বিশ্বজুড়েই অনলাইনে কেনাকাটা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মোবাইলের একটা ক্লিকে কত সহজেই নানা জিনিসের অর্ডার দেওয়া যায় অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্ট, ওয়ালমার্ট, স্ন্যাপডিল, জিও মার্টের মতো কোনও অনলাইন কোম্পানিকে। অনলাইন শপিং এখন এমনকি মধ্যবিত্তেরও হাতের নাগালে। অর্ডারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘরের দোরগোড়ায় হাজির বাহক। এত দ্রুত জিনিসটি পৌঁছনোর পেছনে এক একজন শ্রমিকের কী পরিমাণ ঘাম-রক্ত যুক্ত হয়ে আছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিক তা আদৌ ভাবে না! গ্রাহকরাও কি ভাবেন এরকম কত শ্রমিকের শ্রম লুট করে মালিকের মুনাফা আকাশচুম্বী হচ্ছে?
যে কর্মীরা স্বল্প বেতনে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ১০-১২ ঘণ্টা একটানা অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়, তারাই আসলে এই কোম্পানিগুলির ‘লাইফ-লাইন’। হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম ছাড়া মালিকরা কি পারবে ১৪-১৫টি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের এক একটা গুদামের বিভিন্ন কাজ সামলাতে? এমনকি এ আই-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও মানুষের জীবন্ত শ্রমের সমান সৃজনশীল কাজ করতে পারে, এমন নমুনা নেই।
আমেরিকার মিনেসোটায় বা ভারতের মানেসরে অ্যামাজন কিংবা অন্য কোনও অনলাইন সংস্থার কর্মীদের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা আলাদা কিছু নয়। আরও বেশি লাভ করার জন্য মালিকরা কর্মচারীদের সাথে কতটা অমানবিক আচরণ করে, জুলুম চালিয়ে তাদের শ্রমশক্তি নিংড়ে নেয়, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এখানকার শ্রমিকরা। সে জন্যই অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোস ২১৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার মুঠোয় পুরে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ হতে পারেন!
আমেরিকায় অ্যামাজনে প্রথম চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর এক কর্মী কাজ করতে গিয়ে দেখেন, প্রতিদিন ১০ ঘণ্টার বেশি একটানা দাঁড়িয়ে প্যাকেজিং করতে হবে। প্রত্যেক কর্মীর কাজের প্রতিটি মুহূর্ত এবং কাজের হার রেকর্ড করবে সংস্থার কম্পিউটার। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিদিনের দক্ষতার উপর ও সংস্থার চাহিদা মেটানোর উপর নির্ভর করবে প্রতিটি কর্মীর পরের দিন কাজ থাকা না থাকার বিষয়টি। তা সত্ত্বেও কেউ আর্থিক দুরবস্থার কারণে, কেউ প্রবাসী হওয়ায় কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। কর্তৃপক্ষ জানে– কর্মীদের যথেচ্ছ ভাবে লুটে নিলেও তারা অভিযোগ জানাতে সাহস পাবে না, কোনও অধিকারের দাবি জানাতে পারবে না। সাহায্য করার জন্য তারা পাশে পাবে না কাউকে। ফলে কর্তৃপক্ষ সহজেই কর্মীদের বেগার খাটাতে পারে।
এরকমই বড় বড় গুদামে হাজারের বেশি কর্মচারী কাজ করেন। কোম্পানি যাদের স্থায়ী কর্মী হিসেবে নিয়োগ করে, তাদের কাজের জায়গায় থাকে কনভেয়র বেল্ট, বিন ইত্যাদি। কনভেয়র বেল্টের মাধ্যমে রকমারি জিনিসে ভরা বাক্স এলে সেখান থেকে নিয়ে নির্দিষ্ট পাত্রে সেগুলি রাখা ওই কর্মীদের কাজ। এরপর পাত্রগুলি ভরে গেলে রোবট এসে সেই পাত্রগুলি নিয়ে গিয়ে নতুন পাত্র হাজির করে। কর্মীদের দ্রুত লোড ও আনলোডের কাজ শিখে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে তা করতে হয়। একটানা এই কাজে তাদের শৌচাগারে যাওয়া, জল খাওয়ার জন্যও আলাদা কোনও সময় দেওয়া হয় না। গেলে কাজের সময় থেকে কেটে নেওয়া হয়। শ্রমিক-শোষণের ‘স্বর্গরাজ্য’ এই সংস্থাগুলি।
প্রতি সপ্তাহে, প্রতিদিন, প্রতিটি মিনিটে কর্মীদের কাজের দেখভাল করে কোম্পানি। কত দ্রুত কর্মীরা প্রতিটি জিনিস আলাদা করতে পারে কিংবা কত দ্রুত তারা গ্রাহকের দেওয়া অর্ডার গন্তব্যে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে পারে, তার উপর নির্ভর করে কর্মীদের দক্ষতার বিষয়টি। এক সপ্তাহ পরে সুপারভাইজাররা কর্মীদের জানিয়ে দেয়– হয় তাদের কাজের গতি বাড়াতে হবে, না হলে কাজ চলে যাবে। অন্য কারও সাহায্য ছাড়া যে কাজের গতি বাড়ানো সম্ভব নয়, কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে তা কাউকে বলতেও পারেন না কর্মীরা। কাজ না-পসন্দ হলে স্থায়ী কর্মীদের অস্থায়ী করে কর্তৃপক্ষ তাদের উপর কাজের চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। বহু সময়েই ক্লান্ত, অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যেতে বাধ্য হন কর্মীরা।
প্রচণ্ড টেনশন ও চাপের কারণে কর্মীরা রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারেন না। যন্ত্রণাদায়ক ও নিদ্রাহীন এক একটা সপ্তাহ কাটানোর পর কাজ ভাল হচ্ছে না, এই কারণ দেখিয়ে কোনও কর্মীকে ছাঁটাইয়ের হুমকি চিঠি দেন সুপারভাইজার। স্বভাবতই কর্মীরা শুধু শারীরিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। আরও দু’বার এরকম হুমকি চিঠি দেওয়ার পর ছাঁটাইয়ের নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হয় কর্মীদের।
সোমালিয়া সহ আফ্রিকার নানা দেশ থেকে অসংখ্য গরিব মানুষ এই কোম্পানিগুলিতে কাজ করতে আসেন। কাজের চাপের সাথে সাথে তাদের উপরিপাওনা জোটে– বর্ণবিদ্বেষী বিদ্রুপ এবং ভাষা না বোঝার কারণে গালাগালি।
অমানুষিক কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে দু-আড়াই বছর পর অনেকেই কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কর্মীদের সাথে অত্যন্ত অমানবিক আচরণ করে মালিকপক্ষ। তাদের দৃষ্টিতে কর্মীরা যেন এক একটা রোবট। মুনাফা আরও বাড়ানোর জন্য অ্যামাজন-কর্তৃপক্ষ কর্মীদের অযৌক্তিক কোটা করে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ আদায়ের চেষ্টা করে। ফলে কর্মীদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কর্তৃপক্ষ তাতে ভ্রূক্ষেপ করে না। কারণ বেকার সমস্যা এত তীব্র এবং কাজের বাজারের যে দুঃসহ অবস্থা, তাতে একদলকে কাজ থেকে ছাঁটাই করলে আর একদলকে অনায়াসেই কর্মী হিসাবে পেয়ে যায় সংস্থাগুলি।
দেশে দেশে সরকারের শ্রম দপ্তর রয়েছে, রয়েছে শ্রম আইন। রয়েছে শ্রম দপ্তরের বেশ কিছু মন্ত্রী। কিন্তু এই কর্মীদের স্বার্থে কেউই এগিয়ে আসেনি। আসলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কোনও শ্রম-নীতি শ্রমিক স্বার্থে নয়, সবটাই মালিকদের স্বার্থরক্ষায়। ফলে সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থায় শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। তাদের শ্রমের ন্যূনতম মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না, বলি দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকের অধিকারকে। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে প্রতিটি কলে-কারখানায় মালিকের মুনাফা লালসার বলি হচ্ছে শ্রমিকের শ্রম। নির্বিচারে শ্রমিক-শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে মালিকরা। তাতে সহায়তা করছে ক্ষমতায় আসীন সরকারগুলি। এই পরিস্থিতি তীব্র শ্রমিক বিক্ষোভের জন্ম না দিয়ে পারে না। বিশ্বের দেশে দেশে এবং ভারতেও অনলাইন কোম্পানির কর্মীদের এই বিক্ষোভ লক্ষ করা যাচ্ছে।