এদের সংখ্যা বর্তমানে দেশে সাড়ে চার হাজারের মতো। যাদের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। এদের ৪০ শতাংশই অনলাইন স্কুল শিক্ষা সাথে যুক্ত, যাদের ব্যবসার পরিমাণ বছরে প্রায় ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এডুটেক স্টার্ট আপ সংস্থাগুলি আশা করেছে, অচিরেই তাদের ব্যবসা শহরাঞ্চল থেকে আধা শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হবে এবং তাদের ব্যবসা প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে বৃদ্ধি পাবে কম্পিউটার ব্রডব্যান্ডের ব্যবহারের বাজার। কারণ মোবাইল ব্রডব্যান্ডের গতি কম থাকায় পঠন-পাঠন পদ্ধতির প্রয়োজনে অচিরেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকে ফি’ট ব্রডব্যান্ড ব্যবহার বাড়বে। প্রতিটি সংস্থা গড়ে প্রায় একশটি করে স্কুল ও কোচিং সেন্টারের সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে, যা তাদের অনলাইন ব্যবসাকে স্ফীত করতে সাহায্য করবে। আবার বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সরকার এদের দিয়েছে। মানুষকে মেরে দেশের শিল্পপতি তথা মালিকদের সমস্ত রকম সাহায্য করে বাঁচিয়ে রাখাটাই তো ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি। কথায় আছে, কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষ মাস। সরকারি নীতিতে কোটি কোটি মানুষ যখন রোজগার হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত তখন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করে তাদের ব্যবসার গাঙে লাভের বান আনতে সচেষ্ট।