কবির কল্পনার রথযাত্রায় সকলকে দেবত্বের দাবিদার হতে দেখে ‘অন্তর্যামী’ হেসেছিলেন। কিন্তু এবারের পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রা নিয়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বনাম কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির যে কুৎসিত প্রতিযোগিতা চলল তাতে যে কোনও গণতন্ত্রপ্রিয় এবং সৎ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী হলেও তাঁর অন্তর ঘৃণায় ছি! ছি! করে না উঠে পারে না।
মুখ্যমন্ত্রী ছুটেছিলেন দিঘার সদ্যনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে রথ টানতে। তাঁর সাথে পাল্লা দিতে পশ্চিমবঙ্গে অধুনা বিজেপির প্রধান মুখ তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তিন জায়গায় ঘুরে ঘুরে রথ টেনেছেন। এই দড়ি টানাটানির হিড়িকে সরকার এবং রাজ্যের বিরোধী দল হিসাবে বিজেপি উভয়েরই হারিয়ে গেছে গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ। ধাক্কা খেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে বিরাজ করা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ। কিন্তু এই দুই পক্ষের কেউই এর কোনও তোয়াক্কা করেননি। মুখ্যমন্ত্রী কয়েক মাস আগে থেকেই মেতে আছেন, সরকারি ব্যয়ে নির্মিত দিঘার জগন্নাথ মন্দির নিয়ে। তাঁর তত্ত্বাবধানে সরকারি আধিকারিক, পুলিশ কর্তা সকলে মিলে যেমন করে জোড় হস্তে জগন্নাথ বন্দনায় মেতেছেন তা দেখে মনে হতে পারে এ রাজ্যের প্রশাসনিক সব দায়িত্ব তাঁদের সারা, এখন রথের রশিতে টানটুকু দিতে পারলেই রাজ্যবাসীর জন্য একেবারে স্বর্গসুখ তাঁরা পেড়ে এনে দেবেন। ঘরে ঘরে চাকরির হদিশ না পৌঁছাক জগন্নাথের নামাঙ্কিত প্রসাদ পৌঁছে দিতে গোটা রাজ্য সরকার একেবারে বদ্ধপরিকর। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রীকুল ও বশংবদ আমলা-পুলিশ অফিসার সেপাই-সান্ত্রীর দলও জোড়হস্তে জগন্নাথ বন্দনায় নেমে পড়েছেন। জানা যাচ্ছে রাজ্যের খোদ পুলিশ প্রধান মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছায় সারা রাত জেগে রথ চালানোর মহড়া দিয়েছেন, যাতে আসল সময়ে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। যদিও তাঁর এই নিষ্ঠা দুষ্কৃতীদের ধরার সময়ে কোথায় মুখ লুকোয় জানতে চাওয়া বৃথা। যেমন জানতে চাওয়া শুধু এ রাজ্যে কেন এ দেশেই আজ বৃথা– সরকারি আমলা-পুলিশ অফিসার হিসাবে কেন কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনে এই আধিকাররিকরা হাত লাগাবেন? মুখ্যমন্ত্রীর তাড়া অনেক, পরের বছর রথের আগেই যদি বিধানসভা নির্বাচনটা হয়ে যায়! তাই হিন্দুত্বের রক্ষাকর্তা সাজার দৌড়ে বিজেপির থেকে এগিয়ে থাকতে গেলে নীতি, সাংবিধানিক রীতি, নিয়ম কোনও কিছু মনে রাখলে এখন তাঁর চলবে না। আর বিজেপিও পড়ে আছে কার রথ বড় হল–মুখ্যমন্ত্রী না বিরোধী দলনেতা, কে বেশি নারকেল ফাটাতে পেরেছেন, এই নিয়ে। শাসক-বিরোধী উভয় পক্ষের রাজনীতির ভাষ্য দিনে দিনে রাজনৈতিক বিষয় ছেড়ে পাড়ার কলতলার কোন্দলের আকার নিচ্ছে।
বিধানসভার ভোট কাছে আসা মাত্রই তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির এই ভক্তির প্রতিযোগিতা দেখিয়ে দিচ্ছে, এদের কারও জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে জনস্বার্থে কিছুই বলবার নেই। কে বড় হিন্দু সেই বিচার করার জন্যই কি মানুষ এমএলএ-এমপি নির্বাচিত করেন? এটাই কি লোকসভা-বিধানসভার কাজ? এই জন্যই কি জনগণ ট্যা’ জোগায় সরকারকে? তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বছরের পর বছর স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সরকারি অফিস, কোথাও চাকরি না হওয়ার ক্ষোভে রাজ্যের মানুষ ফুঁসছে। বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যর মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি অপদার্থতা চরমে। এ দিকে আর জি করের ধর্ষণ-খুনের বিচার হল না। দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কলেজের ভিতরে ধর্ষিতা হলেন ছাত্রী। কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে জেতার আনন্দে বোমাবাজি করে কিশোরীর প্রাণ কেড়ে নিল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। রাজ্যে দুর্নীতি এবং সমাজবিরোধী কার্যকলাপের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতী এবং তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে নেতা-মন্ত্রী-আমলা-পুলিশ অফিসারদের নাম একেবারে খচিত হয়ে গেছে। এই পরিস্থতিতে শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, যুবশ্রীতে আস্থা রাখতে না পেরে একটিই রাস্তা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী খুঁজে নিয়েছেন– প্রবল হিন্দুত্বের জোয়ার তোলার রাস্তা। মুর্শিদাবাদের ঘটনায় ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে তাঁরা দুষ্কৃতী তাণ্ডব চলতে দিয়েছিলেন। ফলে বিজেপি তাঁদের গায়ে মুসলিম তোষণের যে তকমা লাগাতে পেরেছে তা ঝেড়ে ফেলতে এই ওষুধেই ভরসা রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
অন্য দিকে বিজেপি ভোট রাজনীতিতে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার লক্ষ্যে এই রাস্তার বাইরে আর কিছু খুঁজে পায়নি। মানুষের সামনে জনস্বার্থ সম্পর্কিত কোনও কিছু বলবার মতো মুখ তাদেরও নেই। গোটা দেশ আজ বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে। সারা দেশেই তাদেরও ভোট রাজনীতির হাতিয়ার মন্দির-মসজিদ বিতর্ক, সাম্প্রদায়িক বিভেদ আর ধর্মীয় মেরুকরণ। পশ্চিমবঙ্গে আলাদা কোনও অবস্থান তাদের নেই। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা যে ভাষায় চরম সাম্প্রদায়িক প্রচার করে যাচ্ছেন তা এ রাজ্যের মানুষ আগে কোনও দিন চিন্তাও করেনি। সম্প্রতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে বিপ্লবী কবি কাজি নজরুল ইসলামের নাম করে কটূক্তি করতেও তাঁদের আটকায়নি। কালীগঞ্জের বিধানসভা উপনির্বাচনে হারার পর বিজেপি নেতারা ‘হিন্দু ভোট’ এবং ‘মুসলিম ভোটে’র চুলচেরা বিশ্লেষণে বসেছিলেন। যদিও হিন্দু ভোটার সংখ্যাগরিষ্ঠ এমন বুথেও ফল তাঁদের পক্ষে হতাশাজনকই। তবু এই মারাত্মক বিভাজনের রাজনীতির বিষময় ফলে আজ গোটা সমাজ জর্জরিত হচ্ছে। ভোটের স্বার্থে নানা কল্পিত কাহিনি ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিম বিদ্বেষের জোয়ার তুলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক সংহত করে তাঁরা ২০২৬-এ বিধানসভা দখলের স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের এক নেতা বলেই দিয়েছেন, সরকার গঠন করতে পারলে চ্যাঙদোলা করে সব মুসলিম বিধায়ককে তাঁরা বিধানসভার বাইরে ফেলে দেবেন। দেশে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ না থাকায় এই সাম্প্রদায়িক প্রচারের বিষে কিছু মানুষ আচ্ছন্নও হচ্ছেন। এই কার্যক্রম চলতে থাকলে আজ হিন্দু-মুসলমান হবে, কাল হয়ত হবে খ্রিস্টান-হিন্দু, পরশু হতে পারে জনজাতি আর অন্যদের লড়াই। এর শেষ কোথায়? বাস্তবে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কোন উপকার এতে হবে? বিজেপি দেখেছে এই বাংলার মাটিতে আজও রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দে্রর মতো মনীষীদের চিন্তার প্রভাব কাজ করে যাওয়ায় তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পুরোপুরি জায়গা নিতে পারছে না।
স্বাধীন ভারতে এই বাংলায় ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম-বাস ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে শুধু নয়, একেবারে সাম্প্রতিক কালে চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলন, আর জি কর আন্দোলনেও হিন্দু-মুসলিম, উঁচুজাত-নিচুজাত, জনজাতি, আদিবাসী ইত্যাদি সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন, লড়ে চলেছেন। লড়াইয়ের ময়দানে তাঁদের মনে সাম্প্রদায়িক বিভেদ কোনও সময় উদয়ও হয়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যাঁরা মানুষকে ভাগ করতে চাইছেন তাঁরা আসলে মানুষের সর্বনাশ চাইছেন। তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতে যাতে কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের জনবিরোধী ভূমিকার দিকে মানুষের চোখ না পড়ে সে জন্যই বিজেপি ভোট মেরুকরণের আড়ালে সাম্প্রদয়িক বিভেদকে বড় করে তুলতে চাইছে। সেই কারণেই বিজেপি আর জি কর আন্দোলন, শিক্ষকদের আন্দোলন থেকে দূরে থেকেছে।
দুঃখের হলেও সত্য এ রাজ্যে বামপন্থী পরিচিতি নিয়ে সিপিএম সরকার চালানোর পরেও দেখা যাচ্ছে তাদের দলের বহু কর্মী-সমর্থকও এই মানসিকতায় আচ্ছন্ন। দীর্ঘ সময় পেয়েও বামপন্থার আদর্শকে কর্মী-সমর্থকদের জীবনবোধে পরিণত করতে তাঁরা চাননি। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি এবং সুবিধাবাদে আচ্ছন্ন রেখে গদি বাঁচাতে চেয়েছেন মাত্র। তার ফল আজ দিতে হচ্ছে। এমনকি ভোটের স্বার্থে সিপিএম নির্বাচনে রাজ্যের বুকে ‘আগে রাম পরে বাম’ স্লোগান তুলে বিজেপিকে সাহায্য করে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। একই সাথে কংগ্রেসের মতো দল, যাদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের ভিত কোনও দিনই পোক্ত নয়, তাদের সাথে ঐক্য করে বামপন্থার ক্ষতি করেছে। ভুলে যাওয়া চলে না, এই কংগ্রেসই বাবরি মসজিদের তালা খুলে বিজেপির মন্দির রাজনীতির সুবিধা করে দিয়েছে। তাদের নেতা রাহুল গান্ধী কিছুদিন আগেও ভোট জোগাড়ে শিবভক্ত সেজেছেন। এই শক্তিকে সাথে নিয়ে বিজেপি-আরএসএস-এর মতো সংগঠিত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কি মোকাবিলা করা সম্ভব? তা যে নয় তা আজ প্রমাণ হচ্ছে বারবার।
মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতাদের রথযাত্রার অসুস্থ প্রতিযোগিতার নিন্দা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু আর একটা ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির দৃষ্টিতে তা করলে হবে না। এর মোকাবিলা করতে গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষের ঐক্য এবং সংগ্রামী বামপন্থার রাস্তায় গণআন্দোলনই একমাত্র ভরসা।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ৪ – ১০ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত