
আর জি কর হাসপাতালের মতো সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রই শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলিও যে এখন শাসক তৃণমূলের লুঠেরা চক্রের ঘুঘুর বাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজে সাম্প্রতিক ছাত্রী-ধর্ষণের ঘটনা তা একেবারে প্রকাশ্যে এনে দিল। আর জি করে চিকিৎসক-ছাত্রীর ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের এক বছরও পার হয়নি। এরই মধ্যে কলকাতা শহরের বুকে একটি আইন কলেজে ছাত্রীধর্ষণের আরও একটি ভয়ানক ঘটনা দেখিয়ে দিয়ে গেল, শাসক দলের অভয়হস্ত মাথার উপর থাকলে যে কোনও ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়ার ভরসা থাকে, কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের পায়ে উপযুক্ত প্রণামী নিবেদন করতে পারলেই হল। শুধু তাই নয়, এ ঘটনায় প্রমাণ হয়ে গেল, রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দাঁড়িয়েই রয়েছে দুষ্কৃতীদের দাপটের উপর ভর করে।
দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজের নির্যাতিতার বয়ানে সে দিনের ঘটনার যে বিবরণ বেরিয়ে এসেছে, বাস্তবেই তা হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। গত ২৫ জুন কলেজের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রীকে সন্ধ্যার পরেও ইউনিয়ন রুমে কিছুক্ষণ থেকে যেতে বলে ওই কলেজেরই টিএমসিপি নেতা ও চুক্তি-কর্মী মনোজিৎ মিশ্র– গোটা কলেজে যার অবিসংবাদী দাপট। এরপর তার দুই স্যাঙাৎ জাইব আহমেদ ও প্রমিত মুখার্জীর সহযোগিতায় বন্ধ ইউনিয়ন রুমে মেয়েটিকে হেনস্থা করে মনোজিৎ। আক্রান্ত মেয়েটি আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে ইউনিয়ন রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে জোর করে পাশের গার্ড রুমে ঢোকানো হয়। সেখানে যৌন নিগ্রহে বাধা দিলে তাকে হকিস্টিক দিয়ে মারা হয়। এরপর প্রায় অচৈতন্য মেয়েটিকে বাকি দু’জনের উপস্থিতিতে ধর্ষণ করে মনোজিৎ। পুরো ঘটনা মোবাইলে ভিডিও করা হয় এবং ঘটনা জানাজানি হলে মেয়েটির প্রেমিক ও মা-বাবাকে খুন করার এবং ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় মনোজিৎ।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র সম্পর্কে যা জানা গেছে তা চমকে দেওয়ার মতো। দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজ সহ কলকাতা শহরের আইন কলেজগুলিতে ছাত্র ভর্তির বিনিময়ে বিপুল টাকা লুটের যে চক্র, মনোজিৎ তার মাথা। নানা কারচুপি করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে যোগ্যতামান নেই এমন ছাত্রদের নাম মেধাতালিকায় তুলে আনত সে। বলা বাহুল্য, প্রতি বছর ভর্তি-দুর্নীতির মাধ্যমে এই বিপুল টাকা তোলার পিছনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের অভয়হস্ত মনোজিতের নিরাপত্তা বলয়ের কাজ করত। এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমে তৃণমূল বিধায়ক অশোক দেবের নাম উঠে এসেছে। বুঝতে অসুবিধা নেই, শুধু উনিই নন, শাসক দলের আরও সব তাবড় নেতাও এর সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের ছাত্ররাই জানিয়েছেন, ভর্তির নামে তোলা এই বিপুল টাকার ভাগ তৃণমূলের ভিতরে বহু দূর পর্যন্ত পৌঁছয়। এই টাকার বখরা পেতে শাসক দলের কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে রীতিমতো রেষারেষির কথাও উঠে এসেছে। ঠিক সেই কারণেই আইন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ প্রশাসন ও শাসক দলের নানা স্তরে বার বার অভিযোগ জানালেও কোনও কাজ হয়নি।
শুধু ভর্তির নামে টাকা তোলাই নয়, দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়েও মনোজিতের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে কলেজ ও অন্য সূত্র থেকে বিপুল টাকা উঠলেও তার কোনও হিসেব কলেজের কাছে নেই, পুরোটাই মনোজিৎ ও তার দলবলের মুঠোয়।
বোধহয় এ হেন টাকা লুটের সর্দারকে যোগ্য সম্মান দিতে এবং লুটের কারবার যাতে অবাধে ও স্থায়ী ভাবে চলতে পারে, সে জন্য ওই কলেজেই মনোজিৎকে চুক্তিভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তৃণমূল কর্তারা। অথচ কালীঘাটের বাসিন্দা মনোজিতের নামে সেই ২০১৩ সাল থেকেই পুলিশের কাছে অভিযোগের পর অভিযোগ দায়ের হয়ে এসেছে। কখনও কারও বুকে ছুরির কোপ বসানো, কখনও কলেজে ভাঙচুর, এমনকি সাম্প্রতিক ঘটনাটির মতোই, ২০২২ সালে ওই কলেজেই প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগে এফআইআর হয়েছে মনোজিতের নামে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে টাকা হাতানো, হুমকি, নিগ্রহ, র্যাগিংয়ের মতো আরও অসংখ্য অভিযোগ আছে। যদিও এতকিছু সত্ত্বেও এতদিন পর্যন্ত পুলিশ মনোজিতের বিষয়ে চোখ বন্ধ করেই ছিল এবং তা যে শাসক দলের নেতাদের নির্দেশেই, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত নানা পোস্ট থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের তাবড় নেতাদের সঙ্গে মনোজিতের ঘনিষ্ঠতার যে ছবি বেরিয়ে এসেছে, সম্ভবত তারই জোরে, শুধু ওই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের উপরেই নয়, কলেজ পরিচালন সমিতি, এমনকি স্বয়ং অধ্যক্ষের উপরেও তার হুকুম চলত। অধ্যাপকদের ক্লাসের রুটিনও নাকি ঠিক হত তার কথাতেই।
