Breaking News

শান্তির নয়, তাঁবেদারির নোবেল

এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে তা নিয়ে প্রবল কৌতূহল ছিল। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকবার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, বিশ্বের বেশ কয়েকটা যুদ্ধ ‘থামানোর’ জন্য তাঁকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া উচিত। যে যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেওয়ার পিছনে সাম্রাজ্যবাদী একনায়ক হিসাবে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রবল গণআন্দোলনের চাপে সেই আপাত ‘যুদ্ধবিরতিগুলির কৃতিত্ব’ ট্রাম্পের গলায় ঝোলানো হবে কি না এটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া, গোছা গোছা ডলার দিয়ে নিজের যৌন-কেচ্ছা ধামাচাপা দিতে চাওয়া, ভোটে হেরে হোয়াইট হাউসে উগ্র সমর্থকদের দিয়ে হামলা চালানো– এ সব নিয়ে আমেরিকার আদালতেই ট্রাম্প সাহেবের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা ঝুলছে। তীব্র গণবিক্ষোভকে ‘মার্কিন মেরিনস’ দিয়ে বর্বরোচিত ভাবে দমন করা নিয়েও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকাতেই প্রবল ক্ষোভ। অতি সম্প্রতি আমেরিকার শহরে শহরে ‘নো ট্রাম্প, নো কিং’ ব্যানার নিয়ে প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষ পথে নেমেছে। তাই ট্রাম্প নিজের মুখে এবং তাঁর সাম্রাজ্যবাদী দোসররা যতই তাঁকে ‘যোগ্য প্রার্থী’ হিসাবে প্রচার করুক না কেন, ইচ্ছে থাকলেও অসলোর ‘নোবেল পিস কমিটি’ ট্রাম্পের হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দিতে পারেনি। সেই খেদ মেটাতে তারা ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের দালাল মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে মনোনীত করেছে। তিনিও সেই পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন ট্রাম্পকে।

কে এই মাচাদো? ভারতে তাঁর নাম খুব পরিচিত না হলেও, দক্ষিণ আমেরিকায় মারিয়া কোরিনা মাচাদো এক পরিচিত নাম। ভেনেজুয়েলার এই উগ্র দক্ষিণপন্থী নেত্রী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মুখ ডোনাল্ড ট্রাম্পের তাঁবেদার হিসাবেই পরিচিত। তিনি ওয়াশিংটনের হাতে এক ‘জমানা বদলের যন্ত্র’, দেশে দেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখপাত্র, বেসরকারিকরণের সমর্থক এবং গণতন্ত্রের নামে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের প্রবক্তা।

মাচাদোর রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ। ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করার জন্য তিনি এমনকি গাজার নরসংহারক, শিশু হত্যাকারী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকেও আহ্বান জানান। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী দেশগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, খনিজ তেল ইত্যাদি বন্ধ করে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নীরবে মেরে ফেলার দাবি জানান। যুদ্ধের থেকে অনেক বেশি এর মারণ-ক্ষমতা।

মাচাদো ২০০২ সালে আমেরিকার মদতে ভেনেজুয়েলায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করাতে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ কাজে তাঁকে নিযুক্ত করেছিল মার্কিন শাসকরা। তাঁর মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে গায়ের জোরে ক্ষমতাচ্যুত করে কারমোনা ডিক্রি জারি করেছিল তারা। সংবিধান এবং প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রাতারাতি নিক্ষিপ্ত হয় আঁস্তাকুড়ে। এমনকি মাচাদো ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করার জন্য বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি করেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা আক্রমণের হুমকি এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে মার্কিন নৌবহর মোতায়েনের বিষয়ে তিনি উল্লসিত। আমেরিকার চাপানো নিষেধাজ্ঞার ফলে দরিদ্র, অসুস্থ, শিশু, নারী ও শ্রমিকরা সব থেকে বেশি মূল্য দেবে জেনেও তিনি তা সমর্থন করেন।

ভেনেজুয়েলায় পেন্টাগন সমর্থিত পুতুল সরকারকে সমর্থন জানিয়েছেন মাচাদো। সেই সরকারের প্রধান দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করলেও মাচাদো তাকেই সমর্থন করেছেন।

তিনি জেরুজালেমে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস পুনরায় খোলার অঙ্গীকার করেছেন এবং খোলাখুলিভাবে নিজেকে ইজরায়েলের গণহত্যাকারী সরকারের হাসপাতালে বোমাবর্ষণকেও বাহবা দেন। এখন তিনি দেশের খনিজ তেল, পানীয় জল এবং পরিকাঠামো মার্কিন একচেটিয়া পুঁজি ও বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিতে উদগ্রীব।

নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি বহু কাল আগে থেকেই সাম্রাজ্যবাদের তোষণ করে আসছে। নরওয়ের শাসকরা দীর্ঘদিন মার্কিন তাঁবেদার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের পার্লামেন্ট এই নোবেল শান্তি কমিটিকে নির্বাচন করে। তাই হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসী আগ্রাসনের ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে গোটা দুনিয়াকে মুক্ত করে শান্তি ফিরিয়ে আনা স্ট্যালিন নন, জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করা মাও সে তুং নন, ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিন নন, কিউবান বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্তে্রা নন, কিংবা উত্তর কোরিয়াকে সাম্রাজ্যবাদের কবল মুক্ত করা কিম ইল সুঙ নন, এমনকি বুর্জোয়া অর্থে ‘অহিংসা’র প্রবক্তা গান্ধীজিও নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন না। কারণ তা হলে আমেরিকা বা ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা রেগে যাবে। এই কারণে ১৯৭৩ সালে যখন ভিয়েতনামের নেতা লে ডাক থো-কে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ভিয়েতনামে মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের পরিকল্পনাকার এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখ হেনরি কিসিঞ্জারকে। লে ডাক থো অবশ্য নোবেল কমিটির এই ঘৃণ্য আচরণের বিরোধিতায় পুরস্কার গ্রহণ করতে যাননি। ১৯৯৩ সালে যখন বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়, তখন সেই পুরস্কারের ভাগীদার করা হয় ওই দেশের বর্ণবৈষম্য পর্বের শেষ শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এফ ডি ক্লার্ককে। বিশ্বে যথার্থ শান্তির জন্য কাজ করলে যেতে হবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, তাতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমনকি সেবামূলক কাজের জন্য যাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা এর জন্য অর্থ পেয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী কোনও গোষ্ঠীর থেকে। ফলে এই পুরস্কারকে শান্তি নয়– তাঁবেদারিতে নোবেল বলাটাই সঠিক।