
দুর্গাপুরে চিকিৎসক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর উলুবেড়িয়ায় মহিলা চিকিৎসককে হুমকি এবং শ্লীলতাহানির ঘটনা। তার পরে বীরভূমের মহম্মদবাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রর মদ্যপ অবস্থায় এক নার্সের শ্লীলতাহানির চেষ্টা। সব শেষে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ার সেন্টারের শৌচালয়ে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের ঘটনা। একের পর এক ঘটনার প্রবাহ যেন চলছেই। এর বাইরেও রয়েছে সংবাদমাধমে না উঠে আসা অজস্র ঘটনা।
প্রশ্ন উঠছে, আরজিকর হাসপাতালে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার প্রতিবাদে এত বড় আন্দোলনের পরও একের পর এক সরকারি হাসপাতালে এমন করে শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারছে কী করে? এমন ঘটনা আটকাতে রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? আরজিকরের ঘটনার পর সেখানকার চিকিৎসক-ছাত্ররা যে দাবিগুলি তুলেছিলেন, আন্দোলনের ময়দানে জনতার পক্ষ থেকে নারীর নিরাপত্তার যে দাবিগুলি উঠেছিল, সরকার সেগুলি পূরণ করেছে কি? কলেজগুলিতে শাসক দলের হুমকি-বাহিনী যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিল সেগুলি বন্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে কি? রাজনীতির রং বিচার না করে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা সরকার করেছে কি? বাস্তবে কিছু সিসি ক্যামেরা লাগানো ছাড়া সরকার আর কিছুই করেনি। এ কথাও রাজ্যের মানুষ ভুলে যায়নি যে, আরজিকর কাণ্ডে কী ভাবে দোষীদের আড়াল করতে প্রশাসন এবং শাসক দল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অতি দ্রুত এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে তাকেই একমাত্র দোষী হিসাবে সাজা দিতেই তৎপর হয়ে উঠেছিল গোটা প্রশাসন। আরজিকর ঘটনায় আরও যে অজস্র প্রশ্ন এবং আশঙ্কা আন্দোলনকারী চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের পক্ষ থেকে, আন্দোলনে যুক্ত সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল, তদন্ত করে সত্য সামনে আনার পরিবর্তে সেগুলি ধামাচাপা দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রশাসন। উল্টে আন্দোলনরত চিকিৎসকদেরই নানা হুমকি, শাস্তির মুখে ফেলেছিল সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের আচরণে এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতি প্রশ্রয়ই প্রকাশ পেয়েছে। অপরাধী যদি সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়, সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের অনুমোদিত কোনও চক্রের অংশীদার হয় তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তি দূরের কথা, তাকে রক্ষার চেষ্টাই সরকার করবে, সরকারের আচরণে সেটাই স্পষ্ট হয়েছে।
এ তো গেল রাজ্য সরকারের ভূমিকার কথা। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কী ছিল? আরজিকরের ঘটনায় রাজ্য সরকার ভূমিকায় যখন রাজ্য তথা দেশের মানুষ চরম ক্ষুব্ধ, তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে হেতু রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিরোধী, তখন তৃণমূলের এই দুষ্কৃতী-সহায়ক ভূমিকার বিরুদ্ধে বিজেপি সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত সিবিআই প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে তৃণমূল সরকারের খুনি-দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দানের চরিত্রকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসবে। কিন্তু মানুষ অদ্ভুত ভাবে লক্ষ করল, সিবিআই শুরুতে বহু নতুন সূত্রের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত রাজ্য পুলিশের তদন্ত রির্পোটেই ছাপ মেরে দিল।
কিন্তু ঘটনার তদন্তে সিবিআই কেন হাত গুটিয়ে নিল? রাজ্য সরকারকে বাঁচানোর কী তাগিদ ছিল তার? বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নির্দেশেই সিবিআই এ কাজ করেছে। বাস্তবে এখানে ভোট রাজনীতির স্বার্থের থেকেও শ্রেণিস্বার্থ রক্ষাই বিজেপির কাছে বেশি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথমত, আরজিকরে ন্যায়বিচারের দাবিতে যে বিরাট গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার দাবি মেনে সিবিআই যদি প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে জনসমক্ষে নিয়ে আসত তবে তা গণআন্দোলনের এক বিরাট জয় হিসাবে চিহ্নিত হত। পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী কোনও সরকার গণআন্দোলনের চাপে বাধ্য না হলে সাধারণ ভাবে তা করে না। কারণ, এর দ্বারা সমাজে গণআন্দোলনের শক্তিই প্রতিষ্ঠিত হত। শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক এই পুঁজিবাদী সমাজে জনগণের উপর যে অজস্র অন্যায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে, মানুষ তার প্রতিকারের হাতিয়ার হিসাবে গণআন্দোলনের শক্তিকে চিনতে পারত। শাসকের কাছে তা এক ভয়ঙ্কর ভীতির কারণ হয়ে উঠত। তা ছাড়া বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে প্রতিনিয়ত মহিলাদের উপর যে অজস্র নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে, সে রাজ্যের মানুষও আরজিকর আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে তার প্রতিকারে একই রকম ভাবে রাস্তায় নামত। তা-ও বিজেপির কাছে অন্যতম ভীতির কারণ ছিল। অর্থাৎ উভয় সরকারেরই লক্ষ্য ছিল, এ লড়াইয়ে জনগণকে কোনও মতেই জয়ী হতে না দেওয়া। এ ব্যাপারে উভয় সরকারই ছিল সহমত। তাই এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা আরজিকরে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ-খুনের ন্যায়বিচার আদায়ের পরিবর্তে আন্দোলনকে ভোটমুখী করতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগকেই প্রধান দাবিতে পরিণত করতে চেয়েছিল। আন্দোলনে অংশ নেওয়া হাজার-লক্ষ মানুষ বিজেপির সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রত্যাখ্যাত বিজেপি নেতারা আন্দোলন থেকে দ্রুত সরে পড়তে বাধ্য হয়েছিল।
পুঁজিবাদী সমাজে বিচার ব্যবস্থাও যে শ্রেণি রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়, আরজিকর আন্দোলনে বিচারব্যবস্থার ভূমিকায় তা আবারও উন্মোচিত হয়ে যায়। যে সর্বোচ্চ আদালত শুরুতে ঘটনার ভয়াবহতায় চমকে উঠেছিল, সেই আদালতই ক্রমে নীরব হয়ে যেতে থাকল। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য-কেন্দ্র-বিচার ব্যবস্থার ভূমিকায় দুষ্কৃতীদের উৎসাহিত হওয়ারই কথা এবং তা-ই রাজ্য জুড়ে নারী নির্যাতনের বান ডেকেছে।
এসএসকেএমের ঘটনার পর রাজ্য জুড়ে প্রবল ক্ষোভকে ধামাচাপা দিতে সরকার তড়িঘড়ি প্রশাসনিক কর্তাদের জড়ো করে হাসপাতালগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বৈঠক করেছে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর হাতে থাকা দফতরগুলিকেই ইচ্ছাকৃত নিশানা করা হচ্ছে কি না, এমন বালখিল্য প্রশ্ন যে তুলবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একের পর এক ঘটনাকে যে-মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছাকৃত অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখান, তিনি যে এমন ঘটনার প্রতিকারে সত্যিকারের কোনও ব্যবস্থা নেবেন না, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যদি সত্যিই ইচ্ছাকৃত একের পর এক এমন ঘটনা ঘটানো হয় তবে দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করে সেই ষড়যন্ত্রকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা তো তাঁর দফতরেরই কাজ ছিল? তা তিনি করলেন না কেন? অথচ আরজিকরে জুনিয়র ডাক্তাররা এবং সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে মেডিকেল কলেজের মধ্যে খুন-ধর্ষণ যে এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ফল বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, সে দিন তিনি নীরব থেকে সেই ষড়যন্ত্রকে আড়াল করেছিলেন। আজ আবার তিনি ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদে ঘটনায় প্রশাসনের তথা তাঁর দফতরের দায়কে অস্বীকার করছেন। অপরাধ সম্পর্কে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর যদি এমন দৃষ্টিভঙ্গি হয় তবে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়োরে বসে তাঁর কাজ কী থাকে?
মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ির কথা বলে ঘটনার দায় চাপাচ্ছেন ওই সংস্থাগুলির উপরে। পিপিপি মডেলে যাদের ওপরে কার্যত স্বাস্থ্য পরিষেবার একটা বড় অংশ তুলে দিয়েছে তাঁর সরকার। ডায়াগনস্টিকস, সিকিউরিটি, সাফাই, ওষুধ, পথ্য ইত্যাদি সবকিছুই প্রায় কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থে রাজ্য সরকার এইসব বেসরকারি এজেন্সিগুলির হাতে তুলে দিয়েছে। শুরুতেই এস ইউ সি আই কমিউনিস্টের পক্ষ থেকে সরকারকে বারবার বলা হয়েছিল, এই ভাবে হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা বেসরকারি হাতে তুলে দিলে একদিকে যেমন হাসপাতালে পরিষেবা দুর্মূল্য হবে, মানুষ স্বাস্থে্যর অধিকার হারাবেন, তেমনই সমস্ত পরিষেবার ওপর থেকে সরকার ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। আউটসোর্সিং এজেন্সিগুলি যথেচ্ছাচার করবে। তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। সাম্প্রতিক একের পর এক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে যে হাসপাতালের উপর বর্তমানে সরকারের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
এর দায় তো তৃণমূল সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে। তাঁরা কি জানতেন না আউটসোর্সিং হয়ে গেলে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না? তা ছাড়া এই আউটসোর্সিং এজেন্সিগুলি কারা চালায়? প্রত্যেকটার মাথায় তো শাসক দলের নেতারাই রয়েছেন। চিকিৎসক নার্স রোগীদের নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে আউটসোর্সিং এজেন্সিগুলিকে বাতিল করে সরকারকে সরাসরি নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মুখ্যমন্ত্রী মহিলাদের উপর ধর্ষণ খুন অত্যাচার বেড়ে চলার দায় বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দায় এড়াতে চাইছেন। তাঁরা যে রাজনীতির চর্চা করে চলেছেন, তা যে গোটা সমাজ জুড়ে যুবসমাজের নৈতিক মানকে ক্রমাগত টেনে নিচে নামাচ্ছে, সমাজ পরিবেশকে কলুষিত করে তুলছে, সেটিও তিনি আড়াল করতে চাইছেন। একদিকে দলের অনুগত থাকলে যে কোনও অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া, রাজনীতিকে অর্থ রোজগারের অন্যতম উপায়ে পরিণত করা, অন্য দিকে মদ ও মাদকদ্রব্যের ঢালাও ব্যবস্থা করে দিয়ে যুব সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়ে তাদের ভোট রাজনীতির বোড়েতে পরিণত করছেন। এই ভাবে রাজনীতিতে নৈতিকতার জায়গাটিকে তাঁরা খাটো করে চলেছেন। অবশ্য শাসক তৃণমূলের মতোই ভোট-সর্বস্ব সব শাসক দলই একই রাজনীতির চর্চা করে চলেছে।
সাধারণ মানুষকে আজ এ কথা বুঝতে হবে যে, রাজনীতিতে যদি মূল্যবোধকে, নৈতিকতাকে, রুচি-সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দেওয়া হয়, যে কোনও উপায়ে ভোটে জেতাকেই যদি রাজনৈতিক দলের শক্তি বলে ধরা হয়, তবে যত সিসি টিভি ক্যামেরাই বসানো হোক, বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়ে যত কড়াকড়িই সরকার করুক, এমন ঘটনা তাতে কোনও ভাবেই কমবে না। প্রশাসন যখন অপরাধের প্রশ্রয়দাতার ভূমিকায় থাকে তখন তার প্রতিকারে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হয়। ঠিক যেমন আরজিকরের ঘটনায় মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তবে এখন তা হতে হবে আরও সংগঠিত।