
৩০ জুন তেলেঙ্গানার সাঙ্গারেড্ডি জেলায় সিগাচি ওষুধ কারখানায় একটি চুল্লিতে বিস্ফোরণের ফলে ৪০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে ও ২৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এই ওষুধ কারখানায় ব্যবস্থাপনার ভয়ঙ্কর গাফিলতির কথা। কারখানার চুল্লিগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করার মতো অতি প্রয়োজনীয় কাজটিও করা হত না। ফলে, যে চুল্লিটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটির তাপমাত্রা ৭০০-৮০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গিয়েছিল। পরিণামে এই বিস্ফোরণ।
বর্তমানে দেশের বহু কল-কারখানায় একই রকম দুর্বিষহ অবস্থা। শিল্পক্ষেত্রের নিরাপত্তায় বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে অন্যতম ভারত। একটি রিপোর্ট অনুসারে, গত বছর এ দেশে কর্মক্ষেত্রে দুশোটিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, প্রাণ হারিয়েছেন চারশো জনেরও বেশি শ্রমিক। আহত হয়েছেন অন্তত ৮৫০ জন। অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের দুর্ঘটনার খবর নথিভুক্ত করা হয় না। দেখা গেছে, রাসায়নিক ও ওষুধ কারখানাগুলি বিশেষ ভাবে দুর্ঘটনাপ্রবণ। গত বছরে এই ক্ষেত্রদুটিতেই একশোটিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনাতেই উঠে আসে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিয়মকানুন না মানা, শ্রমিকদের সুরক্ষাব্যবস্থার ঠিকঠাক তদারকি না হওয়া, শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দেওয়া, কারখানা পরিদর্শন ব্যবস্থায় চূড়ান্ত অবহেলা সহ নানা গাফিলতির ছবি।
প্রতিদিন আমাদের দেশে কোথাও না কোথাও মর্মান্তিকভাবে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। কখনও বৃহৎ অট্টালিকা, জাতীয় সড়ক বা ব্রিজ তৈরি করতে গিয়ে, কিংবা কল-কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় নির্মমভাবে শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটছে। ৪০ বছর আগে ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের ভূপালে ঘটা ভয়ঙ্কর গ্যাস দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে। পাঁচ লক্ষ মানুষের জীবন সে দিন তছনছ হয়ে গিয়েছিল। বেসরকারি মতে দুর্ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই আট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সে দিন এক মার্কিন কোম্পানির চরম গাফিলতির কারণে এত মানুষকে মরতে হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকদের জীবনের তোয়াক্কা না করে কলকারখানায় রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটিগুলো সে দিনও যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। এর মাশুল গুনে যেতে হচ্ছে সাধারণ নিরীহ শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে।
শ্রমিকদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী যে কারখানা-মালিকরা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারকে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কখনও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও বহু ক্ষেত্রেই টাকার জোরে ঘুরপথে তারা মুক্তি পেয়ে যায়। কল-কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার হাল-হকিকত খতিয়ে দেখার কথা সরকারগুলির। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও রয়েছে চরম উদাসীনতা। কোথাও নিরাপত্তা-ব্যবস্থার বেহাল দশা দেখেও মালিকের স্বার্থে সরকারি কর্তারা চুপ করে থাকেন। বিনিময়ে অনেকেরই মেলে মোটা টাকা উৎকোচ। পরিণামে মরে নাচার শ্রমিক। দিনকয়েক কান্নায় বুক ভাসায় তাদের পরিজনরা। তারপর আবার পা বাড়ায় নিরাপত্তাহীন মৃত্যুফাঁদ কারখানার দিকেই। পেটের ভাত জোগাড় করতে হবে যে!
কিন্তু এই ভাবেই কি প্রাণবলি দিয়ে যাবে শ্রমিকরা! তেলেঙ্গানায় শ্রমিকদের এই মৃত্যুমিছিল আবার প্রশ্ন তুলছে, সভ্যতা গড়ে তোলার কারিগর শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে যে সরকার-মালিক দুষ্টচক্র, তার প্রতিকার হবে কীসে? সমস্যার গভীরে তাকালে দেখা যায়, খরচ কমিয়ে মুনাফা বাড়াতে গিয়েই কারখানা-কর্তৃপক্ষ সুরক্ষাবিধিতে আপস করে। দৃশ্যত মালিক বা সরকার এ জন্য দায়ী হলেও, প্রকৃত বিচারে দায়ী মুনাফাভিত্তিক এই উৎপাদন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় শ্রমিক সুরক্ষায় গুরুত্ব দিতে সরকারকে তৎপর করতে হলে শ্রমিকদেরও সক্রিয় আন্দোলনে শামিল হতে হবে। সংগঠিত আন্দোলনে বাধ্য করতে হবে মালিকদের উপযুক্ত সুরক্ষা বিধি মানতে।