খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি কমানো দূর অস্ত, বরং তা আরও বাড়বে– জানিয়ে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাদের সাফ কথা, মূল্যবৃদ্ধির হার কবে কমবে সেটা এখনও অনিশ্চিত। এমনকি আগামী কয়েক মাসে তেমন কোনও সম্ভাবনাই নেই (বর্তমান, ১০ অক্টোবর ২০২৪)।
‘সাফ কথা’ ভালো। কিন্তু যদি তা অকল্যাণকর হয় তাহলে তাকে কেউ ভালো বলে না। ক্ষুদ্র পরিসরে যেমন এ কথা সত্য, তেমনি বৃহৎ পরিসরে এবং যদি সামগ্রিকভাবে ভারতের মতো একটি জনবহুল দেশের ক্ষেত্রে হয় তাহলে তা অতি মারাত্মক আকার নিতে বাধ্য। দেশের জনসমষ্টির বাঁচা-মরার প্রশ্নের সাথে এই বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ সরকার চুপ করে বসে আছে। কেন?
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে এই গানের সাথে যথাযথ সঙ্গত করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্য। মাত্র ১০ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক জানিয়েছে, ‘‘খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার সেপ্টেম্বর মাসে পৌঁছেছে ৫.৪৯ শতাংশে, গত নয় মাসে যা সর্বোচ্চ। আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৩.৬৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধির হার আগস্টে ৪.১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বরে হয়েছে ৫.৮৭ শতাংশ। শহরে ৩.১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫.৫০ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু খাদ্য পণ্যেরই ক্ষেত্রে আনাজের মূল্যবৃদ্ধি ৩৫.৯১ শতাংশ, আলু ৭৮.১৩ শতাংশ, পেঁয়াজ ৭৮.৮২ শতাংশ, ডাল ১২.৯৯ শতাংশ বেড়েছে।”
রাজ্য সরকার লোক-দেখানি একটা টাস্ক ফোর্স করে কিছু অর্থের অপচয় করে চলেছে মাত্র। কার্যকরী কোনও ভূমিকাই তার নেই। বৃহৎ পুঁজিপতি এবং ফাটকাবাজদের স্বার্থই পরিপুষ্ট হয়ে চলেছে। এর পরিণতি কী? সংবাদপত্রেই প্রকাশ, ‘‘খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রমেই সামাজিক অবস্থান হারানোর দিকে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত হয়ে যাবে। নিম্নবিত্ত হবে দরিদ্র। সেই দিকেই হাঁটছে ভারত” (বর্তমান,১৮.১০.২৪)। ‘জিরো ফুড চিলড্রেন’ শব্দটা এখন বেশ পরিচিত। পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে যে অংশটি পর্যাপ্ত খাবার পায় না এবং নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে যাদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রবণতা ক্রমবর্ধমান তাদের বলা হয় জিরো ফুড চিলড্রেন। ভারতে মোট শিশুদের ১৯ শতাংশ হল এই জিরো ফুড চিলড্রেন। ল্যানসেট পত্রিকা এবং অন্যান্য সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে সব থেকে বেশি জিরো ফুড চিলড্রেন আছে উত্তরপ্রদেশে– ২৮.৪ শতাংশ। ওই রাজ্যে সোনভদ্রা জেলার বিরাওলা গ্রাম থেকে প্রতিদিন জেলাশাসকের অফিসের সামনে রিলে অনশন চালিয়ে আসছেন মূলত আদিবাসীরা। ওখানে দময়ন্তী নদীর বাঁধ নির্মাণের জন্য এলাকার আদিবাসীসহ দরিদ্র মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের। কিন্তু বেমালুম সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। কোনও স্লোগান নেই, কোনও মিছিল নেই, কেবল আমাদের খেতে দাও– এই আবেদন নিয়ে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এসে বসে থাকে দলে দলে নারী-পুরুষ। চরম অমানবিক প্রশাসন দেখেও দেখে না। প্রশ্ন ওঠে, কার জন্য প্রশাসন? কাদের জন্য সরকার? কাদের শ্রম এবং ট্যাক্সের পয়সায় এই প্রশাসনের বাহারি বিলাসব্যসন? সে তো এই চির ক্ষুধার্ত, চির বঞ্চিত শ্রমজীবী এই তাবৎ সভ্যতার স্রষ্টা মানুষগুলিই! এই অধিকাংশ দরিদ্র হাহাকারগ্রস্ত মানুষের ভোটেই সরকার গঠিত হয়। সরকার পোষিত হয়। কেবলমাত্র গুটিকয়েক ধনকুবেরদের ভোটেই তো সরকার গঠন হয় না। কিন্তু সংসদীয় দলের নেতা-মন্ত্রী-আমলারা এ সব কিছুই ভুলে যায়। সেই ভোগী, সেই নিষ্ঠুর প্রশাসনের বিবেকে বিন্দুমাত্র ঘা দিতে না পেরে ১৭ অক্টোবর ওই অনশন মঞ্চেই গলায় ফাঁসি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন গোপাল বাজিরাও। ওই মঞ্চেই গোপালের স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তাঁর অসহায় প্রশ্ন– সন্তানদের নিয়ে এবার তিনি কী করবেন? বিষণ্ন গলায় তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের এখানে গোপালরা এভাবেই খিদে থেকে মুক্তি পায়।” ঠিক এই সময়ে, ভারতে প্রতিদিন গড়ে ১৫৪ জন কৃষক এবং দিনমজুর আত্মহত্যা করছে। আর সর্বজনপরিচিত অমরাবতী? এই জেলার এমন নাম নাকি হয়েছিল এখানে সকলে খেয়ে পরে সুখে থাকে বলে। এই জেলায় ২০২৩ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ৩২৩ (সূত্র – ওই)।
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় তিনি দ্বিগুণ করে দেবেন। ‘২২ তো গেলই, ‘২৩-এর সামান্য তথ্য উপরে উল্লেখিত। ‘২৪ প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে। কোন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে দেশ? প্রধানমন্ত্রী ‘বিকশিত ভারত’-এর ঢাক পিটিয়ে চলেছেন! কিন্তু কোন সে ভারত? যে ভারতের বিকাশ তিনি ঘটিয়ে চলেছেন? হ্যাঁ, তথ্য বলছে ঠিক এই বছরই নতুন করে ভারতে ৯৪ জন বিলিওনেয়ার হয়েছেন। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় এক বছরের মধ্যে ওই ৯৪ জনের সম্পদ অন্ততপক্ষে ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই বিলিওনেয়ারের সংখ্যা তো বেড়েই চলেছে। ফলে বিকাশ তো এদেরই হচ্ছে। ২০১৮ সালে অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, ভারতবর্ষের ১ শতাংশ মানুষের হাতে ৫১.৫ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে। এ দিকে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে কেবল ৪.৭ শতাংশ নিয়ে। এটা কি ম্যাজিক, নাকি শোষণব্যবস্থার জাঁতাকল প্রকৃষ্টভাবে পরিচালনার ফল? সেজন্যই আড়ালে আবডালে তো বটেই এমনকি ইলেক্টোরাল বন্ডে খোলাখুলি লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলিকে উজাড় করে দেয় এই পুঁজিমালিকরা এবং নির্বাচন পেরিয়ে গেলেই শতগুণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে তা ফিরিয়ে নেয় সাধারণ মানুষের ঘাড় ভেঙে। ‘বিকশিত ভারত’ আসলে এদেরই স্বার্থ পূরণ করছে। আর এই পরিসর আরো ভালো করে তৈরি করে দেওয়ার জন্যই একযোগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করল, মূল্যবৃদ্ধি হতেই থাকবে। তা রোধ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু জলজ্যান্ত তথ্য কী বলছে? বিগত বছরগুলিতে সব থেকে বেশি দাম বেড়েছে কোন চারটি পণ্যের? চাল, ডাল, তেল, সবজি। আর সব থেকে কম দাম বেড়েছে কোন তিনটি পণ্যের? এয়ার কন্ডিশনিং মেশিন, স্মার্টফোন এবং রেফ্রিজারেটরের। এ তো সাদা চোখেই মিলিয়ে নেওয়া যায়। এই সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্য সরকারের ভূমিকা কত কূটকৌশলী! ২০১৭-১৮ সালে একটি রিপোর্ট ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস প্রস্তুত করেছিল যা কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি, কারণ রিপোর্টের ফাঁস হয়ে যাওয়া অংশ অনুযায়ী তাতে দেখা গিয়েছিল যে, ২০১১-১২-র তুলনায় ২০১৭-১৮-তে মাথাপিছু মাসিক ব্যয় কমেছে, দারিদ্র বেড়েছে (আনন্দবাজার, ২৪-৫-’২৪)। এই হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘বিকশিত ভারত’। এখানে বিকাশ ঘটে শুধু ধনকুবেরদের, আর তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয় খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ।