Breaking News

পাঠকের মতামতঃ মোবাইলের হাতছানিতে বিপন্ন শৈশব

আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত এক যুবকের সমস্যা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। তার সঙ্গে দেখা হতে সে আমার হাত ধরে ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করল। বললাম, ‘কী হয়েছে তোর’? সে যা বলল তা আমাকেও তাৎক্ষণিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। সমস্যাটা মোবাইল নিয়ে। ‘মোবাইল’ যন্ত্রটি এখন মানুষের জীবনের সাথে গভীর ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে, বিশেষত মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে। মায়েরা শিশুদের শান্ত রাখতে বিশেষ করে বাচ্চাকে খাওয়ানোর যে পরিশ্রম সেটা এড়াতে মোবাইল হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে অধিকাংশ শিশু ওই বয়স থেকেই ধীরে ধীরে এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। অল্প বয়সে শিশুদের কৌতূহল প্রচুর। অপার বিস্ময়ে সে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক জগতের সাথে অতি দ্রুত পরিচিত হতে থাকে। এই সময় মোবাইলে তার আসক্তি জন্মালে সে প্রতিনিয়ত মোবাইল নিয়ে ঘাঁটতে থাকে। বিভিন্ন আইকন বা বোতাম টিপে নতুন নতুন জগত বা সাইটে প্রবেশ করতে থাকে। নতুন নতুন খেলা বা কার্টুনের সিরিজ দেখতে দেখতেই কখন সে নিজের অজান্তেই যে হাজার হাজার পর্নোগ্রাফিক সাইট আছে তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে, সে নিজেও জানে না। প্রথম প্রথম অবাক হলেও আস্তে আস্তে এই পর্নোগ্রাফি তাকে আসক্ত করে তোলে। আজকাল মনোবিদরাও এটা লক্ষ করেছেন যে, সাত আট বছর বয়স থেকেই শিশুরা ক্রমশ পর্নোগ্রাফিক সাইটে ঢুকে পড়তে শুরু করছে, বিশেষ করে যে সব বাড়িতে অভিভাবকদের নজরদারি কম এবং যে সমস্ত অভিভাবকরা নিজেদের চাকরি, জীবিকা বা ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাদের পক্ষে সন্তানদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া খুব কঠিন হয়ে ওঠে। অভিভাবকের সাহচর্যের অভাব শিশুদের মোবাইলের প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করছে।

আমার পরিচিত ওই যুবকের ন’বছরের মেয়েটি মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে, সেটা এই যুবক বা তার স্ত্রী বুঝতে পারেনি। প্রতিবেশী এক মহিলা এসে জানালেন এই ছোট মেয়েটি তার দশ বছরের ছেলের সঙ্গে একসাথে পর্নোগ্রাফি দেখছে এবং তিনি লক্ষ করেছেন, পর্নোগ্রাফি দেখতে দেখতে মেয়েটি যৌন উত্তেজনা জাগানোর মতো করে ছেলেটির শরীরে হাত দিচ্ছে। এটি দেখে তিনি দু-জনকেই খুব বকাবকি করেন এবং কীভাবে এটা ঘটছে বোঝার চেষ্টা করেন। জানতে পারেন বেশ কিছুদিন ধরেই এটা ঘটছে।

এই মেয়েটি শিশু বয়সে ভালো গান গাইত, ছবিও আঁকতে পারত। অভয়ার হত্যাকাণ্ডের পর অরিজিৎ সিংয়ের ‘আর কবে আর কবে’ গানটি মুখে মুখে অনেকের কাছে শুনে, সে তুলে ফেলেছে। কিন্তু তার সৃজনশীল ক্ষমতা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই বলে যুবকটি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘দাদা আমি আমার একমাত্র মেয়েকে কীভাবে বাঁচাবো, আপনি বলে দিন।’

আমি প্রথমে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘তুই তো জানিস এই সমস্যা আজ সমাজে সর্বব্যাপক। এটা একটা সামাজিক সমস্যা, কিন্তু যখন আমাদের নিজেদের ঘরে চলে আসে, তখন আমরা এটাকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা বলে মনে করি। এটা অত্যন্ত ভুল চিন্তা। বললাম, ওদের বাঁচাতে হলে ওদের সৃজনশীল ক্ষমতা ও ভাল দিকগুলোকে উৎসাহিত করা দরকার। সাথে সাথে দরকার শরীরচর্চা ও খেলাধূলা, ভাল ভাল গল্প পড়ে শোনানো, ছোটদের বইপত্র কিনে দেওয়া। এর সাথে অবশ্যই প্রয়োজন নবজাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত মনীষীদের, বিপ্লবীদের জীবনের কথা জানা। এই কথাটাই আমাদের দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ প্রতিটি সভায়, এমনকি প্রকাশ্য জনসভায় শুধু কর্মীদের নন, সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। তোর মতো অন্যান্য অভিভাবকও এই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। তোরা স্বামী, স্ত্রী দু-জনে মিলে তোদের মেয়ের সৃজনশীল ক্ষমতা, গান এবং আঁকা এগুলোকে উৎসাহিত কর। সাথে সাথে সপ্তাহে অন্তত একটা দিন, সম্ভব হলে প্রতিদিন শরীরচর্চা ও খেলাধূলার জন্য সময় দে। পরে জানা যায়, মেয়েটির সৃজনশীল দিকগুলোর প্রতি স্বামী, স্ত্রী দু-জনেই যত্ন নিচ্ছে এবং ধীরে ধীরে মেয়েটির অবস্থার উন্নতি ঘটছে।

দেবাশিস রায়, বি গার্ডেন, হাওড়া