২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের এক বিস্ফোরক রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সংস্থা অক্সফ্যামের। রিপোর্ট দেখিয়েছে, গত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে লকডাউন জারি করার পর অর্থনৈতিক কাজকর্ম অনেকটাই স্থবির হয়ে গেলেও ভারতের প্রথম ১০০ জন পুঁজিপতির সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ এদের মাথাপিছু গড় সম্পদবৃদ্ধির পরিমাণ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অতি ঘনিষ্ঠ ধনকুবের রিলায়েন্সের কর্ণধার মুকেশ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা।
এটাকে যদি ভারতীয় অর্থনীতির উজ্জ্বল দিক ধরা হয়, তবে অন্ধকারের দিকটি হল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সীমাহীন দারিদ্র, অনাহার, অপুষ্টি। রিপোর্ট দেখিয়েছে, দেশের গরিবদের ২৪ শতাংশের রোজগার মাসে তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ, দৈনিক রোজগার ১০০ টাকা, যা দিয়ে চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির বাজারে চারজনের একটা পরিবারের একবেলার ভরপেট নিরামিষ খাবারটুকুই জুটবে না। শুধু গরিবদের ২৪ শতাংশই নয়, পুরো গরিব অংশ, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত অংশের অর্থনৈতিক অবস্থাও যে সংকটজনক, সেটা তো ধারাবাহিক মন্দাই দেখিয়ে দিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দফায় দফায় কোটি কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ পুঁজিপতিদের দিলেও যে শিল্পে প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে না সেটাই দেখিয়ে দেয় জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বা রোজগার কত তলানিতে।
কেন এই বৈপরীত্য? কেন এই উৎকট ধনবৈষম্য? পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যম এর দায় করোনা সংক্রমণের জন্য ঘোষিত লকডাউনের উপর চাপিয়েছে। কিন্তু তথ্য বলছে, করোনার বহু আগে থেকেই চলছে এই পরিস্থিতি ২০০৯ সালের পর থেকে এ দেশে ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়েছে ৯০ শতাংশ। জনগণের আয় নেমেছে তলানিতে।
শুধু ভারতেই এ চিত্র নয়, বিশ্বজুড়েই সব পুঁজিবাদী দেশেই একই অবস্থা। অক্সফ্যাম দেখিয়েছে, এই করোনা কালে বিশ্বে ৫০০ জন ধনীতম পুঁজিপতির সম্পদ বেড়েছে ৮০৯ বিলিয়ন ডলার। আর তার ধাক্কায় এই সময়ে ১০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ কোটি মানুষ প্রবল দারিদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে। এই ধনবৈষম্য গোটা বিশ্বেই ভারসাম্যের সঙ্কট তৈরি করছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানা আন্দোলনে।
এই বৈষম্যের আরেকটি দিক লক্ষণীয়। অক্সফ্যাম দেখিয়েছে বিশ্বে পুঁজিপতিদের গড় সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ১৯ শতাংশ হলেও ভারতীয় পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোদি সরকার ঢেলে পুঁজিপতিদের ত্রাণ প্যাকেজ দিয়ে তাদের সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে দিয়েছে শ্রমিক শোষণের বাড়তি সুযোগ। শ্রমিকদের বেতন হ্রাস, কাজের ঘন্টা বাড়ানো, শ্রমিকদের প্রাপ্য আত্মসাৎ করে এই সম্পদের পাহাড় তারা গড়েছে। শ্রম আইন মালিকদের স্বার্থে এমনভাবে পাল্টানো হয়েছে যাতে তাদের মুনাফার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়। তাতে শ্রমিক সর্বস্বান্ত হলেও কোনও পরোয়া নেই। এই পুঁজিপতিদের মুনাফা আরও বৃদ্ধির রাস্তা করে দিতে কৃষি আইনকে পাল্টেছে মোদি সরকার। কোটি কোটি কৃষক শ্রমিককে নিঃস্ব করে এভাবেই একচেটিয়া মালিকরা মুনাফার প্রেত নৃত্য করছে। এ জিনিস সচেতন মানুষ মানতে পারে না। অশিক্ষায় বা বিভ্রান্তির মোহে আচ্ছন্ন কিছু মানুষ সাময়িক এই ধনবৈষম্য মানলেও চিরকাল যে মানবে না– দেশের নানা প্রান্তে বেড়ে চলা বিক্ষোভ তা দেখিয়ে দিচ্ছে।
কিছু বুদ্ধিজীবী বলছে ধনের সমবণ্টন করলেই সমস্যা মিটবে। কিন্তু তা কি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্ভব? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকার পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় দায়বদ্ধ। সম্পদের সমবন্টনের দায়বদ্ধতা সে পালন করতেই পারে না। এখানেই পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতা। তাই প্রয়োজন শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের রাজ কায়েম করা। না হলে এই ধনবৈষম্যের থেকে বাঁচার পথ নেই।
অক্সফ্যাম রিপোর্ট প্রকাশের দিন থেকেই কেন্দ্রের মোদি সরকার কৃষক আন্দোলনকে ‘বদনাম দিতে’ জাতীয় লজ্জা, জাতীয় অবমাননা– এইসব কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু জাতি বলতে যদি মানুষ বোঝায় তাহলে অক্সফ্যাম যে উৎকট অসহ্য ধনবৈষম্য তুলে ধরেছে সেটাই প্রকৃত অর্থে জাতীয় লজ্জা। মানুষ তা থেকে বাঁচতে চাইছে, আন্দোলনের মশাল জ্বালাচ্ছে, এটাই তো গৌরবের।