২ মার্চ, কলকাতার রামলীলা পার্কে দুপুরের রোদ তখন বড়ই প্রখর। বাঁকুড়ার ঠুটাশোলের চাষি ঘরের নারী পুরুষ মিলিয়ে ১০“১২ জন গভীর আগ্রহে শুনছেন নেতাদের কথা। পাশেই পশ্চিম বর্ধমানের ইছাপুর গ্রামের সুকু মুর্মু ছোট্ট মেয়ের আব্দার সামলেও কান খাড়া রেখেছেন কী বলেছেন নেতারা সে দিকে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের পানচাষিরাও হাজির, আছেন পুরুলিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা সহ দক্ষিণবঙ্গের কয়েক হাজার কৃষক। এসেছেন তাঁরা কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের কানে তাঁদের বাঁচার দাবি পৌঁছে দিতে। পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্ত থেকে দুদিন ব্যাপী ‘কিষাণ মার্চে’র দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তাঁরা এসেছিলেন, অল ইন্ডিয়া কিষাণ খেতমজদুর সংগঠনের (এআইকেকেএমএস)-এর ডাকে ১-২ মার্চ ‘কিষান মার্চে’ অংশ নিয়ে।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Kkms-debaprasad-sarkar.jpg)
স্বাধীনতার পর বাহাত্তরটা বছর পার হয়ে গেছে, অথচ আজও সেচের জলের জন্য কৃষককে তাকিয়ে থাকতে হয় আকাশের দিকে। প্রতি গ্রীষ্মে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, জঙ্গলমহল, বর্ধমানের হাজার হাজার একর জমি জলের অভাবে শুকোয়। এক বছর চাষ হলে তিন বছর খরা, সেচের কোনও ব্যবস্থাই আজও সরকার করেনি। আবার রাজ্যের বিস্তীর্ণ প্রান্ত বছর বছর বন্যায় ডুবে যায়, ফসল নষ্ট হয়। মরে কৃষক। দলে দলে গ্রাম ছেড়ে তারা কাজ খুঁজতে চলে যায় ভিন রাজ্যে, এমনকি ভিনদেশে পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ভোটের সময় বলেছিল, কৃষকের আয় তারা দ্বিগুণ করে দেবে। তার বদলে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থে নেওয়া কেন্দ্রীয় কৃষিনীতির জেরে আয়ের সব পথ হারিয়ে ফেলছে লক্ষ লক্ষ কৃষক। কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজের সুযোগও ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে। সর্বস্বান্ত কৃষকের আত্মহত্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-র মতো নতুন আক্রমণ। দরিদ্র সাধারণ কৃষকের জীবনে এক গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো। চাষ করবে, না কাগজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরবে? এই ভাবনাতেই তাঁরা কূল পাচ্ছেন না। এদিকে ধান-পাট-আলু-সবজির ন্যায্য দাম চাষি পেল কি না তা নিয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকারেরও কোনও মাথাব্যথা নেই। নেই সস্তায় চাষিকে বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক, বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা। রামলীলা ময়দানের সমাবেশে মুখে মুখে তাই একই কথা– দাবি আদায়ে লড়তে আমরা প্রস্তুত।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Kisan-March-Joynagar.jpg)
১ মার্চ শুরু হয়েছিল এই ‘কিষাণ মার্চ’। তাঁদের দাবি, ‘ধান-পাট-আলু-সিr-পানের লাভজনক দাম চাই’, ‘সার-বীজ-তেলের দাম কমাতে হবে’, ‘মধ্য-নিম্ন-প্রান্তিক কৃষকদের ঋণ মকুব করতে হবে’, খেতমজুরের সারা বছরের কাজ ও বাঁচার মতো মজুরি চাই’, ‘খরা-বন্যার হাত থেকে মুক্তি চাই’, ‘রাজ্য সরকারকে জুট কর্পোরেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল গঠন করে কৃষকের কাছ থেকে ৮০০০ টাকা কুইন্টাল দরে পাট কিনতে হবে’, ‘এনআরসি-সিএএ-এনপিআর করা চলবে না’।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগরে কর্মসূচি শুরু হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি। উদ্বোধন করেন এস ইউ সি আই (সি) পলিটবুরো সদস্য প্রখ্যাত জননেতা কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার। কৃষক প্রতিনিধিদের হাতে লাল পতাকা তুলে দিয়ে তিনি মার্চের সূচনা করেন। উপস্থিত ছিলেন কুলতলির প্রাক্তন বিধায়ক বিশিষ্ট কৃষক নেতা কমরেড প্রবোধ পুরকাইত ও এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড শংকর ঘোষ।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Kisan-March-Uttarkanya.jpg)
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর শহর, জলপাইগুড়ি শহর থেকে কিষাণ মার্চ এগোতে শুরু করে। যাত্রাপথে সর্বত্রই জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁরা মার্চে অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। এলাকায় এলাকায় বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন খাবার, পানীয় জল নিয়ে। দিয়েছেন রাত্রের আশ্রয়। পথের দুধারে কিষাণ মার্চ রেখে গেছে এক প্রত্যয় ভরা প্রতিশ্রুতি। যা মানুষকে অধিকারের দাবিতে লড়তে প্রেরণা দেয়। আবার দুহাত ভরে সাধারণ মানুষ যখন আন্তরিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের সব ক্লান্তি মুছে গিয়ে সঞ্চারিত হয়েছে নতুন শক্তি।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Kisan-march-Habra.jpg)
মার্চের প্রস্তুতি চলেছে দেড়মাস ধরে। এর প্রস্তুতিতে অসংখ্য গ্রুপ বৈঠক, পথসভা, হাট মিটিং হয়েছে, স্থানীয় স্তরে ছোট ছোট মার্চ সংগঠিত করা হয়েছে এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের কাজও চলেছে। সর্বত্রই কৃষক-খেতমজুরদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই প্রক্রিয়ায় গ্রামে গ্রামে অসংখ্য কৃষক-খেতমজদুর কমিটি গঠিত হয়েছে– যাঁরা আগামী দিনে রাজ্যের কৃষক আন্দোলনকে আরও সংগঠিত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
কিষাণ মার্চ শেষে কলকাতার রামলীলা পার্কে কৃষক সমাবেশ হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি কমরেড সেখ খোদাব’। প্রধান অতিথি ছিলেন এস ইউ সি আই (সি) দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য। তিনি তাঁর ভাষণে, বর্তমান দিনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি আমদানি করে পুঁজিবাদকে সংহত করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি দেখান– কৃষক জীবনের সমস্ত সমস্যার উৎস হল পুঁজিবাদী শাসন-শোষণ। তাই পুঁজিবাদী এই শোষণের বিরুদ্ধে উন্নত নীতি নৈতিকতার ভিত্তিতে সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তুলে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে এদেশের কৃষকের মুক্তি নেই– সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের এটাই শিক্ষা। এই শিক্ষার ভিত্তিতে রাজ্যে আরও শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি আহ্বান জানান। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক কমরেড শংকর ঘোষ এবং রাজ্য সম্পাদক কমরেড পঞ্চানন প্রধান। উপস্থিত ছিলেন ওড়িশার কৃষক নেতা এবং সংগঠনের সর্বভারতীয় কমিটির সদস্য কমরেড রঘুনাথ দাস।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Kisan-March-From-Tamluk.jpg)
সমাবেশে উপস্থিত কাকদ্বীপের পানচাষি নারায়ণ দাস, কার্তিক দাস, শতদল বর, সুনীল দাসরা বলে গেলেন, পান চাষিদের উপর ফড়ে এবং এজেন্টেদের জুলুমের কথা। পানচাষিরা হাহাকার করছে। অথচ সরকার কিছুই করছে না। পানকে কৃষি ফসলের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তাঁরা বলেন, বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি এবং ফড়েদের চক্করে পড়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার তরমুজ, লঙ্কা চাষ আজ প্রায় বিলুপ্ত।
বাঁকুড়ার কৃষক নেতা তারাশঙ্কর গোপ জানালের কংসাবতী প্রকল্পের খোয়াব দেখিয়ে একসময় জমি নিয়েছে সরকার। আজ সেই প্রকল্প থেকে চাষিরা কোনও জল পায় না বললেই চলে। ধান ছাড়া অন্য কোনও চাষের উপায় নেই। সেই ধানের দামও ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা কুইন্টালের বেশি পাওয়া যায় না। অথচ এই ধান উৎপাদনে খরচ হয়ে যায় ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা। সরকারি উদ্যোগে ধান কেনার ব্যবস্থা প্রায় নেই। পশ্চিম বর্ধমানের কোলিয়ারি অঞ্চলে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। সামান্য যা চাষ হয় সেটাই হাজার হাজার মানুষের ভরসা। সেখানকার চাষিরা বলে গেলেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। কোথায় সেচ, কোথায় সরকারের সাহায্য? পরিযায়ী শ্রমিকের দলে নাম লিখিয়ে কীভাবে দলে দলে মানুষ গ্রাম ছাড়ছেন, বলে গেলেন সে কথা। এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতা মাঠ জুড়ে থাকা প্রতিটি মানুষের।
নেতৃবৃন্দের আহ্বান নিয়ে হাজার হাজার কৃষক জেলায় ফিরলেন। শপথ নিয়ে গেলেন, কৃষক জীবনের সমস্যার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন তাঁরা গড়ে তুলবেন।