Breaking News

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিঃ রোমানিয়ায় সম্মেলনে এসইউসিআই (সি)

১-৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘‘Marxism and the Sciences’’ (‘মার্ক্সবাদ ও বিজ্ঞান’)-এর উদ্যোগে ‘‘Philosophy and Sciences Towards an International Critical Knowledge Network’’  (দর্শন ও বিজ্ঞানঃ এক বিশ্লেষণাত্মক আন্তর্জাতিক জ্ঞানপ্রণালীর সন্ধানে) বিষয়ের ওপর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংগঠিত হয়। স্থান ছিল রোমানিয়ার পার্বত্য অঞ্চল ট্রান্সিলভানিয়ার ছোট্ট গ্রাম ‘‘হাইফা’’। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ আরও বহু দেশ থেকে প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

প্রতিনিধিদের মধ্যে কিছু জন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, বাকিরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মার্ক্সবাদী দর্শন বিষয়ে গবেষণারত। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড এস ব্যানার্জী ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এই সম্মেলনে যোগ দেন।

এই সম্মেলনে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বিজ্ঞানের ইতিহাস এবং আধুনিক সমাজের নানা সমস্যার মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ সংক্রান্ত বিষয়ে চুলচেরা আলোচনা হয়। কমরেড ব্যানার্জীর বক্তব্যটি সম্পূর্ণ আকারে নিচে প্রকাশ করা হল।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি

সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতন এবং বিশ্বে পুঁজিবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর প্রচার হয়েছে যে মার্ক্সবাদ ব্যর্থ। মার্ক্সবাদের দার্শনিক ভিত্তি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ওপরেও আক্রমণ নেমে এসেছে। বলা হচ্ছে যে এই দর্শন ‘পুরাতন’, ‘সেকেলে’, ‘যুগের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক’ এবং ইতিহাসবিদদের গবেষণার বিষয় মাত্র।

অথচ, বিজ্ঞান আজও এই দর্শনকে ভিত্তি করেই কাজ করে চলেছে। বিজ্ঞান বস্তুজগতের সত্য সন্ধান করে এবং তার ভিত্তিতে প্রকৃতিকে জানবার ও বিশ্লেষণ করবার তত্ত্ব তৈরি করে। বিজ্ঞানে কোনও একটি ধারণা কেবলমাত্র নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্যই, বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত মানসিকতা এবং দার্শনিক ভাবনা এই পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং তাঁদের চিন্তার অনুগামীরা অজান্তে বহু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ রুদ্ধ করেছেন তাঁদের বিশ্বাস এবং দার্শনিক চিন্তার প্রভাবের কারণে। অতএব, একটি সঠিক দর্শনের ভিত্তি ছাড়া বিজ্ঞানের অগ্রগতি অসম্ভব।

বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বিকশিত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদই সেই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যদিও অধিকাংশ বিজ্ঞানী হয়তো এ বিষয়ে সচেতন নন। অনেকে মনে করেন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কেবল মাত্র ‘তিনটি নীতির’ সমষ্টি। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উদ্ভবের আগে যান্ত্রিক বস্তুবাদ এবং অধিবিদ্যার (metaphysics) চিন্তাধারা প্রধান ছিল। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বিকাশের প্রক্রিয়ায় মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এই দুই ধারার দুর্বলতাগুলি সমালোচনামূলক ভাবে বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে পরিচালিত করার জন্য এক বিকল্প বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেন। পরবর্তী কালে পজিটিভিজমের (positivism) দ্বারা তৈরি বিভ্রান্তির মেঘ দূর করে লেনিন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অবস্থান আরও সুসংহত করেন।

অধিবিদ্যা ও যান্ত্রিক বস্তুবাদের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির পার্থক্য

দর্শনের দুই প্রধান চিন্তাধারা–বস্তুবাদ এবং ভাববাদের মধ্যে বিজ্ঞান দৃঢ় ভাবে ভাববাদের বিরুদ্ধে বস্তুবাদের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিজ্ঞান শুরুই করে এই ভিত্তি থেকে যে বস্তুজগতের অস্তিত্ব চেতনা নিরপেক্ষ। বিজ্ঞানীদের পক্ষে কাজ করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, যদি তাঁদের ধরে নিতে হয়, যে বস্তুগুলি নিয়ে তাঁরা গবেষণা করবেন সেগুলির বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই অথবা সেগুলি আসলে কোনও আদি ও অতিপ্রাকৃতিক ভাবজগতের থেকে সৃষ্ট।

অধিবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গি জগতের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ধরে নিয়েছে যে সকল বস্তুর চরিত্র স্থায়ী এবং স্থিতিশীল। তাদের কোনও পরিবর্তন বা বিকাশ হয় না। অধিবিদ্যার চিন্তাপদ্ধতি নিয়ে যাঁরা চলেন তাঁরা প্রতিটি বস্তুকে যেমন রূপে দেখা যাচ্ছে সেটুকুই বোঝার চেষ্টা করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে কোনও বস্তুর একটি সহজাত গুণ বা ধর্ম আছে যা তার অস্তিত্বের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল নয়। অধিবিদ্যার চিন্তা প্রত্যেক বস্তুকে অন্য সকল বস্তুর থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখে এবং মনে করে যে সকল বস্তুর চরিত্র চিরস্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দেখাল যে, জগৎ পরিবর্তনহীন বস্তুর সমাহার নয়। বরং বস্তুজগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন এবং বিকাশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে কিছু জিনিসের সৃষ্টি এবং কিছু জিনিসের অবলুপ্তি ঘটেই চলেছে। অতএব, বিজ্ঞানের কাজ হবে বস্তুকে তার পরিবর্তন এবং বিকাশের ধারায় বিশ্লেষণ করা, তাদের অস্তিত্বে আসা এবং অবলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা। তাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ শুধুমাত্র বস্তুকে জানাই নয়, বরং তার পরিবর্তন ও সৃষ্টি-বিলোপের প্রক্রিয়াগুলিকে জানার উপরেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। বলে যে, জগতকে একটি বস্তুর সমাহার হিসেবে না দেখে বরং একটি প্রক্রিয়ার সমাহার হিসেবে দেখা উচিত, যার মাধ্যমে বস্তুগুলি প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তাদের সৃষ্টি ও অবলুপ্তি হয়ে চলেছে।

দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি শেখায় যে, প্রতিটি বস্তু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের দ্বারা নির্ধারিত। তাই বিজ্ঞানে কখনওই বস্তুকে পারিপার্শ্বিক জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা উচিত নয়, বরং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং একে অপরের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। যে কোনও বস্তুকে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে পৃথক করে তার চরিত্র নির্ধারণ করা উচিত নয়। বরং, একটি বস্তুর চরিত্র পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে কী ভাবে পরিবর্তিত হয়, তা নির্ধারণ করাই বিজ্ঞানের কর্তব্য।

নিউটন-পরবর্তী যুগে যান্ত্রিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে প্রচলিত ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি গোটা বিশ্বকে একটি মস্ত বড় যন্ত্র হিসেবে দেখে, যে যন্ত্রের প্রত্যেকটি অঙ্গ তার নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে চলেছে। একটি যন্ত্র নিজের জীবদ্দশায় একই ভাবে কাজ করে চলে, তার যান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অনবরত চালিয়ে যায়। কাজেই, যান্ত্রিক বস্তুবাদীরা বস্তুর পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এমন কিছুর সন্ধান করতেন যার কোনও পরিবর্তন হয় না, যা চিরস্থায়ী। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে, বস্তুজগৎ আসলে অপরিবর্তনীয় এবং যে সব পরিবর্তন আমরা দেখি তা একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি মাত্র, যা যান্ত্রিক নিয়মাবলির দ্বারা পরিচালিত। যান্ত্রিক বস্তুবাদ বস্তুজগতের পরিবর্তনকে একই প্রক্রিয়ার ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখত। এঙ্গেলস তাঁর ‘ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার’ গ্রন্থটির ভূমিকায় বলেন, ‘‘এই যুগের সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যে, প্রকৃতিকে একটি অপরিবর্তনীয় শাশ্বত কিছু হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা’’।

যান্ত্রিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎ কঠিন ও অভঙ্গুর কণা দিয়ে তৈরি। তারা বিশ্বাস করত যে প্রকৃতির সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা এই কণাগুলির ওপর বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলের প্রভাব এবং কণাগুলির নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়েই নির্ধারণ করা সম্ভব। যান্ত্রিক বস্তুবাদের মূল সমস্যা হল সে বস্তুকে জড় পদার্থ হিসেবে দেখত, যার নিজের কোনও গতি নেই এবং সমস্ত গতি বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলের প্রভাবের ফল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের আবিষ্কার পরিষ্কার ভাবে দেখায় যে, সকল প্রকারের শক্তি আসলে গতিশীল বস্তু (ম্যাটার ইন মোশন) ছাড়া কিছুই নয়। যখন এক রকম শক্তির আরেক রকম শক্তিতে রূপান্তর ঘটে, আসলে তখন গতিরই রূপান্তর ঘটে। গতি সর্বব্যাপী এবং চিরস্থায়ী, কোনও কিছুই সম্পূর্ণ স্থির নয়। এই সব আবিষ্কারের ভিত্তিতেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করে যে গতিহীন বস্তুর অস্তিত্ব সম্ভব নয় এবং বস্তু ছাড়া গতিরও কোনও মানে হয় না। ‘বিশ্বে গতিশীল বস্তু ছাড়া আর কিছুই নেই’– লেনিন বললেন, ‘এবং এই গতিশীল বস্তু স্থান ও কালের বাইরে অবস্থান করতে পারে না।’ অতএব, বস্তুর চরিত্র সম্বন্ধে সঠিক ধারণা হল, গতি হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্বের ধরন (mode of existence)।

এটাও বোঝা গেল যে, কোনও বস্তুর নানা আলাদা আলাদা অংশের পরস্পরের ওপর যান্ত্রিক বলের আদানপ্রদানের দ্বারা বস্তুর সমস্ত পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যদি এমনটাই হত, তা হলে একটি বস্তুর সামগ্রিক ধর্ম তার আলাদা আলাদা অংশের ধর্মের সমাহারমাত্র হত। কিন্তু বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (যেমন কোষ-তত্ত্ব) প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই ধারণা সত্য নয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দেখাল যে বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক আদানপ্রাদান একটি বিশেষ স্তর অতিক্রম করলে সেই বস্তুর মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে পারে। একটি বস্তুকে ক্ষুদ্র অংশে ভেঙে বিচ্ছিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণের দ্বারা তার সামগ্রিক গুণ সম্বন্ধে কখনওই সত্য ধারণা করা যায় না। এই ভাবে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আসলে বিজ্ঞানকে রিডাকশনিজম-এর প্রভাব থেকে মুক্ত করেছে।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি প্রধান নীতি এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োগ

বস্তুর পরিবর্তন এবং বিকাশের প্রক্রিয়া ক্রমশ বিজ্ঞানের প্রধান গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে মার্ক্স ও এঙ্গেলস দেখান, এই গবেষণা পরিচালনার মূলনীতি কী হওয়া উচিত। যে কোনও বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করতে গেলে যে কেউ নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হবে–

বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন কেন ঘটে? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দেখাল, যে কোনও বস্তুর মধ্যে একাধিক পরস্পরবিরোধী শক্তির দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং এদের এই ক্রমাগত চলতে থাকা দ্বন্দ্ব ও ঐক্যই বস্তুর পরিবর্তনের মূল কারণ।

বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন কী ভাবে ঘটে? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দেখাল যে এই পরিবর্তন দুই রকমের হয়–পরিমাণগত এবং গুণগত। পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া একটি বিশেষ পর্যায় অতিক্রম করার পরেই বস্তুর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এই গুণগত পরিবর্তনের ফল কী? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দেখাল যে গুণগত পরিবর্তনের ফলে বস্তুর আগের সত্তা বিলুপ্ত হয় এবং নতুন সত্তার সৃষ্টি হয়।

আধুনিক বিজ্ঞান ঠিক এই পদ্ধতি মেনেই কাজ করে

যদিও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তিন সূত্র সম্পূর্ণ ভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তবু যেহেতু বিজ্ঞানের অধিকাংশ বইয়ে এর উল্লেখ থাকে না, তাই অধিকাংশ বিজ্ঞানী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নীতির প্রভাব সম্বন্ধে অসচেতন থেকে যান। যেমন, বিজ্ঞান বইয়ে দ্বন্দ্ব বা কনট্রাডিকশন শব্দটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। অথচ একজন বিজ্ঞানী যখন কোনও একটি বস্তুর মধ্যে বলের ভারসাম্য সম্বন্ধে কোনও সমীকরণ লিখতে যাবেন তখনই তাকে ‘ইউনিটি অফ অপোজিটস’-এর নীতি প্রয়োগ করতে হবে। তিনি সম্পূর্ণ অজান্তেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রয়োগ করবেন তাঁর গবেষণায়। আমাদের দায়িত্ব সকল বিজ্ঞানকে এই বিষয়ে অবগত করা, যাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ সচেতন ভাবেই করা হয়।

নিউটনীয় মেকানিক্স কয়েকটি বস্তুর দ্বারা গঠিত একটি সিস্টেমের পরিবর্তনের নিয়মকানুন জানার চেষ্টা করে অংশগ্রহণকারী বস্তুগুলির অবস্থান এবং গতিবেগের ভিত্তিতে। পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের গতিপথ জানতে গেলে প্রথমে চাঁদ এবং পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থান ও গতি জানতে হবে, আর তারপর সমীকরণ লেখা হবে এই দুই বস্তুর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ বল ও অপকেন্দ্রিক বলের ভিত্তিতে, যারা একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ করে। অর্থাৎ এই দুই বলের মধ্যে আমরা এই সিস্টেমের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। যে কোনও বস্তুর পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে যে সমীকরণ ব্যবহার হয়, তা বাস্তবে তার মধ্যে পরস্পরবিরোধী বলগুলির ভিত্তিতেই লেখা হয়। অতএব, এইসব সমীকরণ ইউনিটি অফ অপোজিটস-এর নীতি মেনেই কাজ করে। তাই বিপরীত বল বা প্রবণতার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রামই হচ্ছে যে কোনও বস্তুর পরিবর্তন ও বিকাশের কারণ।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের আরও দেখায় যে বস্তুর ভিতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বই একটি বস্তুর পরিবর্তনের প্রধান কারণ। বহির্দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ বাইরের বস্তুর প্রভাব, যদিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের দিকনির্ণয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভূমিকা রাখে, তা ক্রিয়া করে এই অন্তরদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। নক্ষত্রের বিবর্তনের প্রক্রিয়া যদি আমরা দেখি তা হলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যখন বিজ্ঞানীরা সূর্যের মতো কোনও নক্ষত্রের বিবর্তনের প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেন, তাঁরা আদতে ওই নক্ষত্রের অন্তরদ্বন্দ্বকেই জানার চেষ্টা করেন। নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ তার শরীরকে কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত করার চেষ্টা করে। আবার নক্ষত্রের অন্তরে যে তাপীয়-নিউক্লিয় বিক্রিয়া (ফিউশন) অনবরত চলছে তার থেকে নক্ষত্রের কেন্দ্রভাগে বিপুল তাপ উৎপন্ন হয়। তার ফলে অন্তর্ভাগে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়, যা নক্ষত্রের বস্তুকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। অর্থাৎ নক্ষত্রের ভিতরে দুটি বিপরীতমুখী বল ক্রিয়া করে, আর নক্ষত্রটির স্থায়িত্ব নির্ভর করে এই দুই বিপরীত বলের ভারসাম্যের উপর। ঠিক এই অন্তরদ্বন্দ্ব নিয়েই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন, যা আসলে ইউনিটি অফ অপোজিটস ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন’– এর নীতি তৈরি হয়েছিল জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং যে কোনও বস্তুর ভৌত অবস্থা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করার মাধ্যমে (যেমন বরফ গলে জল হওয়া)। নিউটনীয় মেকানিক্সের মধ্যে সরাসরি ভাবে পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তনের কথা বলা হয় না। একটি সিস্টেমের অবস্থা এবং তার গতিশীলতার ক্ষেত্রে যে মৌলিক গুণগত পরিবর্তন ঘটে তা অতিসাম্প্রতিক কালে স্বীকৃতি পেয়েছে। পদার্থবিদ্যায় এইসব গুণগত পরিবর্তন ‘‘ফেজ ট্রানজিশন অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল ফেনোমেনা’’ নামে আলোচিত হয়। এইরকম গুণগত পরিবর্তনের কিছু উদাহরণ হচ্ছে ধাতুর চুম্বকীকরণ (magnetisation), অতিপরিবাহিতা (superconductivity), অতিপ্রবাহিতা (superfluidity), বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট ইত্যাদি। একটি বস্তুর গতিধারায় গুণগত পরিবর্তনকে bifurcation বলা হয় (যেমন পুনরাবৃত্ত গতি থেকে অনিয়মিত গতি)। এইসব ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার সর্বব্যাপী প্রাসঙ্গিকতা বারংবার প্রমাণিত।

দ্বন্দ্বতত্ত্বে যে ‘ভাইস-ভার্সা’ বা গুণগত পরিবর্তন থেকে পরিমাণগত পরিবর্তনের কথা বলা হয়, তার দ্বারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিক যে প্রক্রিয়া, তাকেই সাধারণত বোঝানো হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখায়, একটি বস্তুর মধ্যে যখন পরিমাণগত পরিবর্তন একটি বিশেষ পর্যায় অতিক্রম করে, তখন সেই বস্তুর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তনের দ্বারা বস্তুর আগের অস্তিত্বের অবলুপ্তি ঘটে এবং এক নতুন অস্তিত্ব শুরু হয়। কিন্তু পরিবর্তন ও বিকাশের যে ক্রমাগত ধারা তা অব্যাহত থাকে। এই নতুন অস্তিত্বের মধ্যে আবার পরিমাণগত পরিবর্তন শুরু হয়, যা এক সময়ে আবার গুণগত পরিবর্তনের জন্ম দেয়। এই প্রক্রিয়া অনবরত চলতে থাকে। এঙ্গেলস তাঁর ‘ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার’ বইটিতে এই ‘ভাইস-ভার্সার’ উদাহরণ দেখিয়েছেন, যেমন তাপশক্তি যান্ত্রিক গতিতে পরিবর্তিত হয় এবং আবার যান্ত্রিক গতি থেকে তাপশক্তির উদ্ভব ঘটে।

ভারতবর্ষের একজন বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ এই ধারণাকে আরও উন্নত করেন এবং দেখান যে ‘পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন’ এবং ‘ভাইস-ভার্সা’ দুটোই পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একই সঙ্গে ঘটে এবং একটি বস্তুর মধ্যে ক্রমাগত পরিবর্তন আনে। উনি দেখান যে, প্রত্যেক পরিমাণগত পরিবর্তনের মধ্যেই অজস্র গুণগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রত্যেক বস্তু কিছু ‘মৌলিক উপাদান’ দিয়ে গঠিত। এক গ্লাস জলের উপাদান যেমন অজস্র জলকণা, ঠিক তেমন ভাবেই একটি বিশেষ প্রাণী বা উদ্ভিদ প্রজাতির উপাদান হচ্ছে সেই প্রজাতির একেকটি জীব এবং একটি সমাজের উপাদান হচ্ছে এক একটি ব্যক্তি-মানুষ। যখন একটি সমষ্টির কিছু পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে, তখন তার এই মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে গুণগত পরিবর্তন ঘটে যায়। যখন এক গ্লাস জলের তাপমাত্রা বাড়ে (পরিমাণগত পরিবর্তন), কিছু জলের কণা বাষ্পে পরিণত হয় (গুণগত পরিবর্তন)। যখন একটি পুঁজিবাদী সমাজে পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে, সেই সমাজের ব্যক্তি মানুষেরা গুণগত পরিবর্তনের দ্বারা বিপ্লবী হয়ে ওঠে এবং এই প্রক্রিয়ার পথে এক সময় গোটা সমাজব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটে। অতএব, পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন একে অপরের থেকে অবিচ্ছেদ্য এবং দুটো প্রক্রিয়াই ক্রমাগত একই সাথে ঘটে চলেছে।

বিজ্ঞানের দুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রবাবিলিটি (সম্ভাবনা) এবং ডিটারমিনিজম (নির্ধারণবাদ)। অনেকে মনে করেন যে এগুলো পরস্পরবিরোধী, যদি কোনও কিছু নির্ধারণবাদ মেনে চলে, তা হলে সেখানে সম্ভাব্যবাদের কোনও ভূমিকা নেই এবং কোনও কিছু যদি সম্ভাব্যবাদের নিয়ম মেনে চলে, তা হলে তা নির্ধারণবাদের নিয়ম লঙ্ঘন করে। এই বিশ্বাস থেকে নানা বিপত্তি সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে বিজ্ঞানের কিছু সাম্প্রতিক কালের আবিষ্কার সংক্রান্ত বিষয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়, যেমন কোয়ান্টাম মেকানিক্স।

কোয়ান্টাম জগতে, কণার গতিবিধি সম্ভাব্যতার দ্বারা নির্ধারিত হয়। হাইজেনবার্গের আনসার্টেন্টি প্রিন্সিপল (অনিশ্চয়তা তত্ত্ব) বলে যে, একটি ক্ষুদ্র কণার অবস্থান ও ভরবেগ (ভর X গতিবেগ) একই সাথে সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা যায় না। একটি কণার অবস্থান যত নিখুঁত ভাবে নির্ধারিত হয়, তার গতিবেগ তত অনিশ্চিত হয়ে যায়, এবং গতিবেগ নিখুঁত ভাবে নির্ধারণ করলে তার অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে যায়। এটি একটি প্রাকৃতিক নিয়ম– যদি একটি কণার একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ থাকে, তা হলে তার অবস্থান কখনওই এক স্থানে নির্দিষ্ট থাকবে না। তার অবস্থান যে কোনও স্থানে হতে পারে (অবশ্যই একটি সীমার মধ্যে) এবং বিভিন্ন স্থানে থাকার যে সম্ভাব্যতা তা গাণিতিক ভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব।

এই অনিশ্চয়তা থেকে কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের মনে এই ধারণা জন্মায় যে কোয়ান্টাম জগতে কার্যকারণ সম্পর্ক এবং নির্ধারণবাদ কাজ করে না। কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার যে কণার অবস্থান বা গতিবেগ বিশৃঙ্খল বা নিয়মহীন নয়। এই গতিবেগ সম্পূর্ণভাবে নিয়মে বাঁধা, যে নিয়ম সম্ভাব্যবাদের সূত্রের দ্বারা নির্ধারিত। কোয়ান্টাম তত্ত্বে সম্ভাবনা নির্ধারিত হয় নির্ধারণবাদী নিয়মভিত্তিক প্রক্রিয়ার দ্বারা। কাজেই এ কথা ভুল যে কোয়ান্টাম জগতে সম্ভাব্যবাদের সূত্র নির্ধারণবাদ বিরোধী। শিবদাস ঘোষ বলেন, ‘নির্ধারণবাদ সম্বন্ধে যে ধারণা প্রচলিত তা অত্যন্ত যান্ত্রিক। সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে নির্ধারণবাদের এই ধারণা আদতে পূর্বনির্ধারণবাদের দ্বারা প্রভাবিত। এর কারণে অধিকাংশ লোক নির্ধারণবাদ বলতে আসলে অদৃষ্টবাদ বোঝে। কাজেই আমি আবারও জোর দিয়ে বলব, এই কথা সত্য নয় যে আধুনিক বিজ্ঞানে সম্ভাব্যবাদের ধারণা নির্ধারণবাদকে খাটো করেছে অথবা কার্যকারণ সম্পর্ক বিরোধী। সঠিক ভাবে বুঝলে দেখা যাবে যে সম্ভাব্যবাদের সূত্র আসলে নির্ধারণবাদকে পূর্বনির্ধারণবাদের ধারণা থেকে মুক্ত করে আরও মজবুত ভিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’ প্রসঙ্গত, যান্ত্রিক বস্তুবাদের ভিতরে অদৃষ্টবাদের প্রবণতা এঙ্গেলসও তাঁর ‘ডায়ালেকটি’ অফ নেচার’ বইটির ‘চান্স অ্যান্ড নেসেসিটি’ নামক অধ্যায়ে আলোচনা করে দেখিয়েছেন।

একটি উদাহরণঃ আধুনিক জিনতত্ত্বের আলোকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ

বিজ্ঞান কী ভাবে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে সেটা বোঝার জন্য জীববিবর্তনের প্রক্রিয়াটার দিকে তাকানো যাক, যা ডারউইন প্রস্তাবনা করেছিলেন এবং জিনতত্ত্বের অগ্রগতির সাথে যার ক্রমবিকাশ ঘটে।

এই বিষয়টির দুটি দিক আছে– বিশেষ জীব এবং তার সামগ্রিক প্রজাতি। প্রত্যেকটি জীব প্রতি মুহূর্তে তার পরিবেশের সঙ্গে দ্বন্দে্ব অবস্থান করে। এক একটি প্রাণীর শারীরিক গঠন কী রকম হবে তা নির্ধারিত হয় তার ‘জেনেটিক কোড’ দ্বারা, অবশ্যই খাদ্য সরবরাহ সহ আরও কিছু প্রাকৃতিক বিষয় এখানে ভূমিকা রাখে। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি ভ্রূণ থেকে ঘোড়া হবে না মাছ, তা নির্ধারিত হয় সেই প্রাণীর শারীরিক গঠন সংক্রান্ত তথ্য দ্বারা যা কিনা একদম প্রথম কোষেই অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই তথ্য একটি বিশেষ অণুর মধ্যে পাওয়া যায়, যাকে বলে ডিএনএ, যা প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াসের অংশ। এই ডিএনএ-র বিভিন্ন অংশ তথ্য বহনকারী মৌলিক অংশ, এইগুলোকেই ‘জিন’ বলা হয়। এই তথ্যের উৎস হচ্ছে ওই প্রাণীর মা ও বাবার কোষের ডিএনএ অণু।

একটি বিশেষ প্রজাতির প্রত্যেক জীবের ডিএনএ হুবহু এক রকম হয় না। মূলত একটা সাদৃশ্য থাকে– যেমন দুটি কাক অথবা দুটি গাধার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে যার দ্বারা তাদের আলাদা করে কাক ও গাধা বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু কিছু সূক্ষ্ম তফাৎও থাকে যেগুলি আধুনিক যন্তে্র ধরা পড়ে। এই সূক্ষ্ম তফাৎগুলি থেকেই একই প্রজাতির এক জীবের থেকে অন্য জীবের দেহগঠনে বিভেদগুলির সৃষ্টি হয়, যাকে ডারউইন বলেছিলেন প্রকরণ (variation)। নতুন প্রকরণের সৃষ্টি হয় যখন প্রজনন কোষে ডিএনএ কপি করার সময় কিছু অসংগতি হয়। এই ঘটনা, যাকে ‘মিউটেশন’ বলা হয়, জীবজগতে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে।

একটি প্রজাতির প্রত্যেক প্রাণী প্রতি মুহূর্তে তার পরিবেশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে থাকে এবং তাদের জেনেটিক কোডের সূক্ষ্ম বিভেদের কারণে তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজনের ক্ষমতা এক রকম হয় না। তাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও সমান হয় না। যারা বেঁচে থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দিতে পারে, তাদের জেনেটিক কোড পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এই ভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনে কিছু জিন বিশেষ প্রাধান্য পায় এবং কিছু জিন, যেগুলি জীবের বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিকূল, সেগুলি বাদ পড়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার কারণেই প্রজাতিটিতে ক্রমশ পরিমাণগত পরিবর্তন আসতে থাকে। আধুনিক ভাষ্যে বললে, প্রতিযোগী জিনগুলির অনুপাত সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে।

যখন মিউটেশনের মধ্য দিয়ে এমন একটি নতুন জিনের উদ্ভব হয় যা ধারক জীবটির শারীরিক গঠনে বা আচরণে বড় রকম পরিবর্তন আনে, তখন প্রজাতিটিতে গুণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মিউটেশন প্রথমে একটি বিশেষ জীবের মধ্যেই দেখা দেয়। যদি এই মিউটেশন থেকে তার জীবনধারণের ক্ষেত্রে সুবিধে হয় তা হলে ওই বিশেষ জীব পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওই পরিবর্তিত জিনটি তার পরবর্তী প্রজন্মকে প্রদান করে। যদি ওই প্রজাতির সেই সব প্রাণী যাদের ওই মিউটেশনটি আছে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, তা হলে পুরো প্রজাতির মধ্যে ওই মিউটেশন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে। কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই প্রায় সকল সদস্যের মধ্যে ওই মিউটেশন দেখা যায়। তখন প্রজাতিটিকে সামগ্রিক ভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে তার মধ্যে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে এবং নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়েছে। এই ভাবেই বিভিন্ন জিনের অনুপাতের পরিমাণগত পরিবর্তন সামগ্রিক প্রজাতির গুণগত পরিবর্তন ঘটায়।

কিন্তু, যদি সেই প্রজাতির প্রত্যেক জীবকে খুঁটিয়ে দেখি, আমরা দেখব যে কিছু জীব বাকিদের আগেই গুণগতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, প্রজাতিটির সামগ্রিক পরিবর্তনের বহু আগেই। নতুন জিনের উত্তরাধিকার দ্বারা সেই সব জীবের মধ্যে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে তার থেকেই সামগ্রিক প্রজাতির মধ্যে একটি পরিমাণগত পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এই ভাবে ‘গুণগত পরিবর্তন থেকে পরিমাণগত পরিবর্তন’ অংশটি বাস্তবে ক্রিয়া করে।

বিবর্তন প্রক্রিয়ার আধুনিক ধারণা স্পষ্ট প্রমাণ করেছে যে সম্ভাব্যবাদ আর কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে কিছু কমিউনিস্ট জিনতত্ত্বের প্রাথমিক দিনগুলিতে এর বিরোধিতা করেছিলেন। এখন আমরা বুঝি যে যদিও random মিউটেশনের দ্বারা ক্রমাগত নতুন বৈচিত্র্যের আবির্ভাব ঘটে, এই বৈচিত্র্যগুলি বেঁচে থাকবে কি না এবং প্রজাতিটির ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের উপর প্রভাব বিস্তার করবে কি না– এই সব কিছুই কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন (ন্যাচারাল সিলেকশন) প্রত্যেকটি বিশেষ বৈচিত্র্যকে বেঁচে থাকার বিভিন্ন সম্ভাব্যতা প্রদান করে।

আধুনিক জিনতত্ত্বের বিকাশের দ্বারা বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। এর দ্বারা ‘সকল পরিবর্তনের মৌলিক কারণ অভ্যন্তরীণ’ এই ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বহিরাগত দ্বন্দ্বের ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা আরও বিকশিত হয়েছে। জিনতত্ত্বের প্রাথমিক দিনগুলিতে ডারউইনের তত্ত্বের কার্যকারণ সম্পর্ক অস্পষ্ট ছিল, আজ তা সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়েছে।

উপসংহার

আসল কথা হল, বিজ্ঞান দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দেখানো পথেই ক্রিয়া করে চলেছে, যদিও বিজ্ঞানীরা সব সময় সেই বিষয়ে সচেতন নাও থাকতে পারেন। অতএব, আমাদের কর্তব্য এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো যাতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বিজ্ঞান চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মৌলিক ধারণাগুলিকে পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদী দার্শনিকেরা আরও বিকশিত করেছেন এবং একটি সুসংহত জ্ঞানভাণ্ডার ও কর্মপ্রক্রিয়ার সৃষ্টি করেছেন। যদি আমরা বিশ্বাস করি যে এই দর্শনের দ্বারা আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন আধুনিক ধারণার বিশ্লেষণ ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হব, তা হলে আমাদের উচিত বিভিন্ন ‘‘শোধনবাদী’’ মতবাদ যেমন উত্তর-আধুনিকতা (post-modernism), এমপিরিও-মনিজম (empirio-monism), নয়া-বস্তুবাদ (new materialism), উত্তর-মানবতাবাদ (post-humanism) ইত্যাদিকে পরাস্ত করা।

পাশাপাশি, বিশ্ব জুড়ে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটছে, সকল মার্ক্সবাদীর উচিত সেগুলিকে খুঁটিয়ে জানা ও বোঝা। ঐতিহাসিক ভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ হয়েছিল বিজ্ঞানের অগ্রগতির ভিত্তিতে। কাজেই এখনকার যুগেও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই দর্শনের ক্রমবিকাশ বজায় রাখা আমাদের কর্তব্য।