ভারত ইতিমধ্যেই এমন একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে যিনি দাবি করেন, ঈশ্বরের সাথে সরাসরি সংযোগে তিনি সক্ষম। মর্তের মানুষের গর্ভে নয়, তিনি ঐশ্বরিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন এবং যা কিছু তিনি করছেন সবই ঈশ্বরের নির্দেশে। দেশের মানুষ কি তা হলে এ বার এমন একজন প্রধান বিচারপতি পেল যিনিও ঈশ্বরের নির্দেশেই রায় দেন!
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় মহারাষ্ট্রের খেড়-এ নিজের গ্রাম কানহেরসারে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘প্রায়ই আমাদের সামনে এমন অনেক মামলা থাকে, যার কোনও সমাধান মেলে না। অযোধ্যার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছিল। আমার সামনে তিন মাস মামলাটা ছিল। আমি ভগবানের সামনে বসে বলেছিলাম, আপনাকেই এর সমাধান খুঁজে দিতে হবে। বিশ্বাস করুন, ঈশ্বরে আস্থা থাকলে তিনি রাস্তা দেখাবেন।”
অযোধ্যা মামলায় বিচারপতিরা তাঁদের মন্তব্যে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলাটাকে একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু রায় দেওয়ার সময়ে তাঁরা সে কথা বেমালুম ‘ভুলে গিয়ে’ ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গাটিকেই রামমন্দির তৈরির জন্য রামজন্মভূমি কমিটির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দেশ জুড়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, এই রায়ের সাথে আইনের সম্পর্ক কোথায়! কোন যুক্তিতে তাঁরা এমন রায় দিলেন? উত্তরে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা বলেছিলেন, ওই জায়গাটি রামের জন্মস্থান বলে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, তাই সেই বিশ্বাসকে মান্যতা দিতেই এই রায় দিয়েছেন। সেদিন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিলেন, তা যে সংবিধান তথা আইন মেনে দেননি, তা নিয়ে তাঁদের নিজেদের মনেও কোনও সন্দেহ ছিল না। সে কথাই উঠে এল এ বার প্রধান বিচারপতির কথায়।
প্রধান বিচারপতির অযোধ্যা রায়ের এই ব্যাখ্যা শুনে স্তম্ভিত দেশের সচেতন, গণতান্ত্রিক মনের মানুষ। প্রধান বিচারপতি তাঁর বিদায়ের আগে রায়ের এ কী ব্যাখ্যা দিলেন! এর মধ্যে আইন কোথায়? এ তো প্রধান বিচারপতির একান্ত নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয়। ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে এমন একটি স্পর্শকাতর মামলার তো বটেই, কোনও মামলার রায়ই কি দেওয়া চলে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের স্বাধীন অঙ্গ হিসাবে পরিচিত বিচারব্যবস্থায় বিচারকদের শপথ নিতে হয় যে, একমাত্র সংবিধান এবং আইন মেনেই ভয়হীন এবং পক্ষপাতহীন ভাবে, সাক্ষ্য ও প্রমাণের যথাযথ যাচাই করে তিনি বিচার করবেন। এ বিষয়ে অন্য কোনও কিছু দ্বারা তিনি প্রভাবিত হবেন না। বিচারব্যবস্থার প্রধান হয়েও তিনি সংবিধান এবং আইন মানার এই শপথকেই তো লঙ্ঘন করলেন! এর দ্বারা তাঁর দায়িত্বের প্রতি, পদের প্রতিই তো চরম অবমাননা করলেন।
ভারত একটি ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষ আচরণের কথা বলা হয়েছে তা কি শুধু নির্বাচিত বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বিচারপতিদের ক্ষেত্রে নয়? বরং বিচারপতিদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রযোজ্য। এই ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘন হচ্ছে কি না তাঁদের উপরই তো বিচারের ভার! আর তাঁরাই যদি সজ্ঞানে তা লঙ্ঘন করেন, তবে মানুষ বিচারের জন্য যাবে কোথায়! প্রধান বিচারপতি যদি জানেন, তিনি সম্পূর্ণ বেআইনি রায় দিয়েছেন, তবে তাঁর সেই কাজের দায় নিজে না নিয়ে কেন ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপালেন?
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, প্রধান বিচারপতি হঠাৎ এতদিন বাদে অযোধ্যা মামলা রায়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে তার এমন ব্যাখ্যা দিতে গেলেন কেন? তবে কি নিজের বাড়িতে গণেশ পুজোয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই ব্যাখ্যার কোনও সংযোগ আছে? অযোধ্যা রায় নিয়ে জনমনে যে সন্দেহ ছিল তা আরও দৃঢ় হয় যখন বেঞ্চ সদস্য, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ অবসরের পরেই বিজেপি মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। অপর সদস্য বিচারপতি এস এ বোবডে প্রধান বিচারপতি মনোনীত হন, এস আবদুর নাজির একটি রাজ্যের রাজ্যপাল এবং আর এক সদস্য ন্যাশনাল কোম্পানি ল অ্যাপিলেট ট্রাইবুনালের প্রধান হয়ে বসেন। সাধারণত সুপ্রিম কোর্টের কোন রায় কে লিখেছেন, তাতে সেই বিচারপতির নাম থাকে। অযোধ্যা রায়ের ক্ষেত্রে তা ছিল না। যদিও রায় দেখে অনেকেই আন্দাজ করেছিলেন, তা বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের লেখা। এ বার তাঁর এমন মন্তব্যের পর প্রশ্ন উঠছে, অবসরের আগে প্রধান বিচারপতি কি শাসকদের মনে করিয়ে দিলেন, অযোধ্যার রায় তিনিই লিখেছিলেন? স্বাভাবিক ভাবেই জনমনে এই প্রশ্ন উঠছে যে তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে কি অবসরের পর কোনও শাঁসালো পদে পুনর্বাসনের প্রশ্নটি জড়িত?
প্রশ্ন আরও যে, মসজিদ ভাঙাটা একটা ঘোরতর অপরাধ, এ কথা মেনে নেওয়ার পরও মসজিদের জমি সেই অপরাধীদের হাতেই তুলে দেওয়া কি শাসক বিজেপির কাছে নতি স্বীকার নয়? বিজেপি-সংঘ পরিবারের তোলা স্লোগান ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’র অনুসারী হিসাবে শাসককে সন্তুষ্ট করতেই কি তাঁর ন্যূনতম ন্যায়নীতি, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে একতরফা এই রায়? সেই রায়ে তিনি শুধু ধর্মের একটা মোড়ক দিলেন মাত্র– যা কোনও ভাবেই আইনের শাসনের সঙ্গে খাপ খায় না। এত দিন সাধারণ মানুষ যে ভাবত, কোথাও বিচার না পেলে অন্তত আদালতে সঠিক বিচার পাবে, তাঁর এই ভূমিকায় তা-ও ধূলিসাৎ হয়ে গেল। প্রধান বিচারপতি কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে তাঁর এমন মন্তব্যের যথার্থ তাৎপর্য কতখানি? বিচারব্যবস্থার উপর এর কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে?
এর পর কোনও মুসলিম বিচারপতি যদি ‘আল্লার নির্দেশ’ বলে তাঁর পছন্দ মতো কোনও রায় দেন তাকে কি আর অন্যায় বলা যাবে? তেমন হলে প্রধান বিচারপতি কিংবা হিন্দুত্ববাদী নেতারা তা মেনে নেবেন তো?
কিছু দিন আগেই প্রধান বিচারপতি তাঁর বাড়িতে গণেশ পুজো উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং সেই অনুষ্ঠানে উভয়ের উপস্থিতির ভিডিও সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন। সে দিনও বিচার বিভাগের প্রধানের সরকারের তথা শাসক দলের প্রধানকে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর মতো এমন নজিরবিহীন ঘটনায় দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এই ঘটনা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় যে সেই সমালোচনাকে কোনও গুরুত্ব দেননি, তা অযোধ্যা মামলা নিয়ে তাঁর বর্তমান ব্যাখ্যাতেই স্পষ্ট।
প্রধান বিচারপতি তাঁর এই ভূমিকার দ্বারা উচ্চ আদালত, নিম্নআদালত নির্বিশেষে বিচারপতিদের কি এই ইঙ্গিতই দিলেন না যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিভাজনের যে ব্যবস্থা রয়েছে সেই অনুযায়ী বিচারকদের সামাজিক, রাজনৈতিক সংসর্গ বাঁচিয়ে চলার যে রীতি রয়েছে তা মেনে চলার কোনও প্রয়োজন নেই। যে কোনও রাজনৈতিক দল বা তার নেতাদের সাথে বিচারপতিরা চাইলেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে পারেন কি? নানা স্তরের বিচারপতিরা যদি প্রধান বিচারপতির দেখানো রাস্তায় চলতে থাকেন তবে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বলে কি কিছু অবশিষ্ট থাকবে? এর দ্বারা তিনি দেশের মানুষকেই বা কোন বার্তা দিলেন? সংবিধানের আর্টিকেল ৫১এ(এইচ)-এ দেশবাসীর মধ্যে যে বিজ্ঞানভিত্তিক মনন (সায়েন্টিফিক টেম্পার) গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির আচরণ সেই প্রক্রিয়াতেই আঘাত করল না কি? যদিও বিচারপতি চন্দ্রচূড় দেশজোড়া সমালোচনার সামনে পড়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে নানা যুক্তি তুলছেন। বাস্তবে সে সব ধোপে টেকে না।
কেউ কেউ তাঁর বিচারক জীবনে নানা মামলায় ভাল রায়, নানা ভাল কাজের উল্লেখ করছেন। সে সব কোনও কিছুই এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। তাঁর এই দুটি কাজ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করে দিয়ে গেল তা মারাত্মক। যদিও একটি পুঁজিবাদী তথা শ্রেণিরাষ্ট্রে বিচারপতি নিয়োগ করে রাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে জনস্বার্থ নয়, শাসক শ্রেণি তথা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাই যে শেষ বিচারে তাঁর কাজ তা-ও প্রধান বিচারপতি আবার প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন এবং সে বিষয়ে আইনের দেবীর মতোই দেশবাসীর চোখের কাপড়ও তিনি খুলে দিলেন।