অভয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেওয়া, মেডিকেল কলেজ সহ সর্বত্র থ্রেট কালচারের অবসানের মধ্য দিয়ে সমাজে দ্বিতীয় কোনও অভয়ার ঘটনা যাতে না ঘটে তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট (ডব্লিউবিজেডিএফ) অনশনমঞ্চ থেকে গণকনভেনশনের আহ্বান জানিয়েছিল।
‘আমার বোনের বিচার চাই, শেষ না দেখে আমরা থামবো না’– ২৬ অক্টোবর আর জি কর হাসপাতালে গণকনভেনশনে সমবেত হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই অঙ্গীকার। উপচে পড়েছিল হল। বাইরে নানা জায়গায় জায়েন্ট স্ক্রিনের সামনে ভিড় করেছিলেন আরও অসংখ্য মানুষ। ডাক্তার, আইনজীবী, বিজ্ঞানী, ছাত্র-শিক্ষক সমাজকর্মী সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ এ দিন প্রমাণ করে দিল যে আর জি করে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার ৭৮তম দিনেও এই আন্দোলনের গণচরিত্র পুরো মাত্রায় বর্তমান। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী পার্থসারথী সেনগুপ্ত, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক সৌমিত্র ব্যানার্জী, চিত্র পরিচালক ডাঃ কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, আর জি করের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অপূর্ব মুখার্জী, ওই কলেজের রেডিওথেরাপির প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডাঃ সুবীর গাঙ্গুলী, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ শুভঙ্কর চ্যাটার্জী, নার্সেস ইউনিটি-র সম্পাদিকা সিস্টার ভাস্বতী মুখার্জী সহ বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের অন্যতম ডাঃ অনিকেত মাহাত, ডাঃ দেবাশিস হালদার, ডাঃ কিঞ্জল নন্দ, ডাঃ আশফাকউল্লা নাইয়া সহ ডব্লিউবিজেডিএফ-এর নেতৃবৃন্দ সমাবেশের এই বিশালতা দেখে বলেন, প্রশাসনিক বাধা, শাসকের চোখরাঙানি, আন্দোলন ভাঙার বিভিন্ন পদক্ষেপ, আইনি বাধা প্রভৃতি কোনও কিছুই যে আন্দোলনরত ডাক্তার ও সাধারণ মানুষের মনোবলকে এতটুকু টলাতে পারেনি, তাও এদিন আবার প্রমাণিত হয়ে গেল।
দীর্ঘদিন থেকেই এ রাজ্যের চিকিৎসা ক্ষেত্রে চলছে অরাজকতা। পূর্বতন বামফ্রন্টের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান শাসক দলের ছত্রছায়ায় মেডিকেল কলেজগুলিতে তৈরি হয়েছে বেপরোয়া দুর্নীতিচক্র। এরা একদিকে যেমন বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির সাথে যুক্ত, আবার এরাই মেডিকেল কলেজগুলির গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে সর্বত্র ভয়-ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। এদের বিরুদ্ধে বলার বা অভিযোগ জানানোর সাহস কারও ছিল না। ছিল না সন্ত্রাসের শিকার হওয়া ব্যক্তির অভিযোগ জানানোর কোনও সুনির্দিষ্ট জায়গা। এই চক্র কলেজে কলেজে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করে থাকে চূড়ান্ত বেপরোয়া ভাবে। মেডিকেল কলেজগুলিতে বিরাজমান এই থ্রেট কালচারের এক চরম পরিণতি হল আর জি করে অভয়ার ঘটনা। এই হাসপাতালের বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছিল দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের এক চক্র যা বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতি সহ ব্যাপক ভয়-ভীতির পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল। এও জানা যাচ্ছে, সন্দীপ ঘোষ বাহিনী রাজ্যের শাসকদলের সাথে যোগসাজসে যে অন্যায় চালিয়ে যাচ্ছিল অভয়া তা মেনে নিতে পারেননি। অভয়া তাদের কাছে নতি স্বীকার করেননি বলেই তার এই করুণ পরিণতি। আর এই কারণেই অভয়ার মৃত্যুর প্রকৃত সত্য যাতে সামনে না আসে তার জন্য শুরু থেকেই প্রশাসন সক্রিয়। এই উদ্দেশ্য থেকেই টালা থানায় এফআইআর নিতে দেরি করা, শুরুতে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া, বাবা-মাকে দীর্ঘক্ষণ মৃত মেয়ের কাছে যেতে না দেওয়া, ঘটনাস্থলে বহু লোকজনের আনাগোনা, মৃতদেহ দ্রুত নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী সেমিনার রুমের দেওয়াল ভেঙে ফেলা সহ ধৃত সঞ্জয় রায়কেই একমাত্র দোষী বলে দাগিয়ে দিয়ে বাকিদের আড়াল করার চেষ্টা প্রথম থেকেই বারবার করতে দেখা যায় শাসক দল ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই-এর বয়ান থেকে এ-ও জানা যাচ্ছে যে, সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার আগের চারদিনে বহু তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সাথে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির যুক্ত থাকার সম্ভাবনার বিষয়টিও সামনে আসে সিবিআই-এর বয়ানে।
অন্যদিকে এও সত্য যে যদি ডাঃ অনিকেত মাহাতো ও তাঁর সহকর্মী জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃত্বে সেই দিন কিছু পিজিটি ও ডাক্তারি ছাত্র সত্য জানার জন্য ওই মৃতদেহ সরাতে বাধা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্তের দাবি না জানাতেন, তা হলে শাসকদের অভিপ্রায় সফল হত এবং অন্য বহু ধর্ষণ-খুনের ঘটনার মতো এই ঘটনাও অচিরেই চাপা পড়ে যেত। একই সাথে ওই দিনই ডিএসও, ডিওয়াইও, এমএসএস সংগঠন হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ দেখায় এবং এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের পক্ষ থেকে টালা থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সঠিক ভাবে ময়নাতদন্তের দাবি জানান মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক ডাক্তার বিপ্লব চন্দ্র। সে দিনের সময়োপযোগী এই পদক্ষেপই ঘটনার পিছনের প্রকৃত সত্য সামনে আনতে ও সমাজকে জাগিয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল। উদ্বেলিত করেছিল পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশকে। এই আন্দোলনে জুনিয়র ডাক্তারদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ পথে নেমেছেন। তাঁরা যেমন বিচার চেয়েছেন, প্রকৃত দোষীদের শাস্তি চেয়েছেন, তেমনি আর জি করের যে সন্ত্রস্ত পরিবেশ অভয়ার এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী তারও অবসান চেয়েছেন।
বিক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো পশ্চিমবঙ্গের কোণে কোণে যখন ছড়িয়ে পড়েছে তখন চাপে পড়ে বেশ কিছু মেডিকেল কলেজে শাসক দলের মদতপুষ্ট যে কর্তাব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে থ্রেট কালচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। আর জি করে আন্দোলনের চাপে ৫৯ জনকে সুনির্দিষ্ট এনএমসি অ্যাক্ট মেনে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মাথার উপর শাসক সম্প্রদায়ের হাত থাকায় এদের আবার স্বমহিমায় পুনর্বহাল করার চেষ্টা চলছে। শুধু তাই নয়, আর জি করের গণকনভেনশনের দিনেই তারা ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর আসোসিয়েশন (ডব্লিউবিজেডিএ) নামে একটি পাল্টা সংগঠন ঘোষণা করে। এই সংগঠন নিজেদের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া এবং জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট-এর নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমবেত যে আন্দোলন চলছে তাকে কালিমালিপ্ত করা ও ভাঙার উদ্দেশ্যেই যে গড়ে তোলা হল তা কোনও মানুষেরই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাই রাজ্য জুড়ে মেডিকেল কলেজগুলিতে থ্রেট কালচারের মূল অভিযোগ যাদের দিকে তারাই এই নতুন সংগঠনের নেতা। এই সংগঠনের নেতারা আর জি কর হাসপাতাল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে রাজ্যের শাসকদলের এক নেতার সাথে যে মিটিং করে পরামর্শ নিয়েছিল তা তো কারও অজানা নয়। বিগত দিনে ১৯৮৩ সালে সিপিএম সরকারের শাসনকালে জুনিয়র ডাক্তারদের ন্যায্য দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে ভাঙতে একইভাবে গড়ে উঠেছিল জেডিসিএ। সংগঠন দুটির উদ্দেশ্য এক। পার্থক্য হল এইটুকু যে তখন ক্ষমতায় ছিল সিপিএম, এখন তৃণমূল।
তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান কোনও মানুষই এই নতুন সংগঠনকে মেনে নিতে পারছেন না। অভয়ার ঘটনা সমাজের সুপ্ত বিবেক ও চেতনাকে যেভাবে জাগিয়ে দিয়ে গেছে তাকে মেরে দিতে শাসকদলের প্ররোচনায় গড়ে ওঠা এই নতুন সংগঠনের সমস্ত হীন প্রচার ও প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার আওয়াজ উঠেছে কনভেনশন থেকে। হাজার হাজার সংগ্রামী কণ্ঠের দৃপ্ত সমর্থনে তা সর্বসম্মত রূপ নেয়।
যখন ন্যায়বিচারের দাবিতে লক্ষ লক্ষ নর-নারী আন্দোলনের সামিল হচ্ছে, প্রতিবাদে রাত জাগছে, তখন এ রাজ্যের নানুর, জয়নগর, আলিপুরদুয়ার, কৃষ্ণনগর বা অন্য রাজ্যগুলিতে ঘটে চলেছে একের পর এক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা। আর সর্বত্রই চলেছে অপরাধীকে আড়াল করা বা ঘটনাকে লঘু করে দেখাতে শাসকদলের অপচেষ্টার পুনরাবৃত্তি। বাস্তবে এই অপচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে একের পর এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মূল কারণ। সেই কারণকে দূর করলেই পাওয়া যাবে প্রতিকারের পথের সন্ধান।
সমাজে আজ নীতি-নৈতিকতা ও বিবেক-মনুষ্যত্ববোধের যে চূড়ান্ত সংকট, যা মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে শ্রেণিবিভক্ত এই সমাজে শাসক সম্প্রদায়ের টিকে থাকার স্বার্থ। আর মালিক শ্রেণির এই স্বার্থ রক্ষার কাজে শামিল রয়েছে দেশের সমস্ত ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলো। এই দলগুলো মানুষকে বোঝায়– আমাকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনো, তা হলেই সমস্যার সমাধান হবে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি ক্ষোভ থেকে অন্য দলকে ভোট দিয়ে শাসন ক্ষমতায় পাঠায়। কিন্তু সমস্যার কোনও সমাধান হয় না। বরং তা উত্তরোত্তর বেড়ে চলে। এই শ্রেণি-উদ্দেশ্যকে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে।
এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হলে লক্ষ রাখতে হবে লড়াইয়ের অভিমুখটা যেন ঠিক থাকে। যাতে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা যায়, মহিলাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যাতে পরিবর্তিত হয়, শাসক সম্প্রদায়ের সমস্ত দুরভিসন্ধিকে যাতে পরাস্ত করা যায়, সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যাতে সংগঠিত ভাবে রুখে দাঁড়ানো যায়। এর জন্য পাড়ায় পাড়ায় শুভবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষকে একজোট হতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের এই ভয়াবহ পচন ও নারীকে কেবলমাত্র ভোগের পণ্য হিসাবে দেখার এই নোংরা মানসিকতার প্রসার রুখতে তৈরি করতে হবে নারী নির্যাতনবিরোধী অসংখ্য কমিটি। প্রতিটি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে কমিটির সদস্যদের। ভোটবাজ রাজনৈতিক দলের নেতাদের দূরে সরিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তাঁদের মধ্য থেকেই উঠে আসা নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে সমাজটাকে ঢেলে সাজাতে। তবেই ‘অভয়া’দের মর্মান্তিক পরিণতি রুখতে পারব আমরা।