
‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’– বলে গলা ফাটানো নরেন্দ্র মোদিজির দল বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে সমস্ত রকম দুর্নীতি ও জালিয়াতি চরম আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে সব থেকে ভয়াবহ বোধহয় জাল ও দূষিত ওষুধের রমরমা কারবার।
গত সেপ্টেম্বরে আর এক ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্য মধ্যপ্রদেশে, ছিন্দওয়াড়া জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দে্র অতিরিক্ত ডাই-ইথাইল গ্লাইকল (ডিইজি) ভেজাল দেওয়া কাশির ওষুধ খাওয়ানোর ফলে ন’টি শিশুর মৃত্যু ঘটেছে এবং আরও তেরোটি শিশুর অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছিন্দওয়াড়া ও নাগপুরের জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে (দি স্টেটসম্যানঃ ৪-১০-’২৫)। এই রাসায়নিকটি কিছু ব্রেক অয়েলে ব্যবহৃত হয়। পারাশিয়া মহকুমায় সব থেকে বেশি শিশু আক্রান্ত হয়েছে। সেখানকার মহকুমা শাসক জানিয়েছেন ছিন্দওয়াড়ার মোট ৪৬৫৮টি শিশুর শরীরের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চলছে এবং একাধিক উপাদান মিশ্রিত সমস্ত সিরাপের বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের একটি দল ঘটনার তদন্তের জন্য ছিন্দওয়াড়ায় গেছেন। অবশ্য তাঁদের তদন্তও এ রাজ্যের অভয়া কাণ্ড এবং মেদিনীপুরের ভেজাল স্যালাইন কাণ্ডের মতো আরও এক মূষিক প্রসব করবে কি না ভবিষ্যতই বলবে।
সারা দেশ জুড়েই জাল ও নিম্নমানের ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবসা থেকে শুরু করে এমবিবিএস ছাত্রদের ডাক্তারি প্রবেশিকা ‘নিট’ পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতি পর্যন্ত যা কিছু সম্ভব তা থেকেই কোটি কোটি টাকা কামানোর ভয়ঙ্কর অপরাধচক্রের রমরমা চলছে। এমনই চক্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আর জি করে অভয়াকে খুন হতে হল, সেই সব চক্রের সঙ্গে শাসক দল ও পুলিশ-প্রশাসনের যোগসাজশের কথা সকলেরই জানা বা, এমনকি বলা যেতে পারে যে, পুলিশ-প্রশাসন ও শাসকদলের মদত ছাড়া এই রকম ঘৃণ্য কাজকর্ম সংগঠিত ভাবে দীর্ঘদিন চলাই অসম্ভব। কিন্তু যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দুন¹তি রোখার এত হুঙ্কার দেয়, তাদের পরিচালিত কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই অন্তত অপরাধচক্রের সকলকে ধরবে এবং পরিণামে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চিকিৎসাজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে এই চক্রের নিষ্পেষণ থেকে স্থায়ী ভাবে মুক্তি দেবে, এটা তো মানুষ আশা করতে পারে। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডে যেমন সিবিআই অপরাধী চক্রকে কার্যত ছাড় দিয়েই দিয়েছে, তেমনই অন্য রাজ্যেও বিজেপি সরকারগুলো দুন¹তি চক্রের গায়ে হাত দিতে নারাজ। বরং তাদের বহু মাথাই এর সাথে যুক্ত। ফলে রাজ্য পুলিশ থেকে সিবিআই সকলেই চুপ।
সরকারি ব্যবস্থায় যা কিছুই কেনাবেচা হয়, সমস্ত কিছুতেই দুর্নীতি, কাটমানি, ভেজাল, জালিয়াতি, চুরি এ সব ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। ভারতীয় পুঁজিপতিরা, সরকারি ক্ষমতা পাওয়ার আগে থেকেই অর্থাৎ ব্রিটিশ যুগের জন্মলগ্ন থেকেই চূড়ান্ত অসৎ। যত দিন যাচ্ছে জনবিরোধী রঙ-বেরঙের শাসক দলের প্রশ্রয়ে তারা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, জীবনদায়ী ওষুধ, স্যালাইন কোনও কিছুতেই ভেজাল চালাতে কসুর করছে না। পশ্চিমবঙ্গে অভয়া আন্দোলন চলাকালীনই মেদিনীপুরে ভেজাল স্যালাইনে একাধিক প্রসূতিমৃত্যুর কথা এখনও সকলেরই মনে আছে। মধ্যপ্রদেশের এই ঘটনায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এইভেজাল ওষুধ, জাল ওষুধের কারবার শুধু তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাতে বিজেপি শাসিত ডবল ইঞ্জিনের রাজ্যগুলোও কম যায় না। অভয়া কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধচক্রকে যদি সিবিআই গ্রেপ্তার করে ভেঙে দেয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গের গণআন্দোলনের জয়ে উৎসাহিত হয়ে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ সারা ভারতে সর্বত্রই এই সব ব্যবসার নামে অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে উঠবে। পশ্চিমবঙ্গে এইসব চক্র চালায় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে তো বিজেপি সরকার। সেখানকার এই সব অপরাধীরা তো বিজেপির সম্পদ! এরাই তো গো-রক্ষার অজুহাতে মানুষকে পিটিয়ে মারে, কার ফ্রিজে কী খাবার আছে তদন্ত করে, হাথরাস, উন্নাওয়ে দলিত কিশোরীদের ধর্ষণ করে হত্যা করে, বাংলা বলতে দেখলেই বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে পুলিশ ডেকে আনে।
পশ্চিমবঙ্গের অপরাধী ব্যবসায়ীচক্রকে আঘাত করলে বিজেপি শাসিত অন্যত্রও স্বঘোষিত ‘দেশপ্রেমিক, রামসেবক’রাও বিপদগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রের ‘খাঁচার তোতা’ সিবিআই তা কখনোই হতে দিতে পারে না। দেশজোড়া সংগঠিত শক্তিশালী গণআন্দোলনই একমাত্র এইসব দুষ্কৃতীচক্রকে দমন করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে।