Breaking News

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে, দেশের মানুষের জন্য চড়া দামই বহাল রেখেছে বিজেপি সরকার

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নেমে যাচ্ছে তরতর করে। অপরিশোধিত তেল, কিছু দিন আগেও যা ছিল ব্যারেল প্রতি ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে, তা এখন ৬০ ডলার বা তারও নীচে। কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতের বাজারে দাম কি কমেছে? না, কমেনি। কারণ যে হারে তেলের দাম কমছে, সরকার সেই হারে তেলের উপর করের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে তেল সস্তা হলেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের জনগণকে তা সস্তায় পেতে দিচ্ছে না। জনসাধারণকে চড়া দামেই তেল কিনতে হচ্ছে। এতে যেমন পরিবহণ খরচে চড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে তেমনই কৃষিক্ষেত্রেও সেচের খরচ চড়াই থেকে যাচ্ছে।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে শুল্কযুদ্ধ বিশ্ব জুড়ে যে মন্দার পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে তুলেছে তার ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম অনেকখানি নীচে নেমে গেছে। এই রকম পরিস্থিতিতেও কেন্দে্র বিজেপি সরকার গত ৭ এপ্রিল দেশের সংকট-জর্জরিত সাধারণ মানুষের উপর রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারে ৫০ টাকা এবং পেট্রল ও ডিজেলের উপর লিটার প্রতি ২ টাকা বাড়তি উৎপাদন শুল্ক চাপিয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের বাড়তি আয় হবে ৩২,০০০ কোটি টাকা।

জনগণের পকেট লুঠ করে সরকারের এত বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা কেন? এই টাকা কি জনগণের কল্যাণে ব্যয় হবে? মোটেও নয়। জনগণের কল্যাণে সরকারের এত মাথাব্যথা নেই। এই টাকা সরকার ব্যয় করবে– যে বিপুল পরিমাণ টাকা তারা সমাজের ধনী এবং সচ্ছল অংশকে করছাড় বাবদ ব্যয় করে চলেছে তা উশুল করতে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের সেবা করার দায় তারা চাপাচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে।

সরকার যখন ভরতুকি বন্ধ করে তেলের উপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছিল তখন বলেছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ওঠাপড়ার সমানুপাতিক হারে ভারতে তেলের দাম নির্ধারিত হবে। কিন্তু সরকার এবং তার মন্ত্রীরা এ কথার বাস্তব অর্থ দাঁড় করিয়েছেন– আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে দেশে সেই অনুপাতে তেলের দাম বাড়বে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে দেশের বাজারে তা কমবে না।

জনগণ যখনই দেশে তেলের দাম কমানোর দাবি করে তখনই মন্ত্রীরা তেল কোম্পানিগুলির লোকসানের অজুহাত তোলেন। যেন তেল কোম্পানিগুলি জনগণের সেবা করতে শুধু লোকসানই করে চলেছে। অথচ বাস্তবটা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তথ্য বলছে, তিন রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা–ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসি), ভারত পেট্রলিয়াম (বিপিসিএল) এবং হিন্দুস্তান পেট্রলিয়ামের (এইচপিসিএল) মিলিত মুনাফা ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পৌঁছেছে ৮১ হাজার কোটি টাকায়। বেসরকারি কোম্পানিগুলি মুনাফা করেছে আরও বেশি। বাস্তবে নজিরবিহীন এই মুনাফা। লোকসানের গল্পটা তারা ফাঁদে মানুষকে বিভ্রান্ত করে মূল্যবৃদ্ধি মানিয়ে নেওয়ার জন্য।

স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের কাছে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে সস্তা তেলের সুবিধা সাধারণ মানুষকেও একই রকম ভাবে পেতে দিতে হবে। তেলের দাম কমলে পরিবহণ খরচ কমে গিয়ে যেমন তা মুল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এনে সংকটগ্রস্ত জনজীবনে অনেকখানি সুরাহা আনতে পারত, তেমনই কৃষিক্ষেত্রেও সেচের খরচ কমলে কৃষকদের চাষের খরচ অনেকখানি কমত। কিন্তু সরকার জনগণের এই দাবিকে কোনও গুরুত্ব দেয়নি।

রাশিয়া থেকে অতি সস্তায় তেল আমদানি করে বিপুল মুনাফা করার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে বহু আলোচিত। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই আমেরিকা রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার লক্ষ্যে তার তেল-গ্যাস রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ন্যাটোর আওতাভুক্ত ইউরোপের দেশগুলি, যারা রাশিয়ার তেল-গ্যাসের উপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল সেখানে রাশিয়ার তেল রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। অথচ রাশিয়ার অর্থনীতি তেল বিক্রির উপর অনেকখানিই নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া ভারতকে অনেক কম দামে তেল বিক্রির প্রস্তাব দেয়। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেল পিছু ১৪০ ডলার, রাশিয়া ভারতীয় কোম্পানিগুলিকে মাত্র ৪০ ডলারে, এমনকি তার থেকেও কম দামে তেল দিতে রাজি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগায় ভারত সরকার। বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি রাশিয়ার তেল অতি সস্তায় আনতে থাকে। ভারতকে তার প্রয়োজনের ৮৫ শতাংশ তেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এর বেশির ভাগটাই আসত ইরাক এবং সৌদি আরব থেকে। রাশিয়া থেকে আমদানি করত মাত্র ০.২ শতাংশ। বর্তমানে ভারতের প্রয়োজনীয় তেলের ৫০ শতাংশের বেশি আমদানি হয় রাশিয়ার সস্তা তেল। সেখানে মার্কিন তেল আমদানির অংশ ২০১৯-এর ৪.৫ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪-এ দাঁড়িয়েছে ৩.৪ শতাংশ।

সম্প্রতি আমেরিকায় অনুষ্ঠিত এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোদিকে পাশে রেখে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ভারতকে আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমাণ তেল এবং গ্যাস কিনতে হবে। কারণ, আমেরিকা দু’দেশের বাণিজ্যিক ঘাটতি কমিয়ে আনতে চায়। ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকাই যে ভারতে সব থেকে বেশি পরিমাণে তেল এবং গ্যাস জোগান দেবে সে ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির সাথে তাঁর ঐক্যমত্য হয়েছে। তেল আমদানির পরিমাণ বার্ষিক ১৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার করা হবে। ট্রাম্পের এমন প্রস্তাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঐক্যমত্য বিস্ময়কর। কারণ তেল আমদানিতে এই ঐক্যমত্য ভারতে তেলের দাম অনেক বাড়িয়ে তুলবে এবং তার ফল হিসাবে জনগণের ঘাড়ে বিরাট মূল্যবৃদ্ধিকে চাপিয়ে দেবে। ট্রাম্পের ফতোয়া মানতে গেলে রাশিয়ার সস্তা তেল বাদ দিয়ে আমেরিকার তেল চড়া দামে ভারতকে নিতে হবে। ভারত থেকে আমেরিকার দীর্ঘ দূরত্বের পরিবহণ খরচ মিটিয়ে দেশের বাজারে তেল হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক বাজারের থেকেও বেশি দামি। তাতে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলির বিপুল মুনাফা হবে, কিন্তু তার বোঝা বইতে হবে ভারতের সাধারণ মানুষকেই। বাস্তবে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেলের ক্ষেত্রে এমন একতরফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তির বিরোধিতা প্রতিটি দেশবাসীর কর্তব্য।

লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ১৮ এপ্রিল ২০২৫ এ প্রকাশিত