নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাঙা চশমা’ গল্পে পড়েছিলাম এক মাস্টারমশাইয়ের কথা। যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ মহামারীতে দেশ উজাড় হয়ে গেছে তখন। ছাত্ররা সব যেন কে কোথায় উবে গেছে। স্কুলবাড়িটি দীর্ঘদিন ব্যবহার ও মেরামতের অভাবে ভাঙাচোরা অবস্থায়। হেডমাস্টারমশাই কিন্তু তাঁর ভাঙা চশমাটি চোখে দিয়ে রোজ সেই ভাঙাচোরা স্কুলবাড়িটিতে উপস্থিত হন। যেন সামনে ছাত্ররা বসে আছে এমন ভাবে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে লিখে তিনি প্রিপজিশন পড়ান। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁর সামনে ছাত্ররা আর নেই– এই বাস্তবতা তিনি মেনে নিতে পারেন না। বেশ কিছুদিন আগে এই সময়ের একটি অসাধারণ গল্প পড়েছিলাম। এক কৃতী গণিতজ্ঞ গণিতের এক বিশেষ গবেষণার জন্য পুরস্কৃত হচ্ছেন। পুরস্কার নিতে উঠে মঞ্চে বলে চললেন এক অঙ্কে ভয় পাওয়া ছাত্রের কথা, যার একটা অঙ্কও কখনও ঠিক হত না। গাধা, মাথামোটা, তার দ্বারা যে কিছুই কোনও দিন হওয়ার নয় এ কথা প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রতিপন্ন। এমন সময় শেষ চেষ্টার জন্য এলেন এক মাস্টারমশাই। রোগাসোগা, গোবেচারা মুখের ভাব, ঠিক স্যার বলে যেন মনেই হয় না। ঘটে গেল মিরাকেল। একফোঁটা বকাঝকা মারপিট কিছুই হল না, কিন্তু ওই ‘কিছুই হওয়ার নয়’ ছেলেটার মাথায় চেপে বসল অঙ্কের রোখ। পরবর্তী সময়ে সেই ছেলেটিই হয়ে উঠলেন গবেষক, গণিতজ্ঞ।
শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের এমন আরও অনেক চোখে জল আনা কাহিনি সাহিত্য ধরে রেখেছে পাতায় পাতায়। বর্তমানে নানা কারণে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের এই রসায়নটি বিপর্যস্ত। তার কারণ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। সে যাই হোক, সাম্প্রতিক সময়ে এ রাজ্যের স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা যে নজির সৃষ্টি করল, তা যেন ইতিহাসের পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা এক টুকরো বর্তমান। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের হারিয়ে যাওয়া ভিতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হল ছাত্র-ছাত্রীরাই। কর্মহারা যোগ্য শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা আওয়াজ তুলল ‘আমরা আমাদের শিক্ষকদের পাশে আছি’, ধিক্কার জানাল পুলিশি বর্বরতাকে। অভিভূত, আপ্লুত শিক্ষক ও নাগরিক সমাজ।
শিক্ষা দফতর ঘেরাও কর্মসূচিতে আন্দোলনরত চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের ওপর ব্যাপক পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ১৮ মে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় স্কুলছাত্ররা একত্রিত হয়েছিল। যা দেখে চোখে জল এসে যায় আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। তাঁরা বলেন, আমরা আন্দোলনের ময়দানে থেকেছি, কিন্তু আমরা চাইনি আমাদের ছেলেমেয়েরা এর মধ্যে এসে পড়ুক। আমরা ওদের ডাকিনি। ওরা যে কী ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল আমরা জানি না। কিন্তু ওদের দেখে আজ আমরা আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। বাবা মায়েদের সংকটে সন্তানরা পাশে এসে দাঁড়ালে কার না ভাল লাগে। করুণাময়ীর রাস্তাটা যেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করছিলেন শিক্ষকরা, সেদিন কিছুক্ষণের জন্য যেন সত্যিই হয়ে দাঁড়াল ক্লাসরুম। শিক্ষকরা ক্লাস নিলেন, গল্প বলার আসর তৈরি করলেন, ছাত্রছাত্রীরা পরিবেশন করল প্রতিবাদী গান কবিতা। রাজ্যের প্রতিটি জেলায় মিছিল অবস্থান করল ছাত্রছাত্রীরা। কলকাতার নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘তোমরা কেন রাস্তায়’? উত্তর করল, ‘আমাদের স্কুলের তিনজন স্যার-ম্যাম রাস্তায় আছেন। এমনিতেই ভাল করে ক্লাস হয় না, টিচার নেই, তার ওপর এই তিনজন স্যার-ম্যামও আর আসবেন না। সমস্যা তো হচ্ছে আমাদের পড়াশুনায়। আমরা প্রতিবাদ না করলে চলবে’? কলকাতার রাসবিহারী এলাকা থেকে মিছিলে সামিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলাম ‘মিছিল করছ, ভয় করছে না’? উত্তর দিল ‘আমার বাবা-মা’কে যদি কেউ নির্যাতন করে আমি কি চুপ করে বসে থাকব? টিচাররা আমাদের বাবা-মার মতোই। তাঁদের ওপর অত্যাচার মানতে পারছি না।’ বর্ধমানের একাদশের ছাত্রীর কথায়–‘ছোট থেকে আমি শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। আমার এক শিক্ষকের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। শিক্ষকদের এ ভাবে রাস্তায় মার খেতে দেখাটা আমার কাছে বড়ো ধাক্কা। এ মেনে নেওয়া যায় না।’ হুগলির ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র বলছে ‘যে পুলিশরা মারল তারাও তো টিচারদের কাছে পড়াশোনা করে তবে পুলিশ হয়েছে। এটা তারা কী করে করতে পারল’?
অন্য সমস্ত প্রতিবাদের মতোই শিক্ষকদের প্রতিবাদকেও দমন করার চেষ্টা করেছে সরকার। তাতে ঝড়ের গতি আরও তীব্র হয়েছে। ভবিষ্যৎ নাগরিক যারা, তাদের ভিতরই সহস্র প্রশ্নের ঝড়। যে প্রশ্নকে চাপা দিতে চায় সরকার, সেই প্রশ্নই যদি রাজ্যের আনাচে কানাচে প্রতিধ্বনিত করে স্কুল ছাত্রছাত্রীরা তা হলে তা শাসকের পক্ষে বিপদের কথা। তাই স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কেন রাস্তায়, কেন মিছিলে, এ প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন এ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস তো অন্য কথা বলে! ইতিহাস বলে, যে কোনও দেশে যে কোনও কালে যখনই কোনও সংকট এসেছে, শিশুরা কিশোররা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ‘বেত মেরে তুই মা ভোলাবি, আমরা কি মার সেই ছেলে’? ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৪ বছরের সুশীল সেনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। লেখা আছে শান্তি, সুনীতির নাম। ক্ষুদিরাম বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিং-রা তাঁদের স্কুল জীবন থেকেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নিজেদের শাণিত করেছেন। প্রতিবেশী বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীতে ছোট বড় অজস্র আন্দোলনে শিশু-কিশোররা সামনের সারিতে থেকেছে। কিছুদিন আগে সে দেশের সড়ক আন্দোলনের কথা আমাদের সকলের মনে আছে। ছোট একটি ছেলে একটি আর্ট পেপারে অপটু হস্তাক্ষরে লিখে এনেছিল ‘আম্মুর নির্দেশ বুকে গুলি না নিয়ে যেন বাসায় না ফিরি’। আপাত অর্থে মনে হতে পারে এ নিষ্ঠুরতা। কিন্তু গভীরে গিয়ে বিচার করলে, কোন জ্বালা থেকে এ কথা উঠে আসে তা অনুভব করা যাবে। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকান কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে সোভিয়েট রাশিয়ার বীরত্বপূর্ণ লড়াই–সবখানেই শিশু-কিশোরদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। দারিদ্রের দুর্বিষহ চাপে কত শিশু-কিশোরকে স্কুলের চৌহদ্দি ছেড়ে ভিড়তে হচ্ছে ইটভাটায় বা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে, কত শিশু যে পাচার হয়ে গেল, তার হিসেবই বা রাখছে কে? শিশু-কিশোরদের রাস্তায় নামা নিয়ে যাঁরা ভীষণভাবে চিন্তিত, কই এ বিষয়ে তাঁদের তো খুব কথা বলতে শুনি না। সরকারি স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যে শিশুদের অশিক্ষার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে, এ নিয়ে সত্যি সত্যিই মাথাব্যাথা তো দেখি না কারও। যে শিশু সুরক্ষা কমিশন শিশুদের নিয়ে এত উদ্বিগ্ন তাদের একটা শব্দও কি শোনা যায় এগুলি নিয়ে? তবে তাদের উদ্বেগটা ঠিক কোথায়? ভয়টা ঠিক কোনখানে?
প্রশ্ন তোলা শিশু-কিশোররা আগামীর নাগরিক। শাসক শ্রেণি প্রশ্নহীন আনুগত্য চায়। প্রশ্ন তোলা নাগরিক তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই শিশু কিশোরদের মানবিকতার অজুহাত খাড়া করে আপন গৃহসীমার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হোক– এই তাদের একান্ত বাসনা। রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন সরকারের তাঁবেদারি করে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে চাইতেই পারে, কিন্তু ইতিহাস তাদের নির্ধারিত পথে চলে না। আজকের শিশু-কিশোররা শিক্ষকদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে নতুন পথে চলা শুরু করেছে। একে থামিয়ে দেয় এমন সাধ্য কারও নেই।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত