পাঠকের মতামতঃ গণহত্যার বর্ষপূর্তি, শাসকের উৎসব

ফাইল ফটো, শিলিগুড়ি

পূর্ব সীমান্তে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ তিন বছরে পড়েছে। ও দিকে পশ্চিম এশিয়ার গাজায় গণহত্যার এক বছর পূর্তি হল। ২০২৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাস হল বর্ষপূর্তির মাস! হ্যাঁ, গণহত্যার বর্ষর্পূর্তি! ইউক্রেনে যুদ্ধ ও গণহত্যার নায়ক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিশ্বের ১০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রনায়করা অক্টোবর মাসে কাজান শহরে ব্রিকস সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। আবার এই নভেম্বরেই ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরো শহরে আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, ভারতবর্ষ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আফ্রিকান ইউনিয়ন সহ বিশ্বের ২০টির বেশি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা জি-২০ সম্মেলনে মিলিত হলেন। এই দুই সম্মেলনের উদ্দেশ্য হিসেবে একটি ‘স্থায়ী বিশ্ব গড়ে তোলা’ প্রায় প্রতি বছরের মতো এ বছরও ঘোষিত হয়েছে। ঘোষিত হয়েছে যুদ্ধ বন্ধ করে একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব গড়ে তোলা এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের রাশ টেনে ধরার কথাও। এ দিকে সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা দেশগুলির নৃশংস হামলায় প্রাণ যাচ্ছে, রক্ত ঝরছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের। নির্বিচারে চলছে শিশুহত্যা।

মনে রাখতে হবে, শাসকদের উৎসব আর সংগ্রামী জনতার উৎসবে আসমান জমিন তফাৎ। শোষিত ও অসচেতন জনতাকে তারা বারে বারেই পুঁজির সর্বগ্রাসী লোভ, দখলদারি ও হত্যালীলার উৎসবে মাতিয়ে দিতে চায়। জনতা ঠকে, বারে বারে ঠকে। তারা আবার রুখে দাঁড়ায়। যেমন করে রুখে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কার জনতা, বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র জনতা, এ দেশের জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃত্বে নারী ও নাগরিক সমাজ। যেমন করে আজ ব্রাজিলের আদিবাসী জনতা জলবায়ু দূষণের প্রতিবাদ স্বরূপ রিও ডি জেনেরো শহরের বোটাফোগো নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, জাপানের প্রেসিডেন্ট শিগেরু ইশিবাও, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ বিশ্বের তাবড় তাবড় গণহত্যাকারী রাষ্ট্রনায়কদের কাটআউট। যেমন করে, মহান মেডিকেল এথিক্সের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শহিদ হয়েছেন গাজার হাসপাতালের সহস্রাধিক ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকেল স্টাফ, মেডিকেল ছাত্র ও অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। হাসপাতালে বর্বর আক্রমণ চালিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের রোগীদের ছেড়ে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেননি। কেউ শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন, কেউ বা জেলে।

গত বছর ১১ নভেম্বর ইজরায়েলি বোমায় শহিদ হওয়ার ১০ দিন আগে নেফ্রো-স্পেশালিস্ট ডাঃ হামাম আলোহর সাক্ষাৎকারটি বিশ্বব্যাপী চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াইয়ের জীবন্ত দলিল হয়ে থাকবে। সেদিন অবরুদ্ধ আল শিফা হাসপাতাল থেকে ৩৬ বছরের ডাক্তার আলোহ বলেছিলেন, তিনি শুধু নিজের কথা ভাবার জন্য ১৪ বছর ধরে মেডিকেল স্কুল শেষ করে আন্ডার গ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়তে যাননি। তাঁর দেশের জনগণ ও রোগীদের জন্যই তিনি মেডিকেল শিক্ষা নিয়েছেন। তাই সেই রোগীদের ছেড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন উঠতেই পারে না। বিশ্ব-জনতা ও আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশের উদ্দেশ্যে তার শেষ আবেদন ছিল এইরকম– আমরা এই যুদ্ধ, আক্রমণ ও গণহত্যার অবসান চাই। কারণ আমরা পশু নই, আমরা মানুষ। আমাদেরও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমেরিকার মতো ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের মানুষদের যদি আজ প্যালেস্টিনীয়দের মতো থাকতে হত তা হলে তারা কী করত? দয়া করে মানবাধিকার নিয়ে তোমাদের ভণ্ডামি বন্ধ কর। আমরা প্যালেস্টাইনের ডাক্তাররা-স্বাস্থ্যকর্মীরা পালিয়ে বাঁচতে চাই না।

দীপক গিরি, পশ্চিম মেদিনীপুর