রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্ট মানুষ থাকে ভারতে। রক্তাল্পতায় ভোগা মা, কম ওজনের সদ্যোজাত শিশু-র সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। দেশের ৪০ শতাংশ শিশুই অপুষ্টিতে ভুগছে। মানুষে মানুষে চরম আর্থিক বৈষম্য ব্রিটিশ আমলকে ছাপিয়ে গেছে। বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ১৬ জুলাই মুম্বাইয়ের একটি সংস্থায় মাত্র ২ হাজার ২১৬টি পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে ২৫ হাজার কর্মহীন মানুষ উপস্থিত হলে পদপিষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। কয়েক মাস আগে গুজরাটের ভারুচে মাত্র ১০টি শূন্য পদের জন্য ২ হাজার প্রার্থীর একে অপরকে ঠেলে ইন্টারভিউ রুমে ঢোকার মরিয়া চেষ্টায় হোটেলের রেলিং ভেঙে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দেশে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত যুবকের মধ্যে ৮ জনই এখন বেকার। ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার মানুষের জীবন।
এমনই এক চূড়ান্ত দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে গত ২৩ জুলাই সংসদে ২০২৪-’২৫-এর বাজেট পেশ করলেন তৃতীয় দফা বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী। মানুষ আশা করেছিল, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষার মতো উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রগুলিকে এই বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কৃষকদের দুর্দশা ঘোচাতে পদক্ষেপ নেবে সরকার। বাজেটে থাকবে আর্থিক বৈষম্য কমানোর দিশা। সর্বোপরি, মানুষ ভেবেছিল, এই বাজেট অবশ্যই কর্মসংস্থান সৃষ্টির রাস্তা তৈরি করবে। কিন্তু দেখা গেল, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা লাঘব করার সামান্যতম প্রচেষ্টাও এই বাজেটে অনুপস্থিত। কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে কিছু অস্পষ্ট ও অবাস্তব ঘোষণা আর হিসেবের গোঁজামিল ছাড়া বেকার যুবকদের জন্যেও আসলে কিছুই নেই।
খাদ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতে নির্মম বরাদ্দ ছাঁটাই
সরকারি ক্ষমতায় বসে গত দশ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দোসররা ‘বিকশিত ভারত’-এর ঢাক পিটিয়ে মানুষের কানে তালা ধরিয়ে দিলেও, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের অসহনীয় পরিস্থিতির কথা তাঁদের খুব ভালো ভাবেই জানা আছে। সরকার জনমুখী হলে এই অবস্থায় তার উচিত ছিল উন্নয়নমূলক খাতগুলিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদির সুযোগ যাতে দেশের জনসাধারণ ঠিক মতো পায়, সেই ব্যবস্থা করা। শিশু ও কিশোরীদের পুষ্টির জন্য সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি ও পোষণ-২ নামে যে প্রকল্প দুটি আছে, শিশু ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি নিয়ে ভাবনা থাকলে সরকারের অবশ্যই উচিত ছিল এই প্রকল্প দুটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা ও সেই অর্থের যাতে সঠিক ব্যবহার হয় তা দেখা। অথচ দেখা গেল, গত বছরের বাজেটে এই খাতে যা খরচ হয়েছিল, এ বারে বরাদ্দ তার থেকে ৩০০ কোটি টাকা কম! জনমুখী সরকারের উচিত-কাজই বটে! বিজেপি সরকার সগৌরবে প্রচার করে ভারতে নাকি ‘অমৃতকাল’ চলছে। এদিকে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের সমীক্ষায় ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১১১-তে। প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষ খিদের যন্ত্রণা সহ্য করে দিন গুজরান করতে বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতিতে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের মানুষের পাতে খাবার তুলে দেওয়া একটি সরকারের নূ্যনতম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। অথচ এবারের বাজেটে খাদ্য ও গণবণ্টন দফতরের বরাদ্দ বিজেপি সরকার প্রায় ৮ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা কমিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, এবার খাদ্যে ভরতুকিও কমানো হল ৭ হাজার ৮২ কোটি টাকা! এ দিকে আর্থিক সমীক্ষা বলছে, সরকারি গুদামে মজুত শস্যের পরিমাণ দেশের মানুষের প্রয়োজনের তিনগুণ।
স্কুলে মিড ডে মিল প্রকল্প অসংখ্য অভুক্ত শিশুর পেট ভরানোর একমাত্র উপায়। এই প্রকল্পটি বাস্তবিকই গরিবি অধ্যুষিত এই দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পে বর্তমানে ছাত্রপিছু প্রাথমিকে ৫.৪৫ টাকা ও উচ্চ প্রাথমিকে ৮.১৭ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, প্রবল মূল্যবৃদ্ধির কারণে যা দিয়ে পুষ্টিকর খাবার তো দূর, পেট ভরা ভাতটুকুও জোটানো মুশকিল। এই অবস্থায় দেশের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নূ্যনতম সহানুভূতি ও দায়বদ্ধতা থাকলে সরকারের উচিত ছিল মিড ডে মিল প্রকল্পে বরাদ্দ বেশ খানিকটা বাড়ানো। কিন্তু এবারের বাজেটে দেখা গেল, অত্যন্ত অমানবিক ভাবে ২০২২ সালের তুলনায় সেই বরাদ্দ ২১৩.৫ কোটি টাকা কমিয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার। দেশ যে সত্যিই ‘অমৃতকাল’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সন্দেহ থাকতে পারে কি?
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাস্তবে কমানো হল
পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসা খাতে দেশের নাগরিকদের খরচ বিপুল। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এই খরচ ভারতে অনেক বেশি। খোদ নীতি আয়োগের সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর দেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে দারিদ্রের কবলে পড়তে হয়। গুরুতর কোনও রোগ হলে বিপুল খরচের বোঝা কী করে সামলানো যাবে ভেবে ৪৭ শতাংশ মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এই অবস্থায় এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় টাকার অঙ্কে মাত্র ১.৭ শতাংশ বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির হার কম করে ধরলেও প্রকৃত হিসাবে এই খাতে বরাদ্দ আসলে কমে গেছে কমপক্ষে ১ শতাংশ। বহুল প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় বরাদ্দ কমানো হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। নতুন ‘এইমস’ হাসপাতাল তৈরি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তোলা, জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য মিশন, জরুরিকালীন চিকিৎসা সহ নানা বিষয়ে পরিকাঠামো বাবদ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। শুধু তিনটি ক্যানসারের ওষুধের শুল্ক মকুব করেই দায় সেরেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বছরের বাজেটে জরায়ুমুখ ক্যান্সার ও সিক্ল সেল অ্যানিমিয়া দূর করতে বিরাট প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তার কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এবারের বাজেটে কিন্তু সে কথা ভুলেও একটিবার উল্লেখ করলেন না অর্থমন্ত্রী।
শিক্ষা খাতের হালও তথৈবচ
একটি দেশের উন্নয়ন অনেকাংশেই নির্ভর করে সেখানকার জনসাধারণের শিক্ষার মানের উপর। শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে মোট জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার দাবি করে আসছেন। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে যদিও বরাদ্দ সামান্য বাড়ানো হলেও মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে বিচার করলে প্রকৃত বরাদ্দ বাস্তবে কমানো হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষেত্রটিতে বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেট ব্যয়ের মাত্র ২.৬ শতাংশ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ বাড়েনি। মাদ্রাসা শিক্ষা ও সংখ্যালঘুদের শিক্ষা প্রকল্পের বরাদ্দ গত বছরের ১০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২ কোটি টাকা করেছে বিজেপি সরকার। বরাদ্দ না বাড়ালেও ছাত্রদের জন্য অর্থমন্ত্রী অবশ্য বেশ কিছু ঋণের বন্দোবস্ত করে দিয়়েছেন। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিক সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে যে বিপুল জ্ঞান মানবসমাজে অর্জিত হয়েছে, শিক্ষার অবাধ বিস্তারের মধ্য দিয়ে দেশের ছাত্রসমাজকে তার সংস্পর্শে আসার সুযোগ দেওয়ার বদলে বিজেপি সরকার তাদের ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। শুধু তাই নয়, মৌলিক শিক্ষায় বরাদ্দ না বাড়িয়ে বিজেপি সরকার বরাদ্দ বাড়িয়েছে আইটিআইগুলির উন্নতিকল্পে, যাতে সার্বিক জ্ঞান অর্জনের বদলে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কিছু প্রযুক্তিবিদ তৈরি করা যায়। যাতে সমাজে মূল্যবোধসম্পন্ন প্রকৃত মানুষ তৈরির প্রক্রিয়াতেই ভাটা পড়ে।
বাজেটে উপেক্ষিত কৃষি ও কৃষক সমাজ
কৃষিকে বলা হয় ভারতের অর্থনীতির ভিত্তি। এ দেশের অর্থনীতি আজও বহুলাংশেই কৃষিনির্ভর। এ দেশের কৃষকসমাজ বহু দিক থেকেই বঞ্চিত, উপেক্ষিত। বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মুনাফা লুটের বলি হয়ে সার, বীজ, কীটনাশকের বিপুল খরচ মেটাতে তারা ক্রমাগত ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্তে্বও খ্যাতনামা কৃষিবিজ্ঞানী স্বামীনাথনের ফর্মুলা মেনে ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ নূ্যনতম সহায়ক মূল্য আজও তাদের জোটেনি। ফসল ওঠার পর সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার অপদার্থতা ও উদাসীনতার কারণে আজও দেশের কৃষকদের একটা বড় অংশ ফড়ে, মজুতদারের কাছে অল্প দামে ফসল বেচে দিতে বাধ্য হয়। দেশ জুড়ে অতিপ্রয়োজনীয় সেচ ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর অভাব। দিল্লি সীমান্তে দীর্ঘ এক বছর ধরে ৭৫০ প্রাণ বলি দিয়ে কৃষকরা আন্দোলন চালিয়েছেন। তা সত্ত্বেও এ বারের বাজেটে কৃষি ও কৃষকের উন্নতির লক্ষ্যে কোনও পদক্ষেপই নিতে দেখা গেল না সরকারকে। গত বছরে কৃষি ও কৃষক উন্নয়ন মন্ত্রক যে ব্যয় করেছিল, এবারে ব্যয়বরাদ্দ তার থেকে সামান্য বেশি হলেও মূল্যবৃদ্ধি হিসাব করলে কার্যত তাকে কোনও বৃদ্ধিই বলা যায় না। শুধু তাই নয়, সরকার এবার সার দফতরের বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। সেচে ভরতুকি কমানো হয়েছে ২৪ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। এমনকি সারেও ভরতুকির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার। দেশ জুড়ে কৃষকদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে এবারের বাজেটেও ফসলের নূ্যনতম সহায়ক মূল্যের কথা উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী।
কর্মসংস্থানের নামে ঘোলাটে ও অবাস্তব পরিকল্পনা
দেশের কর্মপ্রার্থী যুবসমাজের সঙ্গেই বোধহয় সবচেয়ে বড় প্রতারণাটি করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এ বারের লোকসভা ভোটে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার পিছনে বেকারি-গরিবি-মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে বুঝে বাজেট ভাষণে বেশ কয়েকবার ‘কর্মসংস্থান’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী, যা আগের বছরের বাজেট ভাষণগুলিতে তাঁর মুখে শোনা যায়নি। কিন্তু ওটুকুই সার। বাস্তবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি সম্পর্কে যে পরিকল্পনাগুলি পেশ করেছেন তিনি, তা যেমন অস্পষ্ট, তার হিসেব তেমনই গোঁজামিলে ভরা।
বাজেটে আগামী পাঁচ বছরে ৪ কোটি ১০ লক্ষ কর্মসংস্থানের বিরাট ঘোষণা করা হয়েছে। কী ভাবে তা হবে, অঙ্ক কষে তার হিসাবও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, যদিও সে হিসাব গরমিলে ভরা এবং তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্কই নেই। বিপুল সংখ্যক চাকরির এই ঘোষণা যত অস্পষ্টই হোক, এর মধ্যে দিয়ে মালিকদের পাইয়ে দেওয়ার মতলবটি কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির দায়িত্বটি সরকার নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে বেসরকারি মালিকদের উপরেই চাপিয়ে দিতে চায়। তাই সরকারি দফতরগুলিতে ফাঁকা পড়ে থাকা ১০ লক্ষ পদ পূরণের কোনও ইঙ্গিতই এ বারের বাজেট ভাষণে পাওয়া যায়নি।
অর্থমন্ত্রী কর্মসংস্থান সংক্রান্ত তিনটি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। ভাষার ধোঁয়াশা সরিয়ে যেটুকু সামনে এসেছে তা হল, প্রথম প্রকল্প অনুযায়ী, প্রভিডেন্ট ফান্ডের খাতায় নাম ওঠা নতুন কর্মীদের প্রথম মাসের মাইনে তিন কিস্তিতে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দেবে সরকার। এ ব্যবস্থা এক বছরের জন্য। এক বছর পরে ওই কর্মীদের চাকরি আদৌ থাকবে কি না, সে ব্যাপারে মন্ত্রী কিছু বলেননি। দ্বিতীয় প্রকল্পে বলা হয়েছে, শিল্প ক্ষেত্রে নতুন কর্মীদের পিএফ-এর টাকা দেবে সরকার। কর্মী পিছু যে টাকা মালিক ইপিএফ-এ জমা দিতে বাধ্য, চার বছর ধরে সে টাকাও সরকারই দেবে। এতে নাকি ৩০ লক্ষ বেকারের চাকরি হবে। কিন্তু এই হিসাব কোথা থেকে পেলেন, অর্থমন্ত্রী কিন্তু সে কথা জানাননি। তা ছাড়া, মালিকরা পিএফ-এর টাকা দিতে পারে না বলেই নিয়োগ হয় না, সরকার তা দিয়ে দিলেই লাখ লাখ যুবকের কাজের ব্যবস্থা হবে– এমন ধারণা অর্থমন্ত্রীর চিন্তায় এল কোথা থেকে, সেটাই বিস্ময়ের।
তৃতীয় প্রকল্পটি আরও সরেশ। বলা হয়েছে, দেশের শীর্ষ ৫০০টি বেসরকারি সংস্থায় ১ কোটি ছেলেমেয়ের এক বছরের শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা করা হবে। সরকার প্রত্যেক শিক্ষানবিশকে মাসে ৫ হাজার টাকা করে দেবে। অর্থাৎ বছরে শিক্ষানবিশ পিছু সরকার খরচ করবে ৬০ হাজার টাকা। কাজ শেখার বাকি খরচ সংস্থার মালিক বহন করবে। অর্থাৎ, বেসরকারি সংস্থাগুলিকে শিক্ষানবিশ নিয়োগের নামে এক বছর ধরে নামমাত্র খরচের বিনিময়ে শ্রমিক জোগানের ব্যবস্থা করে দিল সরকার। কিন্তু মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। অর্থমন্ত্রীর হিসাব অনুযায়ী প্রতিটি সংস্থাকে ২০ হাজার শিক্ষানবিশ নিতে হবে। এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মাত্র ১৩৭টি সংস্থায় ১০ হাজারের বেশি কর্মী আছে। এই অবস্থায়, যাদের নিজস্ব কর্মীসংখ্যাই ১০ হাজারের কম, তারা কেমন করে ২০ হাজার শিক্ষানবিশকে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেননি অর্থমন্ত্রী। শিক্ষানবিশির পর কর্মীরা কাজ পাবে কি না, পেলেও কোথায় পাবে, সে সব কথার জবাবও তাঁর কাছে নিশ্চিত ভাবেই নেই।
অর্থবরাদ্দ বাড়েনি একশো দিনের কাজ প্রকল্পে
অর্থমন্ত্রীর নিশ্চয় এ কথা অজানা নয় যে, অর্থনীতিতে কার্যকরী চাহিদা অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকলে তবেই সচল থাকে শিল্প-উৎপাদন, ঘোরে কল-কারখানার চাকা। এবং আজকের দিনে অর্থনীতির মূল সমস্যা এই ক্রয়ক্ষমতার অভাবই। তা সত্তে্বও কী করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য টাকা তুলে দেওয়া যায়, তা নিয়ে বাজেটে মাথা ঘামায়নি বিজেপি সরকার। একশো দিনের কাজ প্রকল্প, যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এ বারের বাজেটে তাতে বরাদ্দ সামান্য পরিমাণও বাড়ানো হয়নি। মূল্যবৃদ্ধিকে হিসাবে নিলে কার্যত এই প্রকল্পে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় বেশ খানিকটা কমে গেছে।
প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের বান
জনজীবনের মানোন্নয়নের জন্য পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রগুলিতে মুষ্টিভিক্ষার মতো করে অর্থবরাদ্দ হলেও প্রতিরক্ষা খাতে কিন্তু বিজেপি সরকার দরাজ হাতে টাকা ঢেলে দিয়েছে। এ বারের বাজেটে সমস্ত ক্ষেত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে এই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রটিতেই– ৬ লক্ষ ২১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, বাজেটে মোট বরাদ্দ অর্থের প্রায় ১৩ শতাংশ। বোঝা যায়, বিজেপি সরকার বিপুল মিলিটারি বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্রের জোরেই দেশকে শক্তিশালী করতে চায়। সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা, আনন্দ ও মর্যাদাময় জীবনের অধিকারী জনসাধারণই যে একটি দেশের আসল শক্তি– সে বোধ তার নেই।
আর্থিক বৈষম্য কমানোর বদলে বাড়ানোর বন্দোবস্ত বাজেটে
বাস্তবে রুজি-রোজগারের বন্দোবস্ত সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কোনও চেষ্টাই এবারের বাজেটে দেখা যায়নি। অথচ অর্থনৈতিক বৈষম্যের বীভৎস চেহারা ক্রমাগত প্রকট হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে দেশের মাত্র ১ শতাংশ ধনীতম মানুষের হাতে ৪০ শতাংশেরও বেশি সম্পদ জমা হয়েছে। এ বছরের আর্থিক সমীক্ষাতেও দেশের এই ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্যকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। অথচ বাজেটে মানুষে মানুষে আর্থিক ব্যবধান কমিয়ে আনার কোনও উদ্যোগ দেখা গেল না। বরং উচ্চ আয়ের মানুষ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে এই বাজেটে যে ভাবে কর ছাড় দেওয়া হল, তাতে এই বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। এ বারের বাজেটে নতুন কর-কাঠামোয় তুলনায় অল্প রোজগারের উপর কর চাপানো হল। যেমন, প্রথাগত কর-ছাড় বাদ দিয়ে এখন থেকে ৪ লক্ষ টাকা বার্ষিক রোজগারের উপর কর দিতে হবে, আগে যা করমুক্ত ছিল। আবার, যাদের ব্যক্তিগত রোজগার ১৫ লাখের বেশি, তাদের জন্য করের হার ধার্য করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। অথচ কর্পোরেট তথা একচেটিয়া সংস্থায় যাদের রোজগার বছরে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত, তাদের ক্ষেত্রে করের হার করা হয়েছে ২৫ শতাংশ। বৈষম্যের ভয়ানক নজির ছাড়া একে আর কী বলা যায়! কর্পোরেট মুনাফা আরও বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যেই চালু রয়েছে যে সব সুযোগ-সুবিধা, সমাজে এই ভয়ঙ্কর আর্থিক বৈষম্য সত্তে্বও, সে সবগুলিই কিন্তু অব্যাহত রাখা হয়েছে এই বাজেটে। বিদেশি সংস্থাগুলির জন্যও বাজেটে কর্পোরেট করের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করার ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এবারে বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার গরিবি-বেকারি-মূল্যবৃদ্ধিতে বিপন্ন দেশের কোটি কোটি মেহনতি মানুষের জীবনযন্ত্রণা লাঘবের সামান্য চেষ্টাও না করে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার মালিকদের সম্পদ দিনে দিনে আরও বাড়ানোর বন্দোবস্ত সুচারু ভাবেই করে দিল। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর আদৌ কোনও চেষ্টা না করে অর্থনীতির গতি বাড়াতে সমর-বিভাগই তাদের কাছে পাখির চোখ। ধসে পড়া অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে এবং একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের মুনাফা অটুট রাখতে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের মতো অর্থনীতির সামরিকীকরণের পথই বেছে নিয়েছে বিজেপি সরকার।
বাস্তবে এটাই তাদের একমাত্র কাজ। মানুষকে আজ স্পষ্ট ভাবে এ কথা বুঝে নিতে হবে যে, পুঁজিবাদী ভারত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবেই কাজ করে এ দেশের সরকারগুলি। ফলে বাজেটের মাধ্যমেই হোক বা অন্য কোনও ভাবে, সর্বদাই তার লক্ষ্য জনসাধারণকে বঞ্চিত করে, তাদের উপর শোষণের রোলার চালিয়ে মালিক শ্রেণির মুনাফা ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলা। মানুষের আজ এ কথা বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে যে, ভোটের মাধ্যমে সরকার বদলে এই চূড়ান্ত অন্যায়ের সমাধান করা যাবে না। কেন্দ্রে আজ বিজেপি সরকারের বদলে অন্য দলের সরকার বসলেই জনজীবনে উন্নয়নের জোয়ার বইবে না। তা করতে গেলে উচ্ছেদ করতে হবে শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকেই।