হাথরস কাণ্ডে ন্যায়বিচারের পথে বাধা কোথায়

 

বাঙ্গালোর

হাথরসের এক গ্রামে ১৯ বছরের মনীষা বাল্মিকী গণধর্ষিতা হয়ে ১৫ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে দিল্লির এক হাসপাতালে মারা গেল। শুধু ধর্ষণ নয়, দুষ্কৃতীরা তার জিভ ছিঁড়ে দিয়েছে, মৃত্যু নিশ্চিত করতে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দিয়েছে, শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে। নির্যাতিতার পরিবার অভিযোগ জানিয়েছে এবং মেয়েটি নিজে প্রবল শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েও জবানবন্দী দিয়েছে– সে ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা। তা নিয়ে দেশ তোলপাড়। তোলপাড় হওয়াই উচিত।

‘মহান’ এই দেশে আইনের চোখে সবাই সমান হলেও দেশটা ভারতবর্ষ হওয়ায় এবং তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দুসমাজ হওয়ায় বাস্তব চিত্রটা একেবারেই অন্য রকম। যে সমাজটা জাত-পাতের উঁচু-নিচুর সুকঠিন কাঠামো দিয়ে গড়া, সেই সমাজে অপরাধ বিচারে তাই শুরু হল জাত-পাতের হিসাব-নিকেশের কাঁটাছেড়া। সরল একটা সমীকরণ দাঁড় করানো হল– মেয়েটি দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত এবং যারা অভিযুক্ত তারা ঠাকুর সম্প্রদায়ের।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য উত্তরপ্রদেশের ঘটনা এটি। গণতন্ত্র সেখানে ‘বিরাজমান’। কিন্তু গণতন্ত্র তো আর স্বয়ংক্রিয় যান নয় যে একা একা চলবে! ওটাও কাউকে চালাতে হয়। চালায় ভোটের ফলাফলে জেতা দলের লোকজন। এই লোকজনেরও নানা হিসাব নিকেশ আছে, আছে জটিল অঙ্ক। সে অঙ্ক মেলাতে পারাটাই আসল। ফলে অভিযোগ এল, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন পুলিশ অ্যাকশন নিতে শুরু করল – ব্যাপারটা এমন মোটেই নয়।

এই রাজ্যে স্বয়ং দলিতনেত্রী মায়াবতী আছেন, আছেন পিছড়ে বর্গের মুলায়মজি এবং তাঁর পুত্র অখিলেশজি। ভীমসেনার প্রধান চন্দ্রশেখরজিও এখন দলিতস্বার্থের অন্যতম মুখ বলে প্রচারিত। প্রথমোক্ত তিনজন নিজেরাই বড় সমস্যায়। গণতন্ত্রের পাহারাদার মোদিজির হাতে সিবিআইয়ের লাটাই। দুর্নীতি বা দলিতদের কোনও ইস্যু নিয়ে তেড়েফুঁড়ে উঠে মোদিজি বা তাঁর দলকে বেকায়দায় ফেলতে চাইলেই সেই লাটাইয়ে টান পড়ে। অতএব হাথরসের এতবড় ইস্যুকে শুধু তাঁদের ফ্যালফ্যাল করে দেখতে হচ্ছে। ভীমসেনা প্রধান বলে দিয়েছেন – তিনি ছাড়বেন না, তাঁকে রোখা যাবে না। যেমনটি মায়াবতীজিরা আগে বলতেন!

যোগীজি নিজে ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোক। তার ওপর তিনি যোগীপুরুষ।

সমীকরণটা হল, মায়াবতীর সমর্থকরা নিশ্চুপ, নিশ্চুপ অখিলেশজি এবং তাঁর পিতাজি। সে রাজ্যের মুসলমানরা কথা বললে তো ‘কাফিল খানের পরিণতি’। কংগ্রেস দলটি সে রাজ্যে অতি দুর্বল। ফলে সবদিকই প্রায় সামলানো গেল।

এতদিক সামলানো গেলেও এদিকে জনমনে ‘ছি ছি রব’ এবং মিডিয়ার ‘বাড়াবাড়ি’। তাই এবার দ্বিতীয় অঙ্কে প্রবেশ।

বিজেপির এক নেতার কথায় ‘পরিবারের সম্মতি নিয়েই মেয়েটির দেহ জ্বালিয়ে দিয়েছে পুলিশ’। অতএব পুলিশ ‘নির্দোষ’। ‘মেয়েটিকে ধর্ষণের কোনও প্রমাণ নেই’– বলেছে স্বয়ং পুলিশ। এই সূত্রেই ঠাকুর সম্প্রদায়ের সাত-আটশো লোক জমায়েত হয়ে দাবি জানিয়েছে,– পুলিশ তা হলে তাদের নির্দোষ ছেলেদের গ্রেপ্তার করে রেখেছে কোন আইনে? এক অভিযুক্ত বলেছে, মেয়েটির সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরিবার তা মানতে পারেনি, তাই মেয়েটির ভাই এবং মা মেয়েটিকে মেরে ফেলেছে। ইতিমধ্যে যোগী সরকার খোঁজ পেয়ে গিয়েছে এই ঘটনা নিয়ে জাতি-দাঙ্গা বাধানোর জন্য এক আন্তর্জাতিক ‘সাজিস’ এর। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের নামে ১৯ এফআইআর করা হয়েছে। তাদের একজন নাকি নির্যাতিতার পরিবারকে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলার জন্য ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল। এদিকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন ডিজিপি অভিযোগ করেছে একটি সংগঠনের সঙ্গে একশো কোটি টাকা নাকি এর জন্য লেনদেনও হয়ে গিয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি দায়ে পড়ে বলতে বাধ্য হয়েছে যে এমন ধরনের লেনদেনের খবর তাদের জানা নেই। তবুও সেই প্রাক্তন ডিজিপি-র বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নিল না। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ অনুযায়ীই ৫ অক্টোবর হাথরাস যাওয়ার পথে চার সাংবাদিককে গ্রেপ্তারও করে ফেলেছে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ। ঘটনাক্রমে সেই চারজন সাংবাদিক আবার ধর্মে ‘মুসলমান’।

দেশে এতকিছু ঘটলেও মোদিজির মুখে এনিয়ে ‘টু-শব্দটি’ নেই। তিনি এখন ‘মাস্ক-আপ ইন্ডিয়া’ নিয়ে পুরো প্রশাসনকেই নামিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বড় মাথাব্যথা হল বিহারের নির্বাচন। উত্তরপ্রদেশের অঙ্কের সঙ্গে বিহারের সমীকরণ মেলে না। দলিত সেন্টিমেন্টে পাঁচ বছর আগের ভোটে বিহারে তাঁর দলের হাল কী হয়েছিল তা তিনি নিশ্চয়ই স্মরণে রেখেছেন। তাই তিনি না পারছেন গিলতে, না পারছেন ওগরাতে।

এ সবই ‘ভোট রাজনীতির খেলা’। কিন্তু দলিত নির্যাতিতার বিচারের কী হবে? সেই পরিবারের পক্ষে ‘দলিতদের’ নিয়ে যাঁরা লড়ছেন, তারা কি পারবেন দলিত নির্যাতন রোধ করতে? নাকি জাত-পাতের রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে উল্টো ফল হবে? এই প্রশ্নটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই দলিত নিয়ে ‘উচ্চবর্ণে’র গর্বিত মানুষদের মনোভাবটা কী তা একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন।

এই ভারতবর্ষই কিছুদিন আগে দেখেছে তামিলনাড়ুর ভেলোর জেলার বানিয়ামবাড়ি এলাকার কুপ্পান নামে দলিত সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির মৃতদেহ পালান নদীর সেতুর উপর থেকে দড়ি বেঁধে নিচে নামানো হচ্ছে। কারণ, পায়ে হেঁটে ¬শানে যেতে যে রাস্তাটা পেরোতে হয়, সেটা ‘উচ্চবর্ণে’র যাতায়াতের পথ। সেখানে দলিতের পা রাখার অধিকার নেই। তাই, ‘অস্পৃশ্য’র মৃতদেহ দড়িতে ঝুলিয়ে নদীর চরে ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না! রাজস্থানের মেহসানা জেলার লোহর গ্রামে দলিত সম্প্রদায়ের মেহুল পারমার ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ায়় গ্রামের সরপঞ্চ ও সহকারী সরপঞ্চ ঘোষণা করে হরিজনরা ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে গিয়ে চরম সামাজিক সীমা ছাড়িয়েছে, তাই তাদের সামাজিক বয়কট করা হল। উত্তর প্রদেশের হরদোই জেলার ভাদেসায় দলিত পরিবারের মনু কুমারের সাথে এক উচ্চবর্ণের পরিবারের মেয়ের ভালবাসার সম্পর্ক থাকায় মনুকে কেরোসিন ঢেলে তাকে পুড়িয়ে মারা হল। হাথরসের জঘন্য অত্যাচারও তো এরই ধারাবাহিকতা।

এ ধরনের অত্যাচারের কাহিনী তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। আইনও এইসব অত্যাচার ও অপরাধ আটকাতে পারছে না। ‘এক দেশ, এক আইন’ ছেড়ে আলাদা করে The Scheduled Castes and Scheduled Tribes (Prevention of Atrocities) Act করেও সামাজিক এই অত্যাচার আটকানো যাচ্ছে না।

তা যাবেই বা না কেন! সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মস্তিস্ক থেকে যাঁদের জন্ম, সেই ব্রাহ্মণরা কেন পা থেকে জন্মানো শূদ্রদের দ্বারা দূষিত করা চলার পথে হাঁটবে? কেন ‘নিচুজাত’ হয়ে ‘উঁচুজাতের’ মেয়েকে ভালবাসবে? হরিজন হয়ে কেন ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবে? তা হলে ব্রাহ্মণরা আর তাদের থেকে আলাদা কী? এ তো শাস্ত্র কথিত। তাকে মান্যতা না দেওয়াই তো সামাজিক অপরাধ!

এ প্রসঙ্গে দেশের গণ্যমান্যদের কথা শোনা যাক। কিছুদিন আগে, ১৯ জুলাই’১৯, কোচি শহরে তামিল ব্রাহ্মণদের ‘গ্লোবাল মিট’-এ কেরালা হাইকোর্টের বিচারপতি ভি ছিতাম্বরেশ বলেছেন,‘‘ব্রাহ্মণ মানে একজন দ্বিজ, যার দু’বার জন্ম হয়। পূর্বজন্মের পূণ্যের ফলে দু’বার জন্মানোর সুযোগ পান ব্রাহ্মণরা। একজন ব্রাহ্মণের চরিত্রের বেশ কিছু গুণ আছে। পরিচ্ছন্নতা, উচ্চাকাঙক্ষা, দৃঢ় চরিত্র, মূলত নিরামিষাশী। … কোনও ভাবেই ব্রাহ্মণ সমাজের কাউকে কেউ অবহেলা করলে রুখে দাঁড়ান। … সমাজের সব উচ্চপদ তাঁদের পাওয়া উচিত।” আর ১১ সেপ্টেম্বর ‘১৯, কোটা শহরে ‘অখিল ব্রাহ্মণ মহাসভা’র সম্মেলনে স্বয়ং লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা বললেন, ব্রাহ্মণরা জন্মসূত্রেই শ্রেষ্ঠ, তারাই সমাজকে পরিচালনা করেন। তাই কোনও গ্রামে একটি ব্রাহ্মণ পরিবার থাকলেও তাঁর স্থান সব সময় উচ্চে থাকে। ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের হাইকোর্টের বিচারপতি এবং লোকসভার স্পিকারের কথা!

ব্রাহ্মণ বা অন্য ‘উচ্চবর্ণে’র মানুষের শুচিতা ও শুদ্ধতা বজায় রাখতে যে নিয়ম বা রীতি প্রচলিত আছে তা মেনে চলতে গিয়ে ‘নিম্নবর্ণে’র মানুষকে সহ্য করতে হচ্ছে মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অবমাননা। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার, সামাজিক অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত। তার কারণ, আমাদের দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যখন সমানাধিকারের দাবি ওঠে, তখন শুধু রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে ভোটাধিকার সহ কিছু ক্ষেত্রে সেই দাবিই অর্জিত হয়। সমাজের গণতন্ত্রীকরণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই হয় অবহেলিত। পরিণতিতে এ দেশে প্রচলিত হয় জাতপাত ভিত্তিক দল ও জাতপাতের রাজনীতি। উচ্চবর্ণের নিম্নের প্রতি ঘৃণা এবং নিম্নবর্ণের উচ্চের প্রতি ক্ষোভ– এটাই হয় ধড়িবাজ রাজনীতিকদের পুঁজি। পুঁজিপতি শ্রেণি জনতার ঐক্য ভাঙতে এই বিভেদকে খুঁচিয়ে তোলো।

আইনের চোখে সবাই সমান বললেও, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই ‘সমানতা’ প্রতিষ্ঠিত হতে তাই পদে পদে বাধা। মুখে সমান বললেও বাস্তবে ব্রাহ্মণ ও দলিত এক রাস্তা দিয়ে যেতে পারে না, এক কুয়োর জল খেতে পারে না। ‘উচ্চবর্ণে’র মানুষের কৌলিন্য বজায় রাখার স্বার্থে ‘নিম্নবর্ণে’র মানুষের ঘোড়ায় চড়া যাবে না, ‘উচ্চ’ ও ‘নিচু’ বর্ণের নারী ও পুরুষের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠলে অপরাধ বলে গণ্য হবে। যদি নিম্নবর্ণের মানুষ সে সব করে, তা হলে ‘উচ্চবর্ণে’র মানুষ সেটাকে ঔদ্ধত্য বলে গণ্য করবে এবং ‘সামাজিক শাস্তি’র ফতোয়া দেবে। আর ‘নিচুজাতে’র প্রতি ঘৃণা, লাঞ্ছনা যেন ‘উঁচুবর্ণে’র অধিকার!