নেতাদের প্রশ্রয়ে এ হেন দাদাগিরির সুযোগ নিয়ে মনোজিতের মতো একজন দুষ্কৃতী যে যা-খুশি করার স্পর্ধা দেখাবে– সেটাই স্বাভাবিক। তাই কলেজে ফাঁকা পড়ে থাকা গার্ডরুমে নিজের বিলাসকক্ষ সাজিয়ে নিয়ে প্রায়ই সেখানে মদ্যপান সহ বেলাগাম হৈ-হুল্লোড়ের আসর বসাত মনোজিৎ। অধ্যক্ষের কাছে নাকি খবর ছিল না! বোঝা কঠিন নয়, খবর থাকলেও উপরমহলের চাপে তাঁর বিশেষ কিছু করার ছিল না।
প্রশ্ন উঠেছে, এই নৃশংস ঘটনার সম্পূর্ণ দায় কি একা মনোজিৎ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদেরই! শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের যে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা এতদিন ধরে লুটের বখরায় খুশি হয়ে মনোজিতদের মতো জঘন্য দুষ্কৃতীদের পিঠ চাপড়ে এলেন, গ্রেফতারি ও বিচারের হাত থেকে তাদের আড়াল করে গেলেন, এই ধর্ষণের দায় তাঁদের উপরেও বর্তাবে না কেন? যে মানুষগুলির ভোটে জিতে তাঁরা মন্ত্রী-বিধায়ক হয়েছেন, তাঁদেরই একজনের পরিবার থেকে কলেজে পড়তে আসা কন্যাটিকে আজ চরম নির্যাতিত হতে হল ওই নেতাদের দলেরই কুখ্যাত দুষ্কৃতীর হাতে!
শাসক দলের প্রশ্রয়ে দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তের ঘটনা তৃণমূল শাসনেই প্রথম, এমন নয়। আগের সিপিএম-ফ্রন্ট সরকার এ বিষয়ে অসাধারণ সব উদাহরণ রেখে গেছে। বাস্তবে পুলিশ ও প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করা এবং শাসক দলের নানা স্তরের নেতা ও অনুগামী দুর্বৃত্তদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এমনকি পাড়ায় পাড়ায় প্রতিটি পরিবারের উপর প্রবল দাপট প্রদর্শন ও দাদাগিরিতে অতিষ্ঠ হয়েই রাজ্যের মানুষ সিপিএম সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছিল। রাজ্যের সরকারে বসে তৃণমূল কংগ্রেস তা থেকে শিক্ষা নেওয়া দূরস্থান, পূর্বসূরীর দেখিয়ে যাওয়া পথেই হাঁটতে শুরু করে। আজ সর্বস্তরে তাদের নেতাদের দুর্নীতি, দাপটের রাজনীতি ও দুষ্কৃতী-নির্ভরতা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। এই অবস্থায় অভিযোগ দায়েরের পরে পরেই দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতীরা যে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে, তা আশার কথা। কিন্তু রাজ্যের মানুষ জানেন, শুধু এই গ্রেফতারি অপরাধীদের শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না। আসল খেলা শুরু হয় এর পরে। আর জি করের ঘটনা তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ইতিমধ্যেই পুলিশ নির্যাতিতার বয়ান বলে যা জমা দিয়েছে, সেখানে পুরো নামের বদলে অভিযুক্তদের যে সাঙ্কেতিক নামে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলিকেও অদল-বদল করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে উপরমহলের নির্দেশে এরই মধ্যে কি প্রভাবশালী মনোজিৎ মিশ্রকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে পুলিশ!
রাজ্যের প্রতিবাদী মানুষের তাই আজ সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। ইতিমধ্যেই শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদে দলে দলে রাস্তায় নেমে সোচ্চার হয়েছেন মানুষ। প্রতিবাদের এই স্রোত থামতে দিলে চলবে না।
শুধু গ্রেফতারি নয়, শাসক দলের কর্তাদের অঙ্গুলিনির্দেশে ন্যায়বিচারের জাল কেটে অপরাধীরা যাতে কোনও মতেই বেরিয়ে আসতে না পারে, সে দিকে কড়া নজর রাখতে হবে রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই। না হলে বিপন্ন হবে প্রতিটি পরিবারের কন্যাদের নিরাপত্তা– হাসপাতাল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়– এতদিন ধরে যেগুলিকে সুরক্ষিত স্থান বলে ধরে নেওয়া হত তার যে কোনও একটিতে, যে কোনও মুহূর্তে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এ সর্বনাশ রুখতেই হবে। মনে রাখতে হবে, সুস্থ রাজনীতি ছাত্র-যুবদের সুস্থ মানুষ হতে শেখায়, আর দুষ্ট রাজনীতি তাদের নীতিহীন অমানুষ করে তোলে। তৃণমূল সহ ভোটসর্বস্ব নীতিহীন শাসক দলগুলির এই ঘৃণ্য রাজনীতিকে পরাস্ত করে সুস্থ রাজনীতি যতদিন না সমাজে জায়গা নিতে পারছে, ততদিন এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাই এমন ঘটনার প্রতিবাদের পাশাপাশি সুস্থ রাজনীতিকে শক্তিশালী করাও প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ৪ – ১০ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত