Breaking News

মুসলিম হলেই হত্যা করা যায়! গো-রক্ষকদের কাছে প্রশ্ন পুত্রহারা পিতা-মাতার

হরিয়ানায় বিধানসভা ভোট আসতেই আবার গো-রক্ষক বাহিনীকে মদত দিয়ে রাস্তায় নামিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-আরএসএস। তাদের আক্রমণের একেবারে সাম্প্রতিক শিকার ২০ বছরের স্কুল ছাত্র আরিয়ান মিশ্র।

আরএসএস-বিজেপির অন্যতম সহযোগী বজরং দলের বাহিনী হরিয়ানার ফরিদাবাদে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে ২৩ আগস্ট। গরু পাচারকারী সন্দেহে তার গাড়িকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ধাওয়া করে বজরং দলের গো-রক্ষক বাহিনীর নেতা অনিল কৌশিক তাকে গুলি করে খুন করেছে।

আরিয়ানের পরিজন বাড়ির সামনে তার ছবি সহ ফ্লেক্স ঝুলিয়ে লিখেছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’– আর জি কর আন্দোলনের আবহে যে দাবি এখন বিশ্বজুড়ে জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে, সেই দাবির প্রতিধ্বনি সেখানেও।

ধরা পড়ার পর খুনি অনিল কৌশিক স্বীকার করেছে, মুসলিম সন্দেহে সে খুনটা করেছে। যা শুনে সন্তান হারানো আরিয়ানের বাবা গুরুতর প্রশ্নটি তুলেছেন, মুসলিম হলেই কি খুন করা যায়? ওদের কি বাঁচার অধিকার নেই? তার মা ওই খুনিকে প্রশ্ন করেছেন, মুসলিমরা কি তোমার ভাই নয়!

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গোল্ড মেডেলিস্ট ছাত্র অনিল কৌশিকের খুনি হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে কোন সে চরম বিদ্বেষী চিন্তাভাবনা? কে তাকে বানালো এমন ঠাণ্ডা মাথার নৃশংস খুনি? এই ঘটনার মাত্র কয়েক দিন পরের আর একটি ঘটনার দিকে তাকালে অবশ্য কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। হরিয়ানাতেই চরখি দাদরি এলাকায় ২৭ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের এক পরিযায়ী শ্রমিক সাবির মালিককে গোমাংস খাওয়ার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করেছিল এই গো-রক্ষক বাহিনী। তার আর এক সঙ্গী গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। তাদের প্রতিবেশী এক যুবককে তার আগের দিনই পুলিশ একই রকমভাবে গো-মাংস ঘরে রাখার অভিযোগে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল, না হলে সেও সাবিরের পাশে হয়ত এতদিনে জায়গা নিত। হরিয়ানায় বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ চরমে উঠছে। তার উপর ধারাবাহিক কৃষক আন্দোলন বিজেপিকে আরও বিপাকে ফেলেছে।

ফলে সরকারি মদতে তারা এখন গো-রক্ষক বাহিনীকে নামিয়ে গুরগাঁও রোহতক হাইওয়েতে কার্যত পাহারা বসিয়েছে। কখনও গাড়ি থামিয়ে, কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বাড়ির রান্নাঘরে পর্যন্ত হামলা চালিয়ে তারা তথাকথিত গো-রক্ষার পবিত্র কর্মটি করে চলেছে। পুলিশ সব জেনেও চুপ। পরপর হত্যাকাণ্ডে তারা শুধু বলেছে– আমরা তো খবর দিতে বলেছিলাম– ওরা একেবারে মেরে ফেলবে ভাবিনি! অর্থাৎ পুলিশের মদতেই এই সব চলছে তা পরিষ্কার। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ কী বলছেন? সাবিরকে পিটিয়ে মারার পর সাংবাদিকরা তাদের বস্তির আশেপাশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখেছেন, তাঁরা বিজেপি সরকারের এই ধরনের কাজের তীব্র বিরোধী।

পুলিশ এবং গো-রক্ষকরা এই সাহস কোথা থেকে পেয়েছে? বোঝা যায় যখন সাবিরের মৃত্যুকে কার্যত সমর্থন কর়ে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নায়াব সিং সাইনি বলেন, গ্রামবাসীরা গরুকে সম্মান করে, তাদের রুখবে কে? (বিজনেস টুডে, ৩১ আগস্ট ২০২৪) এটাই নাকি বিজেপি কথিত আইনের শাসন? প্রধানমন্ত্রীর সংবিধানে মাথা ঠেকানো তা হলে এ জন্যই যে তাঁর দলের মুখ্যমন্ত্রী একজনের খুনকে খোলাখুলি সমর্থন জানাবেন? এরপর অনিল কৌশিকদের খুনি হয়ে ওঠার জন্য আরএসএস-বিজেপিকে দায়ী করা কি খুব ভুল হবে?

২০১৫ সালে হরিয়ানার বিজেপি সরকার গরুপাচার, গোহত্যা এবং গোমাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। এটা কি পশুপ্রেমের কোনও বিষয়? তা যদি হত তাহলে উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা, রাজস্থানের মতো রাজ্যে বেওয়ারিশ গবাদি পশুতে রাস্তা ছেয়ে যেত না। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের বহুল প্রচারিত গোশালাতে শত শত গবাদি পশুর অবহেলায় মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটত না। আসলে এর পিছনে বিজেপির ভোটের সময়ে তোলা হিন্দুত্ববাদী সেন্টিমেন্টের হিসাব ছাড়া আর কিছুই নেই।

গরুকে দেবতা হিসাবে পুজো করার চল যেমন হিন্দুদের মধ্যে দেখা যায়, তেমনই মুসলমান কৃষকের, দুধ ব্যবসায়ীর ঘরে গরুর যত্ন কিছু কম হয় না। কিন্তু আজকের দিনে কৃষিকাজে গরুর ব্যবহার কমছে। ফলে দুধ দেওয়ার বয়স শেষ হওয়ার পর তাকে বিক্রি করতে না পারলে সাধারণ পরিবারের পক্ষে গরু পোষার খরচ সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। যে কারণে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গরুদের দুর্দশা বেশি বাড়ছে। অথচ ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া যেখানে মাংস এবং দুধ উভয়ের জন্যই গো-পালন হয়, সেখানে গরুর প্রজাতির উন্নতি ও তাদের যত্ন তথাকথিত গো-পূজক বিজেপি শাসিত রাজ্য থেকে অনেক গুণে বেশি।

অন্য দিকে বেশ কিছু বিজেপি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মোষের মাংস বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করে কোটিপতি হয়েছেন। অথচ দেশের মধ্যে মুসলিম, খ্রিস্টান সহ নানা আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে গো-মাংস খাদ্য হিসাবে গ্রহণীয় হলেও বিজেপি সেখানেও দাদাগিরি চালাচ্ছে। যেমন তারা উত্তর ভারতে এবং অন্যত্রও সমস্ত ধরনের আমিষভোজী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নানা প্রচার চালাতে শুরু করেছে। এমনকি কোনও কোনও মাসে মাছ খাওয়ার বিরুদ্ধে খোদ বাংলা ও আসামেও বিজেপি ফতোয়া দিচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক খাদ্যভাসের বিরুদ্ধে জিগির তুলে বিজেপি আরএসএস-এর অভ্যাসকেই একমাত্র বলে চাপিয়ে দিতে চাইছে তারা।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে ভেবে দেখতে হবে, ধর্মের অজুহাতে এই ধরনের স্বৈরাচার চলতে দিলে তা সব ধরনের অধিকারের গলা টিপে ধরার রাস্তা করে দেবে না কি?