গণহত্যার বিচার, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করো

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৩ মাস অতিবাহিত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ব্যাপারে বিপুল আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু বিপুল আশার বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ৩ মাসের কার্যাবলী জনগণের মধ্যে অনেক প্রশ্ন এবং সংশয়ও তৈরি করছে।

গণহত্যার বিচার, শহিদ পরিবারকে সহযোগিতা এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজ এখনও খুবই দুর্বল। খুব সম্ভব এগুলো সরকারের কর্মতালিকার নিচের দিকে অবস্থান করে। এ কারণে একটা লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে যায় গত ১৩ নভেম্বর পঙ্গু হাসপাতালের সামনে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে সেদিন হাসপাতাল চত্ত্বরেই ঘিরে ধরেছিলেন গণঅভ্যুত্থানের আহতরা। তারা জানতে চান– তাদের চিকিৎসায় কেন অবহেলা করা হচ্ছে, কেন তারা সরকার ঘোষিত সহযোগিতা এখনও পাননি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তার গাড়ি ফেলে বলতে গেলে একভাবে পালিয়ে যান সেখান থেকে। এরপর আহতরা পঙ্গু হাসপাতালের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন। তাদের সাথে যোগ দেন চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের আহতরা। এদের অনেকেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, অনেকে হারানোর পথে। দেশে তাদের আর চিকিৎসা সম্ভব নয়, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের দেশের বাইরে যাওয়া দরকার, কিন্তু সে রকম কোনও উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেই।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছে না। চাল থেকে সবজি– সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে ক্রমাগত। সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার মতো উপর উপর কিছু পদক্ষেপ নিলেও সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তেই আছে। একচেটিয়া বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

এ কথা দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেটে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, পোশাক শিল্পের (গার্মেন্টস) মালিকদের ক্ষেত্রেও তেমনই সত্য। হাসিনা সরকার পতনের পর দেখা যাচ্ছে, অনেক গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের মাসের পর মাস বেতন দিচ্ছে না। অবাধে ছাঁটাই চলছে। কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। অভুক্ত শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামছে। সেই বিক্ষোভে যৌথবাহিনী গুলি চালিয়ে ইতিমধ্যে দু’জন গার্মেন্টস শ্রমিককে হত্যা করেছে। অব্যাহত শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষের যৌথ বৈঠকে ১৮ দফা চুক্তি হয়। সেই চুক্তির দেড় মাস পরও ১৮ দফার প্রায় কিছুই বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

ফলে গাজিপুর ও আশুলিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করছে। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দোসর খোঁজার প্রবণতাই বেশি। কোন ক্ষেত্রে এমন ঘটনা হয়ত ঘটতেও পারে। সেক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করে সমস্ত আন্দোলনেই ষড়যন্ত্র খোঁজা-পূর্বের ফ্যাসিস্ট সরকারের বয়ানকেই মনে করিয়ে দেয়। অথচ এই ক’দিন আগেই এই শ্রমিকরাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছে। তার পতনের জন্য রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। তাদের রক্ত ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে আবার তাদেরই রক্ত করছে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের হাতে।

গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তি আওয়ামি লিগ ফিরে আসার চেষ্টা করছে। প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যার পরও আওয়ামি লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনও অনুশোচনা দেখা যায়নি। তাদের বেশিরভাগ নেতারা এর জন্য অনুতপ্তও নন। বিভিন্ন মাধ্যমে যতটুকু বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তারা দেশের অভ্যন্তরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু জনমনে আওয়ামি লিগের প্রতি যে ঘৃণা সঞ্চিত আছে, এখনও ক্ষোভের বারুদ সঞ্চিত আছে তাতে ফিরে আসারচেষ্টা করলে জনগণই আবার তাদের প্রতিহত করবে। দল হিসেবে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাইতে হবে। হত্যা, গণহত্যা ও দুর্নীতিতে জড়িতনেতাদের বিচার হতে হবে। এরপর জনগণ ঠিক করবে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে।

ফলে গণঅভ্যুত্থানকে রক্ষার গ্যারান্টি এই জনগণ। সরকারের মধ্যে যারা আন্দোলনের স্পিরিটকে ধারণ করেন, তারা কোনও সংকটে পড়লে তা দেশের জনগণের সামনে অকপটে উন্মোচন করা দরকার। জনগণকে জড়িত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার। জনগণের শক্তি সম্পর্কে আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন না করে রাষ্ট্রশক্তি, আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কেবলমাত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চাইলে অভ্যুত্থানকারী জনগণের সাথেই তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে যার কিছু কিছু চিত্র দেখা যাচ্ছে।

অভ্যুত্থানের ৩ মাস পরে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করেছে সাংবিধানিক সংকটের কথা বলে। হঠাৎ কী সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হল তা সরকার স্পষ্ট করছে না। এতে তাদের কর্মকাণ্ড ঘিরে জনমনে ধোয়াশা তৈরি হচ্ছে।

প্রথমত, এই অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার ভিত্তি কেবল সংবিধান দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। এর সবচেয়ে বড় ভিত্তি জনগণের নৈতিক সমর্থন, যা গণঅভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত।

দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে, যা এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা হবে। সরকার কী করতে চায়, যা ক্ষমতার অভাবে করতে পারছে না, তাও স্পষ্ট করা উচিত।

তৃতীয়ত, এই অধ্যাদেশ করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, উপদেষ্টাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। এর মধ্য দিয়ে উপদেষ্টাদের একরকম দায়মুক্তি দেওয়া হল, যা তাদের জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

এই অধ্যাদেশ জারি, সম্প্রতি তিন উপদেষ্টার নিয়োগ, অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা লক্ষণীয়। দেশের জনগণ ও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে সাথে নিয়ে মতৈক্যের মধ্য দিয়ে পরিচালিত না হওয়ায় অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী জনগণ ও রাজনৈতিক বিভিন্ন শক্তির সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যা সরকারের সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। এর আগে আমরা দেখেছি, দেশের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কারের যে আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে সেই লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন সহ ১০টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশন গঠনের ক্ষেত্রেও কোনও মতামত নেওয়া হয়নি। কিছু কিছু কমিশন কাজ শুরু করেছে। তারা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের জনগণকে মতামত দেওয়ার আহবান করেছে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। একরকম দায়সারাভাবে কমিশনগুলো মতামত নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। সত্যিকারভাবে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় জড়িত করছে না। কমিশনগুলোর কাজের অগ্রগতিও খুব ধীরগতির।

অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আসার আগেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামি লিগ সরকারের আমলে করা নির্বাচন কমিশন আইন অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করেছে। ফলে সংস্কার সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাব নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। এরই মধ্যে এই সংস্কার, বিশেষত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন রকম বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। সুপরিকল্পিত বিতর্কের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে বিভক্তির বীজ রোপণ করা হচ্ছে। বাহাত্তরের সংবিধানকে এক কথায় ‘মুজিববাদী সংবিধান’ অভিহিত করে পুরো সংবিধানকেই খারিজ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর উৎসাহ ও মদদ যেমন আছে, তেমনি একটা অংশ বিভ্রান্তিতে পড়েও এর পক্ষে সায় দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, এই সংবিধানই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার ভিত্তি। ফলে একে উপড়ে ফেলতে হবে। কিংবা এই সংবিধান বাতিল করলেই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ হবে।

এ কথা সত্য যে বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যেভাবে সর্বময় একক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে তা-সহ অন্যান্য অগণতান্ত্রিক ধারার সংস্কার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না সংবিধানকে যত আদর্শস্থানীয়ই করা হোক না কেন, যত ভালো ভালো কথাই এতে লিপিবদ্ধ করা হোক না কেন– তার দ্বারা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ হয় না। কারণ ফ্যাসিবাদের ভিত্তি সংবিধান নয়, দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই এর ভিত্তি। যে কোনও সমাজব্যবস্থায় একটা দেশের সংবিধান সেই সমাজের ভিত্তিটা টিকিয়ে রাখতেই সহযোগিতা করে। পুঁজিবাদী দেশের সংবিধান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ব্যতিরেকে ফ্যাসিবাদের সম্পূর্ণ বিলোপ সম্ভব নয়। জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা, গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধতার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। এটাই বর্তমান মুহূর্তের করণীয়। না হলে অনূকূল জমিন পেলে ফ্যাসিবাদ আবার আগের চেহারায় ফিরে আসতে পারে।

বাসদ (মার্ক্সবাদী)-র কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘সাম্যবাদ’ পত্রিকার নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যা থেকে নেওয়া