অর্থনীতির বহর নাকি বাড়ছে! তা হলে মানুষের কেনার ক্ষমতা কমছে কেন?

বাজারে পাক খেতে খেতে দেখা অসীমবাবুর সঙ্গে। তিনিও দেখলাম ইতিমধ্যে বেশ কয়েক পাক খেয়ে ফেলেছেন। বললেন, কী কিনব মশাই, যা দাম জিনিসপত্রে হাতই দিতে পারছি না। কিন্তু খেতে তো হবে! বললাম, মশাই অবস্থা তো সবারই এক। সবজিতে হাত দিলে তো ছ্যাঁকা লাগার অবস্থা। চাল, আলু, সরষের তেলের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। রোজগার তো বাড়ছে না। অসীমবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেমেয়েরা কী করছে? বললাম, মেয়েটা পাশ করে বসে আছে। ছেলেটা পাশ করে বসে থেকে থেকে সুইগি-জোমাটোর ডেলিভারি বয়ের কাজে ঢুকেছে। কতটুকু রোজগার! সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি এ বার জিজ্ঞেস করলেন, তা মশাই, কাগজে যে নিয়মিত পড়ছি, আমাদের অর্থনীতির পরিমাণ নাকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বছরে বছরে নাকি কত ট্রিলিয়ন করে বাড়ছে। আমরা নাকি ইউরোপের সব নামকরা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছি। তা কই, সেই সব ট্রিলিয়ন-ফিলিয়নের দেখা তো কোথাও পাচ্ছি না!

ভাবছিলাম, ট্রিলিয়ন কততে হয় ভেবে কী হবে! অন্তত চার-পাঁচটা পেট ভরানোর মতো বাজারটা ঠিকঠাক করতে পারার মতো টাকাও যদি পকেটে থাকত! খাবার জোগাড় করতেই নাভিশ্বাস উঠছে। এরপর ইলেকট্রিক বিল, চিকিৎসা খরচ, বাড়িভাড়া সব দিতে গেলে তেল সাবান কেনার পয়সাটাও তো থাকবে না।

এই চিন্তাটা যে কতটা বাস্তব তা বোঝা যায় ভোগ্যপণ্যের বাজারের হাঁড়ির হাল দেখে। সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট, খাবার থেকে তেল-টুথপেস্ট-বিস্কুট-সাবান-শ্যাম্পুর মতো রোজকার ব্যবহারের ভোগপণ্যের (এফএমসিজি) ব্যবহার গত ছয় থেকে নয় মাসে কমেছে। কমেছে মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যে থাকা ফ্ল্যাট এবং স্কুটার-বাইকের বিক্রি। কমেছে সাধারণের আয়ত্তে থাকা স্মার্টফোনের বিক্রিও। বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, বেড়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং দামি গাড়ির বিক্রি। ঠিক তেমনই ৩০ হাজার টাকা দামের স্মার্ট ফোনের বিক্রি বেড়েছে এবং ৪৫ হাজার টাকার উপরেরগুলির বিক্রি বেড়েছে আরও বেশি। অর্থাৎ ধনী অংশের বাজারটি অটুট আছে শুধু নয়, বরং তা ক্রমশ বাড়ছে, কমেছে মধ্যবিত্তের কেনার পরিমাণ।

কিন্তু মধ্যবিত্তের কেনার পরিমাণ কমছে কেন? বাস্তবে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই, বিশেষত বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার যে নীতি নিয়ে চলছে তাতে আর্থিক অসাম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, গরিব হচ্ছে আরও গরিব। শুধু তা নয়, মধ্যবিত্তের একটা অংশ দ্রুত রোজগার তথা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে। তার কারণ, মধ্যবিত্ত মূলত চাকরি-নির্ভর। অথচ চাকরির বাজারের হাল খুবই খারাপ। নতুন চাকরি হচ্ছে না বললেই চলে। প্রধানমন্ত্রীর বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি এখন তাঁকেই বিদ্রুপ করছে। যারা-বা চাকরি করছেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই বেতন তেমন হারে বাড়ছে না, বরং মূল্যবৃদ্ধির হিসেব ধরলে কার্যত কমছে। যেটুকু চাকরি হচ্ছে তা সবই কম বেতনের এবং চুক্তিভিত্তিক। মূল্যবৃদ্ধি যে হারে ঘটছে, শিক্ষা-চিকিৎসার খরচ যে ভাবে বাড়ছে তাতে সংসার চালাতেই মানুষ হিমসিম খাচ্ছে। তার পর যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে ভোগ্যপণ্য কেনার পরিস্থিতি থাকে না। তাতে ভোগ্যপণ্যে কেনার উপরেই কোপটা প্রথম পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমছে।

এই যে বিপুল ভাবে বৈষম্য বাড়ছে, এর ফল কী হচ্ছে? এর ফলে অর্থব্যবস্থায় যে বৃদ্ধি ঘটছে, তার সর্বজনীন সুষম বণ্টন হচ্ছে না। সমৃদ্ধি সীমিত থাকছে মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যেই।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেখানে কমছে সেখানে জিনিসপত্রের দাম এমন লাফিয়ে বাড়ছে কেন? অনেক আগেই প্রকাশিত একটি তথ্য আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন– গত পাঁচ বছরে আদানি গোষ্ঠী-সহ পাঁচটি শিল্পগোষ্ঠী অন্তত ৪০টি ক্ষেত্রে একচেটিয়া ক্ষমতা তৈরি করেছে। এর বাইরেও রয়েছে অন্য একচেটিয়া শিল্পগোষ্ঠীগুলি। এই একচেটিয়া ক্ষমতার মাধ্যমে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় এই কয়েকজনই। এর ফলে তারা যথেচ্ছ দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফা করছে। তাতে ক্রেতা কিছু কমলেও ভারতের মতো বিরাট জনসংখ্যার দেশে মধ্যবিত্তের উপরের দিকে থাকা অংশ এবং উচ্চবিত্ত অংশের ক্রেতাদের থেকেই তারা তাদের মুনাফা তুলে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী আছে যা এই একচেটিয়া কোম্পানিগুলিই উৎপাদন করে। চড়া দাম দিয়েও সাধারণ মানুষ সেগুলি কিনতে বাধ্য হয়। ফলে অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচে মানুষকে কাটছাঁট করতে হয়, যা তাদের জীবন-মানকেই নামিয়ে আনে। এই ভাবে বেকারত্ব, বেতন না বাড়ার সঙ্গে দামবৃদ্ধিও অসাম্যকে বাড়িয়ে তুলছে।

নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় বসার পর আদানি-আম্বানি সহ একচেটিয়া পুঁজি-গোষ্ঠীগুলিকে যে ভাবে রাষ্ট্রীয় মদত দিয়ে চলেছে তা নজিরবিহীন। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ও সম্পত্তি নির্বিচারে এই সব একচেটিয়া পুঁজির হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি শ্রম-আইন বদলে দিয়ে কিংবা স্রেফ আইনের খাতা বন্ধ করে দিয়ে যে ভাবে শ্রমিক শোষণের লাগামছাড়া সুযোগ করে দিচ্ছে, ব্যাপক করছাড় এবং ভরতুকির নামে পুঁজিপতিদের সামনে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে তাতে এই গোষ্ঠীগুলির ভাণ্ডারে পুঁজির পাহাড় জমছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। সরকারি নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দুর্নীতি সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগকেই সরকার পাত্তা না দিয়ে স্রেফ নীরবতার নীতি নিয়ে চলেছে। এরই ফল হিসাবে সরকারি মদতপ্রাপ্ত মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠী উল্কার গতিতে পুঁজির পাহাড় বানিয়ে চলেছে, এমনকি বিশ্ব-পুঁজিগোষ্ঠীর প্রথম সারিতে জায়গা করে নিয়েছে। তাই তো দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশেরও বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ পুঁজিপতির ভাণ্ডারে। আর সমস্ত সম্পদের স্রষ্টা সমাজের নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। উল্টো দিকে, শাসক দলের ভাণ্ডার ভরে দিচ্ছে এই গোষ্ঠীগুলি। আর সেই বিপুল অর্থভাণ্ডার থেকেই শাসক দলগুলি নির্বাচনে অঢেল খরচ করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে চলেছে। সরকারে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মুষ্টিমেয় ধনকুবের পুঁজিপতিদের এই বেআইনি এবং অনৈতিক সম্পর্ককে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাই নাম দিয়েছেন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম তথা স্যাঙাৎতন্ত্র। পচে যাওয়া, প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠা পুঁজিবাদের বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী যুগে বিশ্ব জুড়েই এই স্যাঙাৎতন্ত্রের ছড়াছড়ি।

বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বর্তমান সরকারটি যে আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত সরকার, পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করাই যে তার একমাত্র কাজ, তা মোদি সরকারের কার্যকলাপ থেকে জলের মতো পরিষ্কার। যারা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে গণতান্ত্রিক অর্থাৎ এখানে সকলের অধিকার সমান, এই মনে করে তৃপ্ত থাকেন, মোদি শাসন তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে গোটা ব্যবস্থাটির মধ্যে কোথাও জনস্বার্থ বলে কিছু নেই। মানুষ অনাহারে মরছে, বিনা চিকিৎসায় মরছে, অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকছে, আর নরেন্দ্র মোদি সহ সরকারের মন্ত্রী-আমলা-উপদেষ্টার দল সোল্লাসে ঘোষণা করে চলেছেন– দেশ এগোচ্ছে, আমরা পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছি, আমরা জাপান-জার্মানিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি।

হ্যাঁ, দেশের আর্থিক উন্নতি তো হচ্ছেই! দেশের দেড়শো কোটি মানুষ উদয়াস্ত যে পরিশ্রম করছে, তার তো কিছু না কিছু ফল রয়েছে। কিন্তু সেই ফসল কাদের ভাণ্ডারে গিয়ে জমা হচ্ছে? সেই সম্পদের মালিক কারা? তার মালিক হচ্ছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দল। তাদের সম্পদবৃদ্ধিকেই দেশের সম্পদবৃদ্ধি বলে প্রচার করে চলেছে মোদি-বাহিনী। পুঁজিপতিদের অনুগত অন্য দলগুলিও তাই করছে। কিন্তু এই সম্পদবৃদ্ধির সঙ্গে দেশের শ্রমিক-কৃষক-নিম্ন আয়ের মানুষ, মধ্যবিত্ত মিলে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তাদের সম্পর্ক কী? একটা উন্নত অর্থনীতির দেশ মানে তো দেশের এই সাধারণ মানুষের জীবন-মানের উন্নতি হওয়া। তাদের শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থানের কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা হওয়া। হয়েছে নাকি তা? হওয়া দূরের কথা, যতটুকু যা এতদিনে গড়ে উঠেছিল, সেটুকুও তলিয়ে যাচ্ছে।

আর এই সত্যটাই যাতে মানুষ ধরতে না পারে, জানতে না পারে, তার জন্যই তাদের ধর্মের আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা। উৎসবের নামে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা। তার জন্যই ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে বিরোধকে পাকিয়ে তোলার চেষ্টা। যাতে তারা সমস্ত শোষিত মানুষের মূল শত্রু পুঁজিবাদকে, পুঁজিপতি শ্রেণিকে চিনতে না পারে, যাতে তারা শোষিত মানুষের অন্য একটি অংশকেই শত্রু বলে মনে করে।

দেড়শো বছরেরও বেশি সময় আগে শোষণ-মুক্তির দিশারি মহান কার্ল মার্ক্স দেখিয়ে গিয়েছিলেন যে, পুঁজিবাদের স্বাভাবিক আয়ু শেষ হয়ে গিয়েছে। ধার করা আয়ু নিয়ে সে টিকে আছে। শোষিত মানুষ, শ্রমিক শ্রেণি যে মুহূর্তে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হবে এবং তার ভিত্তিতে সংগঠিত হবে, সে মুহূর্তে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। কিন্তু যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টিগুলির যথেষ্ট শক্তির অভাবে এবং মালিক শ্রেণির সহায়তায় সোস্যাল ডেমোক্রেটিক শক্তিগুলি, যা শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আপসকামী শক্তি, সেগুলির প্রভাব শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে টিকে থাকার কারণে পুঁজিবাদ আজও অবাধ লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সোস্যাল ডেমোক্রেসিকে পরাস্ত করা, অন্য দিকে বিপ্লবী তথা যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে অতি দ্রুত শক্তিশালী করার মধ্য দিয়েই একমাত্র শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা সম্ভব।