
‘‘মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে একমাত্র বিপ্লবী তত্ত্ব, যা আজকের যুগে সব চেয়ে বৈজ্ঞানিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ বা ভাবাদর্শ এবং যা বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের পঙ্গুতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে একটা নতুন শোষণহীন শ্রেণিহীন উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে সক্ষম। এবং এ কথাও আমরা জানি যে, বিপ্লবী ভাবাদর্শ ও মতবাদ এবং বিপ্লবী তত্ত্ব সব সময়েই উন্নততর সংস্কৃতিগত ও নৈতিক মানের জন্ম দিয়ে থাকে।
এই উন্নততর সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মান অন্তত খানিকটা অর্জন করতে না পারলে একটা দেশের জনসাধারণ কখনই বিপ্লব সংগঠিত করতে পারে না। তা হলে, এই সমস্ত পার্টিগুলি, যারা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী বলে নিজেদের জাহির করছে, যদি যথার্থই তারা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী হত, তা হলে এদের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে অন্ততঃপক্ষে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনসাধারণের এবং ছাত্র ও যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে বুর্জোয়া সমাজের সর্বপ্রকার অপসংস্কৃতির প্রভাব খর্ব হওয়ার লক্ষণ দেখা দিত এবং তাদের মধ্যে একটা নতুন উন্নততর নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানের প্রতিফলন আমরা দেখতে পেতাম। অথচ বাস্তবে এর উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। এই ঘটনাই কি প্রমাণ করে না যে, এরা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের নামে যে জিনিসের চর্চা এ দেশে করছে, তা আসলে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ নয়। যে কোনও যুগে যে কোনও বিপ্লবী তত্ত্ব ও মতাদর্শের আসল মর্মবস্তু ও প্রাণসত্তা নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিগত ও নৈতিক ধারণার মধ্যে। সেইরূপ বুর্জোয়া বিপ্লব ও পুঁজিবাদী বিপ্লবের যুগের সর্বোচ্চ স্তরের মানবতাবাদী সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ধারণার চেয়েও উন্নততর সর্বহারা সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও নৈতিক মান অর্জন করার মধ্যেই যে নিহিত রয়েছে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ভাবাদর্শের মূল মর্মবস্তু ও প্রাণসত্তা, এটি ঠিক মতো উপলব্ধি করতে না পারার ফলেই উপরোক্ত বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। এঁদের হাতে পড়ে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ হয়ে পড়েছে অনেকটা প্রাণহীন দেহের মতো। প্রাণহীন দেহের মতোই এইসব তথাকথিত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টিগুলির সমাজজীবনে অবস্থান ও প্রভাববৃদ্ধি সমাজের এবং বিপ্লবী আন্দোলনের ক্রমেই ক্ষতিসাধন করে চলেছে। ফলে এই সমস্ত তথাকথিত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দলগুলোর নেতৃত্বাধীনে যত দিন পর্যন্ত দেশের গণআন্দোলন এবং বামপন্থী আন্দোলন পরিচালিত হবে, তত দিন দৈনন্দিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে যত মারমুখী লড়াই-ই পরিচালনা করা হোক না কেন, শুধুমাত্র তার দ্বারা সাধারণ ভাবে জনতার মধ্যে এবং বিশেষ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক মানের ক্রমাবনতির এই ধারাকে কোনও মতেই রোখা যাবে না। আর, দেশের জনসাধারণ যদি এই ভাবে নিম্নতম সংস্কৃতির, অর্থাৎ সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে বুর্জোয়া ও সামন্তী সংস্কৃতির দাসই থেকে যায়, তা হলে যে কোনও সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিফলতা ও দেশজোড়া হতাশার মুখে তারা প্রতিক্রিয়ার শিকার বনে যেতে পারে এবং শেষপর্যন্ত এমনকি প্রতিক্রিয়ার হাতে বিপ্লববিরোধী শক্তিতে পরিণত হতে পারে যেমন আমরা ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে প্রত্যক্ষ করেছি।
এ ছাড়া মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও–সমস্ত নেতারই বক্তব্য অনুধাবন করলে জানা যায় যে, উন্নততর সাংস্কৃতিক মান অর্থাৎ সর্বহারা সংস্কৃতিগত মান অর্জন করতে না পারলে সঠিক ভাবে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব বিচারের ক্ষমতাই অর্জন করা যায় না।
ফলে, এরা যখন বলে, ‘বিপ্লবের তত্ত্বটা ঠিক হয়ে গেলেই পার্টিটা ঠিক হয়ে গেল’, তখন এরা ভুলে যায় যে, সংস্কৃতিগত মান নিম্ন স্তরের হওয়ার ফলে বিপ্লবী তত্ত্ব বিচারও এদের ক্ষেত্রে সঠিক হতে পারে না। মূল বিপ্লবী রাজনৈতিক তত্ত্ব অর্থাৎ ভারতবর্ষের বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ এবং দৈনন্দিন বিপ্লবী গণআন্দোলনগুলোর কলাকৌশল নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এইসব তথাকথিত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টিগুলি বারবার যে ভুল করে চলেছে. এটা তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ।’’
(কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এস ইউ সি আই কমিউনিস্ট একমাত্র সাম্যবাদী দল)