কালীগঞ্জঃ ভোট মানেই কি বোমা আর খুন

ভোট মানেই নাগরিকের প্রাণহানি যেন একটা সাধারণ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তাই নেহাত সাধারণ একটা উপনির্বাচনও জড়িয়ে গেল নিরপরাধ এক স্কুল-বালিকার মৃত্যুর সঙ্গে।

নদিয়ার কালীগঞ্জে ২৩ জুন উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই জয় নিশ্চিত জেনে তৃণমূল কংগ্রেসের উল্লাস-মিছিল থেকে ছোঁড়া একটি সকেট বোমা ১০ বছরের বালিকা তমান্না খাতুনের বুকে এসে লাগে। ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। অভিযোগ– তমান্নার পরিবার ও তাদের প্রতিবেশীরা তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক না হওয়ায় এই হামলা এবং এমন যে হবে, আগে থেকেই নাকি সেই হুমকি দিয়ে রেখেছিল শাসক দলের স্থানীয় নেতারা। দলদাস পুলিশ যথারীতি তা রোখার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

ভোট রাজনীতি আজ দুষ্কৃতীনির্ভর হয়ে পড়েছে তমান্নার মৃত্যুর ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সেই নির্ভরতার মাত্রা এতটাই যে, উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিজয় মিছিলে হৈ-হল্লা, নির্মল আনন্দ নয়, বোমা-গুলি হাতে প্রকাশ্যে উল্লাসে মাতে দলের নেতা-কর্মীরা। যেখানে যে ক্ষমতায় সেখানেই তারা সেই সব অস্ত্রের প্রয়োগও ঘটায়– সাধারণ মানুষের প্রাণের পরোয়াটুকুও না করে। কেন এই উল্লাস? জয়ী প্রার্থীর দলের সুবিধাভোগী অংশ হিসাবে আরও এক বছর এলাকায় দাপট খাটানো, সুযোগ-সুবিধা লুঠের মওকা পাওয়া গেল বলেই তো! ফলে এ রাজ্যে তৃণমূলের পূর্বসূরী কংগ্রেস কিংবা সিপিএমের মতো আজ তৃণমূলেরও যে দাপট আর হুমকির রাজনীতিই ক্ষমতা হাতে রাখার মূল হাতিয়ার, এ ঘটনা সেটাও দেখিয়ে গেল। অন্যত্র বিজেপির ক্ষমতার সূত্রও তাই।

ভোটকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলির কর্মী-সমর্থকদের পারস্পরিক খুন-জখম, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া এ রাজ্যের পুরনো ট্র্যাডিশন। কংগ্রেস আমল থেকে শুরু হয়ে আগের সিপিএম-ফ্রন্ট সরকারের আমলে তার ব্যাপক বাড়বাড়ন্ত দেখেছে রাজ্যের মানুষ। শাসক সিপিএমের দুষ্কৃতী-নির্ভরতা, নির্বাচনের নামে গুলি-বোমার অবাধ ব্যবহার ও ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের বিপুল দাপটের বিরুদ্ধে জাগ্রত জনমতই এক সময় পতন ঘটিয়েছিল সেই সরকারের। ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ সরকারে বসার পর জনগণের সমর্থনের উপর নির্ভর না করে ধীরে ধীরে তারা পূর্বসূরি শাসক দলটিরই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। বলা বাহুল্য, আজ তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

তমান্নার মৃত্যুতে ব্যথিত, যন্ত্রণাবিদ্ধ সমস্ত মানুষ। এই সময়ে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব, আজ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে ছাপিয়ে রাজনীতিকেই দুর্বৃত্তের পেশা করে তোলার দিকে শাসক দলগুলো যেতে পারছে কেন। রাজনীতিতে নীতি বিসর্জনই তার কারণ। এ রাজ্যে মানুষের স্মৃতিতে আছে, কুলতলি, জয়নগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় এসইউসিআই(সি)-র সংগঠন ভাঙতে সিপিএম-এর দুষ্কৃতী বাহিনী দশকের পর দশক ধরে যে ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছে তাতে প্রাণ হারিয়েছেন দলের কিশোর কর্মী পূর্ণিমা ঘড়ূই, ভুবনেশ্বরীর জয়দেব পাইক, গোপালগঞ্জের বাঁটুল হালদার সহ তেভাগা আন্দোলনের নেতা, দলের কৃষক সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক আমিরালি হালদার সহ দেড় শতাধিক নেতা-কর্মী। সে দিন বার বার এস ইউ সি আই (সি)-র পক্ষ থেকে সিপিএম নেতৃত্বকে সাবধান কর়ে বলা হয়েছিল যে, এই খুনের রাজনীতি পরবর্তী কালে জমানা বদল হলে অন্য দল তাঁদের বিরুদ্ধেও কিন্তু হাতিয়ার করবে। তাঁরা সেদিন সে কথায় কান দেননি। এরই ধারাবাহিকতায় আজ শাসক তৃণমূল কংগ্রেস সেই খুন-জখমের রাজনীতিকেই ক্ষমতা দখলের অস্ত্র বানিয়েছে। সে দিনের সিপিএম দুষ্কৃতীরা অনেকেই আজ তৃণমূলের নেতা এমনকি বিধায়ক হয়েছেন।

তমান্নার মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্য জুড়ে জনরোষের চাপে, এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত পুলিশ নয় অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, অভিযুক্তরা প্রত্যেকেই এলাকায় শাসক দলের হোমরা-চোমরা এবং এদের মর্জির উপরেই ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত হয়। এ হেন দাপুটে নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে– নিঃসন্দেহে তা স্বস্তির খবর। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে, গ্রেফতারি মানেই আজকের দিনে যথাযথ বিচার ও শাস্তির নিশ্চয়তা নয়। প্রাথমিক ভাবে গ্রেফতার হলেও শাসক দলের অভয়হস্ত মাথায় থাকায় বহু অভিযুক্তকে অচিরেই জামিনে বেরিয়ে এসে আবার স্বমহিমায় বিরাজ করতে দেখতে অভ্যস্ত রাজ্যবাসী। ফলে যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজ্যের, বিশেষত ওই জেলা ও অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। তমান্নার খুনিদের শাস্তি চাই– এই দাবিতে একজোট হয়ে ওই অঞ্চলের দলমতনির্বিশেষে শান্তিপ্রিয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নামতে হবে, যাতে পুলিশ-প্রশাসন দলদাসত্বের পুরনো অভ্যাস ছেড়ে যথাযথ নিরপেক্ষ ও কার্যকরী ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। অত্যাচারী শাসক কেবল জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তিকেই ভয় পায়। তাই সরকার ও শাসক দলের উপর আন্দোলনের চাপ বজায় রাখাটাই ন্যায়বিচার পাওয়ার একমাত্র গ্যারান্টি।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ৪ – ১০ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত