
‘‘জ্ঞান ক্রিয়া-বিচ্যুত নয়। যখন জ্ঞান সত্যকে প্রতিফলিত করে তখন সে জ্ঞান ক্রিয়াশীল হয়, ক্রিয়াধর্মী হয়। অর্থাৎ তখনই তা হল যথার্থ জ্ঞান। জ্ঞান যেখানে যথার্থ সত্যকে প্রতিফলিত করে না, তখন সে অহমের জন্ম দেয়, পাণ্ডিত্যাভিমানের জন্ম দেয়। সে তখন অকাজ করে, সমাজের বুকে সে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়ে। সে নানা বিপদ এবং বিপত্তির সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে এবং ফিলজফিতে যার জন্য স্কলাস্টিসিজম (পাণ্ডিত্যাভিমান), সিউডো (মেকি) ইন্টেলেকচুয়ালিজম (পণ্ডিতি), অ্যাকাডেমিক ট্রেন্ড (পুঁথিগত বিদ্যা)– এইগুলোকে খুব নিন্দা করা হয়। কারণ বিপ্লবী রাজনীতি হচ্ছে জীবনবেদকে রূপায়িত করার বাস্তব প্রক্রিয়া। এখানে ভাববিলাসিতার স্থান নেই, এখানে অকাজের স্থান নেই। স্কলাস্টিসিজম এই অকাজ করে। সিউডো ইন্টেলেকচুয়ালিজম, অ্যাকাডেমিক আউটলুক (দৃষ্টিভঙ্গি)– এই অকাজগুলি নানা দিক থেকে ক্ষতিসাধন করে বলেই সমস্ত বিপ্লবীদের বারবার বলতে হয়েছে– জ্ঞান আর পাণ্ডিত্যাভিমান এক জিনিস নয়। ইন্টেলেকচুয়ালিজম আর জ্ঞান এক জিনিস নয়। স্কলাস্টিসিজম আর বিপ্লব সম্পর্কে সত্য ধারণা এবং জ্ঞানের আলোকে তা প্রতিভাত হওয়া এক জিনিস নয়–তা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। শ্রেণিগত দিক থেকে এবং তার কার্যকারিতার দিক থেকেও তা বিপরীতধর্মী। যেমন লেনিন ভীষণভাবে এমপিরিসিস্টদের (অভিজ্ঞতাবাদীদের) বিরুদ্ধে ছিলেন।
সাধারণ অর্থে যাকে আমরা জ্ঞান বলি– খবর রাখা, বলতে পারা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত কিছুকে দেখা, এমপিরিসিস্টরা মূলত তাই করে। কত খুঁটিনাটি সূক্ষ্ম জিনিস তারা অনুসন্ধান করে করে নানা ঘটনা উপস্থাপনা করে। কী বিরাট পরিশ্রমের কাজ এই এমপিরিসিস্টরা করে। কিন্তু তবুও লেনিনকে এই এমপিরিসিস্টদের বিটারলি (কঠোরভাবে) সমালোচনা করতে হয়েছিল। তার কারণ দ্যাট স্টুড ইন দ্য ওয়ে অ্যাজ এ স্টাম্বলিং ব্লক টু রেভোলিউশনারি আইডিয়া (তা বিপ্লবী আদর্শের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল)। সত্য ধারণা এবং তার ওপর ভিত্তি করে ক্রিয়াকে রিলিজ করা (কাজের জোয়ার সৃষ্টি করা), ক্রিয়াধর্মী জ্ঞান যা সমাজ পরিবর্তন, বস্তুর পরিবর্তন, কার্যক্ষেত্রে সমস্ত গতিকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে, এমপিরিসিস্টরা তার পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে উপকার করার চেয়ে তারা অপকারই করে। জ্ঞান যখন বাধার সৃষ্টি করে তখন তাকে কুজ্ঞান বলে। এমনিতেও তো বাংলায় সুজ্ঞান ও কুজ্ঞান বলে দুটো কথা আছে। কুজ্ঞান অর্থে যদি জ্ঞান বল তো তাকে কুজ্ঞান বলা উচিত। আপনি কী জানলেন, কী বলতে পারলেন, কী লিখতে পারলেন এবং সে সম্বন্ধে হেগেল কী বলেছেন, এ সম্বন্ধে মার্ক্স কী বলেছেন, এ সম্বন্ধে অমুকে কী বলেছে, আর এই ফ্রিডম সংক্রান্ত বহু মনীষীর ভুরি ভুরি উদ্ধৃতি আপনার মুখস্থ থাকতে পারে, কিন্তু ফ্রিডম তত্তে্বর যথার্থ মানে ততক্ষণ আপনার বোঝাই হল না, নেসেসিটির যথার্থ উপলব্ধি ততক্ষণ আপনার হয়নি, যতক্ষণ না নেসেসিটি বলতে আপনি যেটা বুঝেছেন সেই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় সংগ্রামে নিয়োজিত হচ্ছেন। আর এই সংগ্রাম করার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে ফ্রিডমের উপলব্ধি আপনার মধ্যে প্রস্ফূটিত এবং প্রোজ্জ্বল হতে থাকে। যতক্ষণ আপনি এই সংগ্রামের মধ্যে নেই, ততক্ষণ আপনার বোঝা ভাসাভাসা থাকে এবং বোঝার মধ্যে অনেক ত্রুটি থেকে যায়। তারপরও যদি আপনি বলেন যা যুক্তিসঙ্গত এবং যা উচিত বলে মনে করি তার জন্য আমি কাজ করতে পারি না, যা অন্যায়, দুষ্ট, আমার পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে করি তা আমি আঁকড়ে ধরেই থাকি, তা হলে আমি কি নিজেকে মনুষ্য পদবাচ্য র্যাশনাল বিইং (বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব) ভাবতে পারি?
আপনারা কি এই কথাটার মানে বোঝেন যে, ইউ কানট ফাইট ফর ইওর ওন ফ্রিডম উইদাউট ফাইটিং ফর দ্য ফ্রিডম অফ আদারস (অন্যের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম না করলে নিজের স্বাধীনতার জন্য আপনি লড়তে পারেন না)। আগেও বহু ক্লাসে এ কথা আপনাদের বলেছি– এই ফ্রিডম কথাটা বুঝতে হবে কী ভাবে? বুঝতে হবে– তুমি যদি নিজে বিকাশলাভ করতে চাও, সমাজ বিকাশের জন্য তোমার যদি উদ্বেগ এবং আকাঙক্ষা থাকে, সংস্কৃতিসম্পন্ন, রুচিসম্পন্ন, শালীনতা এবং মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপন করতে যথার্থই যদি তুমি চাও এবং মর্যাদা সম্পর্কে তোমার যদি কোনও ভ্রান্ত ধারণা না থাকে, মর্যাদা মানে টাকাপয়সা, মর্যাদা মানে আইসিএস অফিসার হওয়া, মর্যাদা মানে হাইকোর্টের জজ হওয়া, মর্যাদা মানে মিনিস্টার হওয়া, চিফ মিনিস্টার হওয়া, মর্যাদা মানে অ্যামবাসাডার (রাষ্ট্রদূত) হওয়া এবং গাড়িবাড়ি থাকা, লোকে আমাকে স্যার স্যার বলবে, এই রকম তোমার যদি ভাবনা না থাকে, মর্যাদা কথাটার যথার্থ উপলব্ধি যদি তোমার থাকে তা হলে এ সমাজে তার একটাই মানে। সেটা হেB(, দ্য ওনলি ওয়ে টু লিড ইওর লাইফ ইন অ্যান অনারেবল ওয়ে ইজ টু এনগেজ ইওরসেলভস কনস্ট্যান্টলি ইন দ্য স্ট্রাগল অফ দ্য মাসেস ফর জাস্টিস (মর্যাদাময় জীবন যাপনের একমাত্র রাস্তা হল জনগণের জন্য ন্যায়প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের অবিরত নিযুক্ত রাখা)। ইনজাস্টিসের (অন্যায়ের) বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের সংগ্রাম সংগঠিত করা এবং তাকে নিয়ে লড়াই করা এবং এই লড়াই সংগঠিত করার কাজে এবং সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্য দিয়েই কেবল তুমি মর্যাদা এবং ডিগনিটিসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পার। বাকি সমস্ত রাস্তা হল সেল্ফ ডিসেপশন (আত্মপ্রতারণা), মর্যাদার নয়– অহম মাত্র। কারণ এ সমাজে ওয়াগন ব্রেকারের টাকায় সম্পত্তি করলেও মর্যাদা মেলে, ফুলের মালা মেলে। ডাকাতি-গুন্ডামির পয়সায় টাকা-কড়ি হলে তারও কদর হয়। তারপরে সে এমএলএ, এমপি হয়, আর তা হয় পয়সার জোরে। তারপরে সে মিনিস্টার হয়। তারপরে তিনি বাণী দিতে থাকেন। তা তিনি যদি এ সব ঠুনকো মর্যাদায় আত্মসন্তুষ্টি পান তা হলে ফ্রিডম নিয়ে অত মাথা ঘামাবার দরকার কী’?’
‘বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়’ পুস্তক থেকে