
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সভায় ধারাবাহিকভাবে ‘ভোকাল ফর লোকাল’ বা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়ে চলেছেন। গত ১৫ আগস্ট লালকেল্লার ভাষণ থেকে শুরু করে সম্প্রতি গোয়াতে ভারতীয় নৌসেনার সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়েও ‘মেক ইন ইন্ডিয়ার’ স্লোগান তুলেছেন তিনি। ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু নাকি ‘পরনির্ভরতা’। আর এই পরনির্ভরতাকে কাটিয়ে উঠে দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার জন্য দু-বেলা আহ্বান দিয়ে চলেছেন মোদিজি। বলছেন, উৎপাদনের প্রশ্নে বিদেশের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা কাটাতে হবে। গোলামির মানসিকতা ছেড়ে দিয়ে সমস্ত উৎপাদন দেশের মাটিতেই করতে হবে। আর এই ‘আত্মনির্ভরতা’র আওয়াজ তুলেই প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল বিজেপি দেশজুড়ে উগ্র দেশাত্মবোধ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের সেন্টিমেন্টকে জাগিয়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
দেশ ‘আত্মনির্ভর’ হলে দেশের সর্বত্র উৎপাদনের প্রয়োজনে কলকারখানা গড়ে উঠবে, কলকারখানায় প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জন্য কৃষির উন্নতি হবে, কোটি কোটি মানুষ কারখানায় কাজ পাবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, এর ফলে দেশের বাজারে কার্যকরী চাহিদা বাড়বে, যা উৎপাদনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে– সর্বোপরি শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত থাকবে– এ তো ভারতবাসী মাত্রেই চায়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছেন, তার সাথে সাধারণ মানুষের চাহিদার এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়নের কোনও সম্পর্ক কি আদৌ আছে? চাইলেই কি দেশ আজ উৎপাদনে আত্মনির্ভর হতে পারবে? বর্তমানে ভারতে যে পুঁজিবাদী তথা মালিক-মজুর উৎপাদন সম্পর্ক কার্যকরী রয়েছে তা কি দেশের অভ্যন্তরে শিল্প ও কৃষির অপ্রতিহত বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সহায়ক?
ভারতবর্ষের অর্থনীতি একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। আজ ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশ যেমন ভারত সহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে প্রচুর পুঁজি বিনিয়োগ করে এই দেশগুলোর সস্তা শ্রম এবং কাঁচামালকে ব্যবহার করে উৎপাদন করছে এবং মুনাফা লুট করছে। একই ভাবে ভারতবর্ষের মালিকরা অন্য দেশে পুঁজি রপ্তানি করছে। এ ক্ষেত্রে লেনিন বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির অন্যতম শর্ত অনুযায়ী ভারত সরকারের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের বা বিভিন্ন দেশের মালিকদের সাথে এ দেশের মালিকদের গাঁটছড়া তৈরি করার কাজটিও চলছে পুরোদমে। পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পণ্যের চরিত্রও আর জাতীয় থাকে না, হয়ে পড়ে বহুজাতিক। এই পণ্য একই সাথে একাধিক দেশের মিলিত উদ্যোগে তৈরি হয়। কোনও একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করে একটি বা একাধিক দেশ, কাঁচামাল ও শ্রমশক্তি ব্যবহৃত হয় অন্য এক বা একাধিক দেশের, আবার টেকনোলজি ব্যবহৃত হয় অপর আর একটি দেশের– অর্থাৎ একটা পণ্য তৈরি হয় একাধিক দেশের মিলিত উদ্যোগে।
ফলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন আত্মনির্ভরতার কথা বলছেন, তখন খোঁজ নিলেই দেখা যাবে কোনও উৎপাদনই কিন্তু ভারতের নিজস্ব উদ্যোগে সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নততর করার কথা বলে যখন প্রধানমন্ত্রী বারে বারে আত্মনির্ভরতার স্লোগান তুলছেন, তখন দেখা যাচ্ছে যে সব অস্ত্র বা যুদ্ধ উপকরণ এ দেশে তৈরি হবে বলে বলা হচ্ছে তার প্রায় সব কটিতেই সহযোগী দেশ হিসেবে রয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, আমেরিকা অথবা রাশিয়ার মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। সম্প্রতি ভারতীয় ডিআরডিও নিয়ন্ত্রিত ‘গ্যাস টারবাইন গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ যে যুদ্ধ বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করার ঘোষণা করেছে, দেখা যাচ্ছে তা আসলে জাপানের ‘মিতসুবিসি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ’ বা ব্র্রিটিশ সংস্থা ‘রোলস রয়েস’-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হবে। একই ভাবে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা ‘গুগলের’ সাথে যৌথ উদ্যোগে ভারতীয় শিল্পপতি ‘আদানি’ এ দেশের মাটিতে গড়ে তুলবে তথ্যকেন্দ্র, যার জন্য গুগল ১ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছে। এই ভাবে বিভিন্ন দেশের সাথে মিলিত উদ্যোগে বা ওই দেশগুলোর টেকনোলজি ব্যবহার করে এ দেশের মাটিতে যুদ্ধ উপকরণ তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে– যার মধ্য দিয়ে উভয় দেশের সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি কিছুটা সঙ্কট কাটিয়ে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ খুঁজছে। আর দেশের মানুষের কাছে এটাকেই উপস্থিত করা হচ্ছে আত্মনির্ভরতার নাম দিয়ে। এই আত্মনির্ভরতার মধ্য দিয়ে কিন্তু দেশে কোনও নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠছে না, কোটি কোটি বেকারদের জন্য কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না, মুদ্রাস্ফীতি কমছে না, অর্থনীতিতে যে মন্দা তা দূর