Breaking News

স্বেচ্ছাশ্রমের ভাঁওতা নয়, যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি সুনিশ্চিত করার দায় নিতে হবে সরকারকে

শিক্ষক নিয়োগে রাজ্য সরকারের দুর্নীতি, মামলা পর্বে রাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার উপর বহুমুখী বিপর্যয় নেমে এসেছে। ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, ২০১৬ সালের এসএলএসটির মাধ্যমে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত প্যানেল বাতিল করা হয়। চাকরি হারান ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী। এই রায়ের ফলে একদিকে যেমন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সহ তাদের পরিবারগুলি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, অন্য দিকে শিক্ষকের অভাবে বহু স্কুলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। এক ধাক্কায় হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপস্থিতির ফলে ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার খাতা দেখা, সময় মতো ফলপ্রকাশ করা বহু স্কুলের নানা কাজ ব্যাহত হবে। এই অবস্থায় কয়েকটি স্কুলকে মিলিয়ে দিয়ে বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির ‘ক্লাস্টার’ প্রথা চালু করে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার। পরিণামে কিছু স্কুল উঠে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া এতটাই কলুষিত হয়ে গেছে যে, তা সমাধানের ঊর্ধ্বে। এসএসসি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য হল নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনিয়মের তথ্য ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এসএসসি সেই দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিতে গিয়ে এত পরিমাণ কারচুপি করেছে যে যোগ্য-অযোগ্য চিহ্নিত করা কার্যত অসম্ভব। মানুষ জানে, তৃণমূল দল ও তাদের সরকারের সীমাহীন দুর্নীতিই এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই দুর্নীতিতে শুধু তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সহ দু-চার জন নয়, শাসকদলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অসংখ্য নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ জড়িত। সাদা খাতা জমা দেওয়া লোকেদের চাকরি, মেধাতালিকায় পিছনে থাকা নাম সামনে নিয়ে আসা, প্যানেলে নাম নেই এমন ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করে দেওয়া, ওএমআর সিটের নম্বরে কারচুপি, এমনকি স্কুল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ ছাড়াই নিয়োগ পাইয়ে দেওয়া– এ সমস্ত অপকর্মই সংঘটিত হয়েছে শাসকদলের প্রভাবশালী নেতাদের কল্যাণে। এই দুর্নীতিগ্রস্তদের এবং দুর্নীতি করে যাদের চাকরি দেওয়া হল তাদের নাম বারবার সুপ্রিম কোর্ট জানতে চাইলেও এসএসসি এবং রাজ্য সরকার তাদের আড়াল করারই প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাই সুপ্রিম কোর্ট বারবার সেই তালিকা চাইলেও কমিশন বা রাজ্য সরকার তা দেয়নি। শুধু তাই নয়, কারচুপির প্রমাণ লোপাট করতে ওএমআর সিট নষ্ট করা হয়েছে। ফলে যোগ্য-অযোগ্য পার্থক্য করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ কথাই কোর্ট বলেছে।

কিন্তু এতে ন্যায়বিচারের ন্যূনতম যে নীতি– দোষ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত না হলে কোনও মতেই কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না, তা লঙ্ঘিত হল। শিক্ষক নিয়োগে যারা কোটি কোটি টাকা লুট করে দুর্নীতি করল সিবিআইয়ের অপদার্থতায় তাদের একের পর এক জামিন হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য মামলার মতো এই মামলাতেও প্রকৃত দোষীদের আদৌ শাস্তি হবে কি না, এই প্রশ্ন উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া কয়েক হাজার শিক্ষক শিক্ষিকার চাকরি বাতিল করা হল অথচ তাদের কোনও কথা শোনা হল না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ দেওয়া হল না। এর থেকে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে? হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট সকলেই স্বীকার করেছে যে একটা বিরাট সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকা যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিযুক্ত হয়েছেন। তা হলে যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণ সমস্যা– এই অজুহাতে পুরো প্যানেল বাতিল করা চলে কি? এই প্রশ্ন, যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ সাধারণ মানুষের।

সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরনোর দিনই সিপিএম এবং বিজেপি ও তাদের বিভিন্ন গণসংগঠন যোগ্যদের চাকরির রক্ষার দাবিতে এবং দুর্নীতিকারীদের শাস্তির দাবিতে মিছিল এবং প্রচার শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এদের এই প্রতিবাদের কি কোনও নৈতিক অধিকার আছে? সিপিআই(এম) দলের নেতা, রাজ্যসভার সাংসদ বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য এই মামলায় প্রথম থেকেই পুরো প্যানেল বাতিলের দাবিতে জোরের সঙ্গে কোর্টের ভেতরে এবং বাইরে সওয়াল করে এসেছেন। হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং বর্তমান বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গাঙ্গুলী সিঙ্গল বেঞ্চে পুরো প্যানেল বাতিলের রায় দেন। তখন বিকাশ ভট্টাচার্যরা শহিদ মিনারে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ বাবুকে অভিনন্দন জানান। এগুলো তো ইতিহাস। ফলে আজ তাঁরা যখন প্রতিবাদের কথা বলেন, তখন মানুষের মনে তা নিয়ে খটকা লাগেই।

চাকরির সঙ্কট এবং তা নিয়ে দুর্নীতি নানা রাজ্যে ঘটছে। ত্রিপুরাতে সিপিএমের আমলে দুর্নীতির কারণে ১০,৩২৩ জনের পুরো প্যানেল বাতিল করেছিল কোর্ট। ভারতের সর্ববৃহৎ নিয়োগ কেলেঙ্কারি ব্যাপম মধ্যপ্রদেশে সংগঠিত হয়েছিল বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের দ্বারা। সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট দুর্নীতিতেও জড়িয়েছে বিজেপি নেতা-নেত্রীদের নাম। ২০১৭ সালের ক্যাগ রিপোর্টে জানা যায় ২০০৯-১০ সালে এই পশ্চিমবঙ্গে আরএসএলটি পরীক্ষায় ৪৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের মাধ্যমে। তখন পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতাসীন ছিল সিপিএম পরিচালিত ফ্রন্ট সরকার।

৭ এপ্রিল যোগ্য শিক্ষকদের নিয়ে নেতাজি ইন্ডোরে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী সভা করে বললেন, ‘আমার উপর ভরসা রাখুন। আমি বেঁচে থাকতে কারও চাকরি কেড়ে নিতে দেব না।’ এ ছাড়াও তিনি স্বেচ্ছাশ্রমের কথা বলেছেন। এই কথায় যোগ্য শিক্ষকরা ভরসা রাখবেন কী করে? কারণ গত পাঁচ-ছ বছর ধরে কোর্টে কুড়ি বার শুনানি হওয়া সত্ত্বেও, রাজ্য সরকার, কিংবা এসএসসি দপ্তর হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের চাওয়া যোগ্য-অযোগ্য তালিকা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করেনি। আর স্বেচ্ছাশ্রমে নারাজ সুস্পষ্ট বেতনের দাবিদার শিক্ষক সমাজ মুখ্যমন্ত্রীর ভরসা রাখার কথায় ভরসা করতে না পেরে ৯ এপ্রিল থেকে ডিআই অফিস অভিযান, পথ অবরোধ, বিভিন্ন স্থানে মিছিল, এসএসসি দপ্তরের সামনে অবস্থান প্রভৃতি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোরে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, যোগ্য শিক্ষকদের ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত মানবিক। অথচ কসবায় ডিআই অফিস অভিযানের সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করল, যোগ্য শিক্ষকদের পেটে লাথি মারল এবং মমতা ব্যানার্জীর প্রশাসন সেই পুলিশের কাজকেই সমর্থন করল। কোথায় মানবিকতা! শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সাথে যোগ্য শিক্ষক-অশিক্ষক-শিক্ষাকর্মী অধিকার রক্ষা মঞ্চের বৈঠক হল। সেই বৈঠকে আইনগত দিক দেখে ২২ এপ্রিলের মধ্যে বাইশ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ওএমআর সিট প্রকাশ করবেন বলে মন্ত্রী বলেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি যেটি প্রকাশ করবেন বলেছেন, ইতিমধ্যেই সেটি সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ফলে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সাথে আলোচনাও অন্তঃসারশূন্য ছাড়া কিছু হতে পারে না।

বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা তাঁর কাছে আছে। ২০২৬ সালে তাঁরা ক্ষমতায় এলে রিভিউ পিটিশন করে যোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দেবেন। অনেকেরই নিশ্চয় স্মরণে আছে, ত্রিপুরাতে ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নির্বাচনী সভায় বলেছিলেন, আমরা ক্ষমতায় এলে সিপিএম আমলে চাকরিহারা ১০,৩২৩ জনের চাকরি ফিরিয়ে দেব। প্রায় সাড়ে সাত বছর ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। অথচ এঁদের একজনও চাকরি ফিরে পাননি। বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি, কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির জুমলাবাজ বিজেপি নেতাদের কথা বিশ্বাস না করে যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের নেতারা দাবি আদায়ের লক্ষে্য রাস্তাকেই বেছে নিয়েছেন। ধরনা শুরু করেছেন ওয়াই চ্যানেলে। তাঁদের দাবি, অতি দ্রুত মুখ্যমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়ে এঁদের চাকরি রক্ষা করতে হবে। শিক্ষকদের চাকরি রক্ষার এই আন্দোলনে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষার স্বার্থে। অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে রাজ্য সরকারকে এর সমাধান করতে হবে।

লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ১৮ এপ্রিল ২০২৫ এ প্রকাশিত