Breaking News

প্রকৃতি এবং পুঁজিবাদের সুষ্ঠু সহাবস্থান কি সম্ভব

উত্তরাখণ্ডের ধারালি গ্রাম যে দিন হড়পা বানে ভেসে গেল, তার দশ দিনের মাথায় লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন, ‘প্রকৃতি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে। গত কয়েক দিনে ধস, মেঘভাঙা বৃষ্টির ফলে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে।’ অক্টোবরের শুরুতে উত্তরবঙ্গ ভাসল ভয়াবহ বন্যায়। কমপক্ষে চল্লিশ জন প্রাণ হারালেন, অসংখ্য মানুষ ঘরবাড়ি-বিষয়আশয় হারিয়ে পথে বসলেন। বন্যার পরপরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় বললেন, ‘এই বিপর্যয় দুর্ভাগ্যজনক। দুর্যোগ তো আমাদের কারও হাতে নেই। আমরা মর্মাহত।’

দুটো বক্তব্যেরই মূল সুর এক রকম– প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে মানুষ অসহায়, এ সব প্রকৃতির খেয়াল। কাজেই শোকপ্রকাশ এবং ত্রাণের বিলিব্যবস্থা ছাড়া সরকারেরও তেমন কিছু করার নেই।

কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল বা রোষই যদি শেষ কথা হত, তা হলে আদিম অবস্থা থেকে প্রকৃতির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সভ্যতা এগোল কী করে? হিমালয়ের নানা অঞ্চল জুড়ে ঘন ঘন যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, তাকে নিয়ন্ত্রণের কি কোনওই উপায় ছিল না? বিজ্ঞানী-পরিবেশবিদরাও কি এই বিপর্যয়কে অবশ্যম্ভাবী বলছেন?

বাস্তবে, বছরের পর বছর পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা এবং স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করে সরকারগুলো প্রকৃতি এবং পরিবেশকে ধ্বংস করার একচেটিয়া অধিকার দিয়ে রেখেছে পুঁজিমালিকদের, যাদের আশীর্বাদের হাত মাথায় না থাকলে বিপুল অর্থব্যয়ে ভোটে জিতে আসা যায় না। এমনকি দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষদের যথাযথ পুনর্বাসন বা আগাম সুরক্ষা নিয়েও কোনও সরকারের তরফেই তৎপরতা বা সদিচ্ছা নেই। সাধারণ মানুষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং ক্ষোভের সামনে দাঁড়িয়ে এ সব কথা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের ওই প্রকৃতির পরীক্ষা, প্রকৃতির খেয়ালের কথা বলতে হয়।

উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ থেকে শুরু করে দার্জিলিং, কালিম্পং, সিকিম সর্বত্রই বিগত বেশ কিছু বছর ধরে পর্যটন ব্যবসার স্বার্থে অজস্র হোম-স্টে, রিসর্ট বহুতল বাড়ি ইত্যাদি তৈরি হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। এর সাথে আছে রাস্তা, রেলপথ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য পাহাড় ফাটিয়ে টানেল তৈরি, নির্বিচারে গাছ কাটা। বহু পাহাড়ি নদীর গতিপথ পাল্টে যাচ্ছে, গাছ কাটার ফলে মাটি আলগা হচ্ছে, বৃষ্টির জল মাটির খাঁজে ঢুকে ফাটল তৈরি করে সেই ফাটল বেড়ে একসময় ধস নামছে। ২০২৩-এর অক্টোবরে উত্তর সিকিমের চুংথামে লোনাক হ্রদের বাঁধ ভেঙে তিস্তায় হড়পা বান আসে। অজস্র মানুষ তলিয়ে যান, ভেসে যায় জাতীয় সড়ক এবং বারদাং সেনাছাউনি, প্লাবিত হয় উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলা। ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিস্তা স্টেজ ৩ নির্মীয়মাণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ, এই ভয়াবহ ধ্বংসের পরেও পাহাড় কেটে রাস্তা-রেল তৈরি, পর্যটনের নামে পাহাড়ের স্বাভাবিক ভূ-বৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নির্বিচারে অপরিকল্পিত নগরায়ন এতটুকু কমেছে কি? এর ফলে ইতিমধ্যেই নদীর স্বাভাবিক গতিপথ, নাব্যতা অনেকখানি ব্যাহত হয়েছে, বর্ষা একটু বেশি হলেই নদী উপচে জল উঠে আসছে জাতীয় সড়কে। একের পর এক দুর্ঘটনা, জীবনহানি, বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণী, স্থানীয় অভিজ্ঞতা– কোনও কিছুতেই এ সব থেমে থাকছে না। কাজেই ‘দুর্যোগ আমাদের হাতে নেই’ বলে মুখ্যমন্ত্রী যতই স্তোকবাক্য দিন, তথ্য বলছে হাতে অনেক কিছুই ছিল, সরকার-প্রশাসনের সচেতন হস্তক্ষেপের অভাবে যা ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।

উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরপরই সরকারি তরফে ‘মেঘভাঙা বৃষ্টি’র তত্ত্ব আনা হল। যদিও বিজ্ঞানীরা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন মেঘভাঙা বৃষ্টি আদৌ এর একমাত্র কারণ নয়। একের পর এক বিপর্যয় উত্তরাখণ্ডের ওপর আছড়ে পড়ছে বারবার। ২০২১ এর ফেরুয়ারিতে হিমবাহ ভেঙে পড়ে নির্মীয়মাণ ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ২০০ শ্রমিকের মৃত্যু এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ১৫০০ কোটি টাকা অপচয়ের পরও আবার সম্প্রতি নতুন করে শুরু হয়েছে প্রকল্পের কাজ। ২০২৫-এ ঘটল ধারালির বিপর্যয়। এর বাইরেও ছোটখাটো বহু দুর্ঘটনা তেমন করে আসেনি সংবাদপত্রে। এই ধারাবাহিক ভয়াবহতাকে যারা শুধুমাত্র ‘প্রকৃতির পরীক্ষা’ বলে দায় সারছেন, তাদের মনে করিয়ে দেওয়া উচিত ১৯৭৬-এ গঠিত মহেশ চন্দ্র মিশ্র কমিটির রিপোর্ট। উত্তরাখণ্ডের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোশীমঠ এলাকার ভূ-প্রকৃতি, ধসের কারণ ইত্যাদি খতিয়ে দেখে এই কমিটি ওই অঞ্চলে ভারী নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রাচীন ভূমিধসের ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা যোশীমঠ যে অত্যন্ত দুর্ঘটনাপ্রবণ, ক্রমাগত নির্মাণকাজ আরও ক্ষতি করছে এবং বিপদ ডেকে আনছে, এ সবই সেই কমিটির রিপোর্টে ছিল। গাছপালা লাগিয়ে, সঠিক নিকাশি ব্যবস্থা চালু করে ক্ষতি আটকানোর প্রস্তাবও ছিল সেখানে। কোনওটাই মানা হয়নি, বরং ক্রমাগত বেড়েছে একের পর এক রাস্তা, সেতু, হোটেল নির্মাণ। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে যোশীমঠের বাড়িগুলোতে ফাটল ধরছে, এলাকাটি ক্রমশ বসে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রতিবাদ করেছেন, গড়ে উঠেছে ‘যোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি।’ ২০১০-এ যখন ওই অঞ্চলে ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করে তখনও আন্দোলন হয়, স্থানীয় মানুষ তাদের বাসস্থানের বিমা করানোর দাবি জানান এবং হাই পাওয়ার কমিটির সাথে সেই মতো চুক্তিও হয়। অথচ সে বিমা আজও হয়নি। তার মধ্যেই ঘটে গেছে ২০১৩, ২০২১-এর সাংঘাতিক দুর্ঘটনা।

২০২১-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, উত্তরাখণ্ড রাজ্য দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ ২০১২ থেকে ২০২১-এর মধ্যে রাজ্যের ৪৬৫টি গ্রামকে চিহ্নিত করেছিল, সেগুলির বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে। এক দশকে মাত্র ৪৪টি গ্রামের পরিবার স্থানান্তরিত করা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে আরও অগ্রগতির কথা। উত্তর ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর একটা বড় অংশই ভঙ্গিল হিমালয়ের নানা অঞ্চলে গড়ে উঠছে এবং বিগত দশ বছরের মধ্যেই একাধিকবার বন্যা আর ধসে এ সব জলাধার ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মানুষ, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু। ২০১৩-তে কেদারনাথের বিপর্যয়ের পর গঠিত রবি চোপড়া কমিটি ওই রাজ্যে অন্তত ২৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, কারণ সেগুলো ওই অঞ্চলের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। বিভিন্ন সময় ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলনের পর সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টও এ সব মনুষ্যসৃষ্ট কারণের কথা বলেছে। কিন্তু সে সব তুড়ি মেরে উড়িয়েই গোটা হিমালয় জুড়ে এখন ৮১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে, চলছে আরও ৩২০-টির জন্য প্রস্তুতি। অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং জেলায় এমন একটি মাল্টিপারপাস জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের লাগাতার বিরোধিতা করছেন স্থানীয় মানুষ, কারণ এতে তাঁদের পরিবেশ, প্রকৃতি, বাসভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁদের কথা শোনা হবে, উত্তরাখণ্ডের মতোই পরিণতি একদিন অরুণাচলের মানুষেরও হবে না, এমন আশা-ভরসা কম। প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা খরচ করে এবং পরিবেশ আইনকে সম্পূর্ণ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে হিন্দু তীর্থক্ষেত্রের চারটি অঞ্চলকে যুক্ত করে ‘অল ওয়েদার রোড’ তৈরির চারধাম প্রজেক্ট। তাই ৯০০ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা তৈরির অনুমতি পরিবেশ আইনে আটকে যাবে জেনে, সুকৌশলে প্রকল্পটিকে ৫২টি ভাগে ভেঙে দিব্যি আদালতের ছাড়পত্র আদায় করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে ধস নেমেই ২০২৩-এ সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে মরতে বসেছিলেন ৪১ জন শ্রমিক। চারধামকে হৃষীকেশ থেকে রেলপথে যুক্ত করার ৪৪০০০ কোটির প্রকল্পও ঘোষণা হয়েছে। তার জন্য পাহাড় খুঁড়ে, গাছ কেটে, মাটি ধসিয়ে তৈরি হবে আরও ৫২টি টানেল, ৫৯টি সেতু। ২০২১, ২০২৩ এবং এই সাম্প্রতিকতম ধারালি বিপর্যয়ের পেছনেও এই চারধাম প্রকল্পের ভূমিকার কথা স্পষ্ট করে বলেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। তাতে সরকারের কিছু এসে যায় না। কারণ, বিজেপি নেতামন্ত্রীরা জানেন, তীর্থযাত্রীদের বা স্থানীয় মানুষের মৃত্যুর জ্বালা তবু কয়েক বছরে নিভে যাবে, বছরের পর বছর কেন্দ্রের গদিটি ধরে রাখতে গেলে হিন্দুরাষ্ট্রের সুড়সুড়িই সম্বল।

শুধু উত্তরাখণ্ডেই বিপদ, এমন নয়। ২০২৪-এর জুলাইতে কেরলের বৃষ্টি আর বন্যায় ঝরে গেছে তিনশোর বেশি প্রাণ। আসাম, কাশ্মীর, উত্তরবঙ্গ– দেশ জুড়ে বিপন্ন অঞ্চলের তালিকা ক্রমশ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী এক দিকে দেশের স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মা-কে স্মরণ করে একটি করে গাছ লাগানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। আর কয়লাখনি-বিদ্যুৎ সহ নানা প্রকল্পে বড় বড় একচেটিয়া গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে দেশের লক্ষ লক্ষ একর বনভূমি। ২০১৫ থেকে ২০২০-র মধ্যে প্রতি বছর ৬ লক্ষ ৬৮ হাজার ৪০০ হেক্টর বন-আচ্ছাদন ধ্বংস হয়েছে ভারতে। চিপকো আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, দেউচা পাঁচামির কয়লাখনি নিয়ে আন্দোলন সহ নানা অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি পরিবেশ বাঁচাতে, জল-জঙ্গল-জমি রক্ষায় সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে জোট বেঁধেছেন। অথচ দেশে বিদেশে নানা মঞ্চে, জলবায়ু সম্মেলনে পরিবেশ সংক্রান্ত বাণী দিয়ে হাততালি কুড়োন যে নেতা-মন্ত্রীরা, তাদের পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনের সমর্থনে নামতে দেখা যায়নি। বরং মানুষের প্রতিবাদ-আন্দোলনকে দমন করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিবেশ নষ্ট করার কাজই চলছে জোরকদমে।

মানুষের জীবনকে বাজি রেখে নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংসের এই যজ্ঞ আগামী দিনে আরও বাড়বে, কারণ এটাই পুঁজিবাদের নিয়ম। ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ বইতে এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন, প্রকৃতির মধ্যেই মানুষের অবস্থান এই সত্যকে স্বীকার করে প্রকৃতি থেকে প্রয়োজন মেটানো, প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম এবং সহাবস্থান, এই দৃষ্টিভঙ্গিই হল মূল কথা। বিদেশি শত্রুর ওপর জোর খাটানোর মতো প্রকৃতির ওপর জোর খাটানো যায় না। তাই প্রকৃতিকে সাধারণ মানুষের কাজে লাগানো হবে, নাকি তাকে ধ্বংস করে পুঁজিমালিকদের মুনাফার প্রাসাদ তৈরি হবে, সেটা ঠিক করে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক নিয়ম। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বুনিয়াদটাই গড়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মুনাফা এবং একমাত্র মুনাফার ওপর। পুঁজির চোখে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদের ভাণ্ডার, লালন করার, মানুষের জীবনকে উন্নত করার জিনিস নয়, শুধুমাত্র লুট করার জিনিস, এঙ্গেলস যাকে বিদেশি শাসকের পরদেশ লুণ্ঠনের সাথে তুলনা করেছিলেন। এই পুঁজিবাদ এক দিকে মানুষের জীবনকে, পরিবেশকে বিপন্ন করে মুনাফার স্বার্থে ধ্বংসলীলা চালায়, বিজ্ঞানের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই সে এ কাজ করে। অন্য দিকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য, তাদের বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য পরিবেশপ্রেমের মুখোশ তাকে পরতেই হয়। তাই চারপাশে তাকালেই দেখা যাবে, গাছ লাগানো, প্লাস্টিক ব্যবহার না করা, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমানোর মতো বিষয়গুলোর দায় বারবার ঠেলে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের দিকেই। প্রবল গরমে এসি-র ব্যবহার বাড়ছে, ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে, ঠিক। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে বনভূমি ধ্বংসের ফলে তার কতগুণ বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস পরিবেশে মিশছে, খোলামুখ কয়লাখনি থেকে কতটা বিষাক্ত গ্যাস বেরোচ্ছে এ সব তথ্য-হিসেব পেছনে চলে যায়। বিকল্প কিছু না পেয়ে যে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহার করতে কিছুটা বাধ্য হন, কংক্রিটের জঙ্গল যাদের সবুজ উঠোন গ্রাস করে একটু রোজগারের আশায় যে পার্বত্য মানুষরা পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বুঝেও চুপ করে থাকেন, তাদের পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী করে আসলে ঢাকতে চাওয়া হয় প্রোমোটার-ঠিকাদার-ব্যবসায়ী-সরকার চক্রের আঁতাত। মূল প্রশ্নকে গুলিয়ে দিতে বলা হয়– ‘তা হলে কি উন্নয়ন হবে না? পাহাড়ে বিদ্যুৎ আসবে না? মানুষ বেড়াতে যাবে না? পর্যটন থেকে পাহাড়বাসীরা আয় করবেন না’? এ সবের উত্তর কিন্তু জটিল নয়। যে অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক নগরায়ন অদূর ভবিষ্যতে ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে, তাকে আদৌ ‘উন্নয়ন’ বলা যায় কি? অনিশ্চিত এবং বিপদসংকুল পর্যটনই কেন আজও পাহাড়ের মানুষের একমাত্র রোজগার হবে? এই অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচাতে তাদের নিরাপদ কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা কেন করবে না সরকার? রেল-রাস্তা-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে, পরিবেশের ক্ষতি যতদূর সম্ভব কম করে নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ কেন নেওয়া হবে না? এ সব প্রশ্নকে ঢাকতে কখনও পুণ্যার্জনের, কখনও বিলাসবহুল রিসর্টের বারান্দা থেকে পাহাড়ি সূর্যাস্তের হাতছানি দিয়ে উন্নয়নের গল্প শোনাতে হয়, যে ‘উন্নয়ন’ আসলে গর্ত ভরা মেঝের ওপর বাহারি কার্পেট পেতে দেওয়ার মতোই মিথ্যে।

পরিবেশকে ভালোবেসে গাছ লাগানো, প্লাস্টিক বর্জনের মতো কাজগুলি নিশ্চয়ই জরুরি, জরুরি এলাকায় এলাকায় পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে কিছুটা হলেও ঠেকানো যায় সমূহ বিপদ। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের আসল কাণ্ডারি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, এই সত্য জানা এবং জোরের সাথে জানানো প্রয়োজন। না হলে নিজেদের ঠকানো হবে, প্রতারণা করা হবে পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথেও।