
জেন এক্স, জেন ওয়াই, জেন জেড এইসব শব্দবন্ধগুলির সঙ্গে এখন প্রায় সকলেই পরিচিত। কম্পিউটার পরিচালিত আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে কথাগুলো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কখনও শুনেছেন কি ‘হ্যান্ডকাফড জেনারেশন’ বা হাতকড়া-বাঁধা প্রজন্ম? ঠিক এই বলেই অভিহিত করা হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রজন্মকে। করছে সে দেশেরই সংবাদমাধ্যম। কেননা, বেকারি ও প্রচণ্ড মূল্যবৃদ্ধির আক্রমণে, জীবনধারণের খরচ সামলাতে না পেরে সে দেশের তরুণ প্রজন্ম একদিকে বেহিসেবি ঋণ নিচ্ছে কিন্তু শোধ করার ক্ষমতা নেই। একটা বড় অংশ আবার পার্শ্ববর্তী কাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ছড়ানো আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ চক্রে যুক্ত হয়ে পড়ছে, অচিরেই সে সব দেশের পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে এবং ঠাঁই হচ্ছে জেলখানায়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দীর্ঘদিনের আশীর্বাদপুষ্ট এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হল দক্ষিণ কোরিয়া। মার্কিন হুমকির কাছে মাথা না নোয়ানো উত্তর কোরিয়াকে চাপে রাখার জন্য দীর্ঘকাল ধরে কোটি কোটি ডলার ঢেলে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি ও সমাজকে নিজের ধাঁচেই গড়ে তুলেছে আমেরিকা। আর বুর্জোয়া মিডিয়ায় অহরহ প্রচারের ঢাক বাজানো হয় যে, উত্তর কোরিয়ার জনগণ চরম দারিদ্র, গণতন্ত্রহীনতা এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ‘নিষ্ঠুর, অত্যাচারী’ শাসনে আর্তনাদ করছে। কোনও কথা বলারই তাদের নাকি অধিকার নেই। অথচ পাশেই দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির কল্যাণে বিরাট সমৃদ্ধ, উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগেও মার্কিন পুঁজিতে উৎপন্ন ‘মেড ইন সাউথ কোরিয়া’ ছাপমারা বিভিন্ন রকম ভোগ্যপণ্যের বাজার ছেয়ে ছিল বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে উঠে আসা চিন সেই বাজার থেকে হটিয়ে দিয়েছে আমেরিকাকে। প্রতিনিয়ত মুমূর্ষু মার্কিন পুঁজির আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কণ্ঠে। স্বাভাবিকভাবেই ভয়ঙ্কর সংকট ঘনিয়ে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে। ‘দি কোরিয়া হেরাল্ড’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বর্তমান দক্ষিণ কোরীয় যুবসমাজের করুণ দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদক বলছেন যে, ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারি এখন দক্ষিণ কোরিয়াকে গ্রাস করেছে। জীবনযাপনের খরচ মেটাতে গিয়ে যুবসমাজ বাধ্য হচ্ছে প্রচুর ধার করতে। কিন্তু সেই ধার তারা শোধ দেবে কোথা থেকে? ফলে যুবসমাজের একটা বড় অংশ যুক্ত হয়ে পড়ছে অপরাধচক্রে। বিগত টানা সতেরো মাস ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মসংস্থানের হার কমেছে ৪৫.১ শতাংশ। ভারতের মতোই বড় শিল্পে স্থায়ী ন্যায্য বেতনের চাকরি প্রায় নেই। যতটুকু কাজ আছে সবই অত্যন্ত স্বল্প বেতনের চুক্তিভিত্তিক কাজ। এ দিকে আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির ফলে জীবনযাপনের খরচ সে দেশে খুবই বেশি। ৬০ হাজারেরও বেশি তরুণ নাগরিক ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করতে না পারায় ঋণখেলাপির অপরাধে অভিযুক্ত। এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ জুড়ে জাল পেতে থাকা আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধচক্র ফাঁদে ফেলছে বেকার দক্ষিণ কোরীয় যুবকদের। লোভনীয় চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে একবার দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে বাস্তবে তারা এদের কাজে লাগাচ্ছে নানা ধরনের সাইবার অপরাধে। অস্বীকার করলে ক্রীতদাসদের মতো তাদের নির্মমভাবে মারধোর করা হচ্ছে, ইলেকট্রিক শক দিয়ে অত্যাচার করা হচ্ছে এমনকি, প্রাচীন ক্রীতদাস প্রথার মতো এক মালিক অন্য মালিকের কাছে কর্মচারীদের বিক্রিও করে দিচ্ছে।
এ দিকে মালিকের নির্দেশমতো অনলাইন জালিয়াতি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়েছে বিদেশি পুলিশের হাতে। সম্প্রতি সাইবার অপরাধে অভিযুক্ত এইরকম ৬৪ জন দক্ষিণ কোরীয় যুবককে কাম্বোডীয় সরকার গ্রেপ্তার করে হাতকড়া লাগিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোয় দক্ষিণ কোরিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এই হতভাগ্য যুবকদের ‘হ্যান্ডকাফড জেনারেশন’ বলে অভিহিত করেছে সে দেশের সংবাদমাধ্যম। দক্ষিণ কোরিয়ার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দাবি করছেন, যুবসমাজের স্থায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে মার্কিন ধাঁচের শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকস্বার্থের অনুকূল করতে হবে এবং ঋণখেলাপি যুবকদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। তাদের মনে ভরসা জাগাতে হবে যাতে ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে আবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সরকারি সহযোগিতা তারা পেতে পারে। একই সঙ্গে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া প্রভৃতি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা সে দেশের এই সব সাইবার অপরাধ চক্র ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অবশ্য সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যে, শুধু দক্ষিণ কোরিয়া নয়, চরম সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী দুনিয়ার সব দেশের যুবসমাজই একই রকমভাবে বেকারত্বের জ্বালায় ছটফট করছে এবং তার ফলে সৃষ্ট হচ্ছে অভাবনীয় সব সামাজিক সংকট, বাড়ছে বেপরোয়া অপরাধ। একচেটিয়া পুঁজিরই কালো টাকা খাটছে এইসব অপরাধচক্রে এবং জীবনযন্ত্রণায় ছটফট করা যুবসমাজকে সহজেই তারা ফাঁদে ফেলতে পারছে। সকল সংকটের মূল এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে শ্রমিক শ্রেণির সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম না করা পর্যন্ত কোনও সংকট থেকেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
(সূত্রঃ দি স্টেটসম্যান ২৭-১০-২০২৫)