প্রশ্ন হল, হিন্দু সমাজে ‘নিম্নবর্ণে’র উপর এই অত্যাচার কি চলবেই? সরাসরি উত্তর হল, শাস্ত্রানুসারী হিন্দুধর্ম বজায় থাকলে এই সামাজিক অত্যাচার চলবে। কারণ, হিন্দুধর্ম ঋগ্বেদের আদিপর্ব মেনে চলে না, চলে চতুর্বর্ণ অর্থাৎ বর্ণভেদ প্রথা মেনে। বর্ণভেদ প্রথাটাই এখানে ধর্মের এবং হিন্দু সমাজের মূল কাঠামো। বর্ণভেদ না থাকলে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারবর্ণ না থাকলে হিন্দুধর্মের কাঠামোটাই ভেঙে পড়ে। তা হলে হিন্দু ধর্মটাই আর থাকে না। তাই হিন্দুধর্মে অনেক মানবপ্রেমিক ধর্মীয় মহাপুরুষ এসেছেন, তাঁরা এই সব ভেদভাব দূর করার জন্য অনেক মূল্যবান বাণী রেখেছিলেন। তাঁদের অনেক বাণীই শাস্ত্রানুসারী হয়নি। এক সময় সে সব বাণী সমাজে আলোড়নও তুলেছে, হিন্দু ধর্মে বর্ণভেদ প্রথা ভেঙে ধর্ম-সংস্কারের দাবিও উঠেছে। কিন্তু সেই ধর্মীয় নেতাদের মৃত্যুর পর তাঁদের ভক্তবৃন্দ, সেই বর্ণভেদ সৃষ্টিকারী শাস্তে্রই মুখ গুঁজেছেন। শাস্তে্রই যেখানে ভেদনীতির মূল রয়েছে, সেখানে হিন্দুধর্মে ‘সমানতা এবং ‘সমভাব’ আসবে কী করে? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, শূদ্র– এই চার বর্ণ থাকবে, আর ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র সমান হবে– এটাও কি হতে পারে? তাই এই হিন্দুধর্মটাই এই ধর্মের অভ্যন্তরে ‘সমতা’ বিরোধী। অবশ্য শুধু হিন্দু ধর্ম কেন, ইসলাম কিংবা খ্রিস্ট– সব ধর্মেই এই বিভাগ এবং বিভেদ স্পষ্ট। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের ঐক্য আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দলিতদের ক্ষোভকে পুঁজি করে যেভাবে প্রতিপদে দলিতদের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা চলেছে, তাতে একদিকে উচ্চবর্ণের অত্যাচার অন্য দিকে তথাকথিত ‘মসিহাদের’ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন দলিত সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ। উচ্চবর্ণের ‘নিম্নবর্ণের প্রতি ঘৃণা’ই তাদের রাজনীতির পুঁজি।

কেউ কেউ মনে করেন দলিত-ক্ষমতায়নই একমাত্র দলিত সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং এই রাস্তাতেই দলিতদের দুরবস্থা দূর হতে পারে। এই ক্ষমতায়ন বলতে তাঁরা কী বোঝেন? তাঁরা মনে করেন, দলিত এমএলএ-এমপি হওয়া, মন্ত্রী হওয়া, দলিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করাই দলিত-ক্ষমতায়ন। কিন্তু এ যদি হয়-ও তাতে কি দলিত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তা যদি হত তবে তো আজ দলিত-সমস্যা বলে দেশে কিছু থাকতই না। কারণ রাজ্যে রাজ্যে দলিত নেতা-মন্ত্রী, এমএলএ-এমপি-মন্ত্রী তো কম হল না, তাদের সরকারও কম হয়নি। মুলায়ম, মায়াবতী, লালুপ্রসাদের মতো নেতারা রাজ্যে রাজ্যে সরকার গড়েছেন। এমনকি ভারতের রাষ্ট্রপতিও এখন একজন দলিত। পেরেছেন নাকি তাঁরা সমাজ জুড়ে দলিতদের উপর শোষণ, অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকার করতে, তার মাত্রা তিল পরিমাণ কমাতে? পারেননি। সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বরং শোষণের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে সমগ্র শোষিত দেশবাসীর মতো তাদের দুরবস্থাও বেড়েছে। এই রাস্তায় যদি সম্ভব হত তবে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তো আমেরিকায় কালো মানুষেরা বর্ণবৈষম্যের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যেত।

দলিত সমস্যাটি ভারতে সুদূর অতীত থেকে, যেদিন সমাজ চার বর্ণে বিভক্ত হয়েছিল সেদিন থেকেই আজও চলে আসছে। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন সত্তে্বও দলিত-সমস্যা অটুট থাকল কী করে? আজ তো সামন্তী ব্যবস্থা নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদ নেই। সমাজ পরিচালিত হয় গণতান্ত্রিক সংবিধান মেনে। তবুও বর্ণভেদের এই অন্যায় ব্যবস্থাটি থেকে গেল কী করে? কোন সে সামাজিক ভিত্তি যাকে কেন্দ্র করে বহু যুগের এই বৈষম্যমূলক, অন্যায়, অমানবিক ব্যবস্থাটি আজও পর্যন্ত টিকে থাকল? সমাজে তার টিকে থাকার এই ভিত্তিটি হল শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, যা তার নিজের তৈরি সংকটে আজ নিজেই হাবুডুবু খাচ্ছে। শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি চায় না নাগরিক মাত্রেই সমান অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে। শুধু বর্ণ নয়, সংকটগ্রস্ত পুঁজিপতি শ্রেণি তার সঙ্কট থেকে বাঁচতে দেশের নাগরিকদের নানা ধর্মেও বিভক্ত করে রাখতে চায়। তাদের পরস্পরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত রাখতে চায়, যাতে তাদের জীবনের সমস্ত সমস্যার মূলে যে রয়েছে এই শোষণূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সেটা তারা ধরতে না পারে এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে না পারে।

আমাদের দেশে সংসদীয় বাম কিংবা মার্কসবাদী নামধারী দলগুলি ভারত রাষ্টে্রর শ্রেণি-চরিত্রটি সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে না পারায় দলিত-সমস্যাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসাবেই দেখে। তারাও মনে করে দলিতদের ক্ষমতায়ন মানে এমএলএ-এমপি-মন্ত্রী হওয়া, সরকার গঠন করা। এই ভাবনা থেকেই তারা এমনকি ‘জাতের লড়াই-ই শ্রেণির লড়াই’ এমনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। সিদ্ধান্তটি শুধু ভ্রান্তই নয়, এর দ্বারা যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জাতিভেদকে প্রতিপালন করছে, তা টিকে থাকতে সাহায্য করে চলেছে, তাকে না ভেঙে যে দলিত জনগণের মুক্তি মিলবে না, সেই সত্যটিকেই আড়াল করা হয়। এই ভ্রান্ত রাজনীতির জন্যই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের একটি অংশ হিসাবেই দলিতদের সংগঠিত করা এবং গণআন্দোলনে সামিল করার পরিবর্তে তারা বর্ণবাদী সংগঠনগুলির, দলগুলির লেজুড়বৃত্তি করে দু-একটা এমএলএ-এমপি পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। আর দলিত সমস্যা যেমন ছিল তেমনই থেকে গেছে। আজ দলিতদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্ত রকমের শোষণ-বৈষম্যের থেকে সত্যিই মুক্ত করতে হলে, তাদের সমস্যাকে বিচ্ছিন্ন হিসাবে না দেখে সামগ্রিক ভাবে শোষিত মানুষের সম্যসা হিসাবে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে দেখতে হবে এবং এই সমস্যাগুলিকে শোষণমুক্তির সামগ্রিক সমস্যার সাথে যুক্ত করে তাদের বৃহত্তর গণআন্দোলনের শরিক করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে না ভেঙে দলিত সমস্যার সমাধান হবে না। আর যদি একে শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসাবে দেখা হয় তবে ভবিষ্যতে হয়ত বারবার কাঁসিরাম, মায়াবতী, মুলায়ম, লালুপ্রসাদর মতো আরও নতুন নতুন নেতা তৈরি হবে, তারা এমএলএ-এমপি-মন্ত্রী হয়ে ক্ষমতা ভোগ করতে থাকবে, মণ্ডল রাজনীতির মতো কিছু ধুরন্ধর ক্ষমতালোলুপ রাজনৈতিক নেতা ও দলের জন্ম দেবে, দলিত মানুষের মুক্তি অধরাই থেকে যাবে।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৯ সংখ্যা_১৭ অক্টোবর, ২০২০)