হচ্ছে না। বরং যত আত্মনির্ভরতার কথা বলা হচ্ছে তত আমাদের দেশে কর্মচ্যুত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকার যুবকের সংখ্যা, মূল্যবৃদ্ধি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করছে, কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, লাফিয়ে বাড়ছে না খেতে পাওয়া নিরন্ন-বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা। আত্মনির্ভরতার নামে প্রধানমন্ত্রী যে জাতীয়তাবোধ বা দেশপ্রেমের স্লোগান তুলছেন তার সাথে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার সময়ের জাতীয়তাবোধেরও কোনও সম্পর্ক নেই। আজ আত্মনির্ভরতার নামে আসলে উগ্র দেশপ্রেম ও উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেওয়া হচ্ছে যা চরিত্রগত ভাবে প্রকৃত জাতীয়তাবোধের ধারণা থেকে আলাদা। যা ক্রমাগত ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ও প্রদেশ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে সংকীর্ণতাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তা। এই উগ্রতার সাথে জনগণের প্রকৃত দেশপ্রেমের কোনও সম্পর্ক নেই।
আসলে এই আত্মনির্ভরতার স্লোগানের মধ্য দিয়ে সংকটগ্রস্ত সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর চেষ্টা করে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিক আম্বানি-আদানিদের আরও মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক এজেন্টের কাজ করে চলেছেন মোদিজিরা। এ দেশের যুদ্ধশিল্পে যে ব্যাপক বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে, প্রতি বছর প্রতিরক্ষা খাতে কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ যে ভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে ভাবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাকে যুদ্ধবিমান সহ বিভিন্ন যুদ্ধ উপকরণ উৎপাদনের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে আজ ভারতে পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে শোষণ করতে করতে যে তীব্র বাজার সংকটের সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে উত্তরণের অন্য কোনও রাস্তা তার সামনে আর খোলা নেই। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বা ভোগ্যপণ্যের দেশীয় বাজার আজ সম্পূর্ণ নিঃশেষিত। উৎপাদিত পণ্য চলে যাচ্ছে বিদেশের বাজারে।
সম্প্রতি আমেরিকা ভারতীয় পণ্যের উপর চড়া শুল্ক চাপানোর মধ্য দিয়ে সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই সর্বাত্মক সংকট থেকে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের কিছুটা বাঁচাতে কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটি কমিয়ে দেশে বাজার খানিকটা চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। একটু বিচার করলেই বোঝা যায় যে এই বাজার অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। জিএসটি হ্রাস করে সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদকে প্রধানমন্ত্রী বাঁচাতে পারবেন না। কারণ ভারতে অর্থনৈতিক সংকট এতই তীব্র যে সামান্য কিছু দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর কোনও উপায় নেই। তা ছাড়া জিএসটি কমানোর সুফলটা মালিকরা আত্মসাৎ করলে সরকার তাদের বাধা দেবে এমন কোনও লক্ষণ নেই। সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই ভারতে অর্থনীতির সামরিকীকরণের কাজটি চলছে পুরোদমে। সামরিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হল এখানে দেশের বাজারের চাহিদা বা জনগণের ক্রয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয় না। সরকার নিজেই ক্রেতা। আর এই অর্থনীতির জন্য যুদ্ধাস্ত্র কেনাবেচার বাজার তৈরি করতে সর্বদা যুদ্ধের জিগিরকে জিইয়ে রাখা হয়। বিশ্বজুড়ে এখন এটাই চলছে। কখনও দেশের মধ্যেই কোনও জনগোষ্ঠীকে শত্রু প্রতিপন্ন করে, কখনও অভিবাসী বিরোধী জিগির তুলে, কখনও অন্য কোনও দেশকে শত্রু হিসাবে তুলে ধরে চারিদিকে শত্রুর ছায়া তৈরি করা হয়।
একটা উগ্র দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলে যুদ্ধ-অর্থনীতির পক্ষে মানুষের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করা হয়। অর্থনীতির এই নিয়ম কিন্তু প্রধানমন্ত্রীরা খুব ভাল করেই বোঝেন। আবার সাধারণ মানুষ যাতে এই নিয়ম বুঝতে না পারে তার জন্য যে সমাজে অন্ধতা ও উগ্রতার চর্চার প্রয়োজন সেটাও তাঁরা ভাল বোঝেন। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত আর্থিক নীতি প্রতি দিন যে দেশের মানুষকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির শোষণের যাঁতাকলে আরও বেশি করে পিস্ট হতে সাহায্য করছে– তা আড়াল করতেই এই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান। পুঁজিবাদের নির্মম ও অমানবিক শোষণ যন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা এবং সেই শোষণ যন্তে্র মানুষকে তার শ্রমশক্তি বিক্রি করতে ও শোষিত হতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যেই আত্মনির্ভরতার স্লোগান। বর্তমান পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফার স্বার্থে পরিচালিত মালিক-মজুর উৎপাদন সম্পর্কটি সাধারণ মানুষের ও দেশের আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেশের কোটি কোটি অসহায় সাধারণ মানুষ তথা সমাজের কার্যকরী চাহিদা ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে পরিচালিত উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তন ব্যতিরেকে কখনওই কেউ আত্মনির্ভর হতে পারে না।