সত্তর বছরে ন্যাটো যুদ্ধ, গণহত্যা ও ধ্বংসের কারিগর

নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) এ বছর তার ৭০ বছর পূর্তি উৎসব করছে৷ বিপরীতে বিশ্বশান্তি সংস্থা গত মার্চ মাসের শেষ দিকে খোদ আমেরিকার বুকেই ন্যাটো বিরোধী সম্মেলন করে ন্যাটোর যুদ্ধ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে৷

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে ফ্যাসিস্ট জার্মানির পরাজয় ও বিশ্বজোড়া সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের জয়গান শুরু হওয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধুয়া তোলে রাশিয়া অস্ত্রের জোরে ইউরোপে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, আত্মরক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমরসজ্জা গড়ে তোলা দরকার, সামরিক ঐক্য দরকার৷ সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এই প্রচার ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা৷ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণাই করেছিল তারা কাউকে আক্রমণ করবে না, সমগ্র বিশ্বে নিরস্ত্রীকরণ করা হোক৷ কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা সে কথায় কর্ণপাত করেনি৷ আমেরিকা, ব্রিটেন এবং কানাডা ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ন্যাটো সামরিক জোট গড়ে তোলে৷ এটিতে সদস্য দেশের সংখ্যা বর্তমানে ২৯৷ ন্যাটোর নীতি হিসাবে বলা হয়, সদস্য কোনও একটি দেশের ওপর আক্রমণকে সব সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করা হবে৷ গঠিত হওয়ার পর থেকেই ন্যাটো ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’র কথা বলে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল৷ ওই বছরই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ড্রুম্যান গোপনে ‘অপারেশন ড্রপসট’ নামে একটি প্রকল্প নেন৷ এর উদ্দেশ্য ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ করে দেশটিকে ধবংস করা৷

ন্যাটো গঠনের সময় আমেরিকা সরকারের অন্যতম নীতি নির্ধারক জর্জ কিনান বলেছিলেন, পশ্চিমি দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অভ্যন্তরীণ সমস্যা হল কমিউনিস্টরা৷ ন্যাটো কম্যান্ডার ডি ডি আইসেনহাওয়ার বলেছিলেন, ন্যাটোর সামরিক শক্তি, যা আমরা বাডাচ্ছি, তার আশু ব্যবহার কমিউনিস্ট আগ্রাসন থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার বিষয়ে আস্থা জোগাবে এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ করবে৷   

ন্যাটো গঠনের পরের বছর কানাডা সরকার একটি অত্যন্ত গোপনীয় প্রকল্প PROFUNC (Prominent Functionaries of the Communist Party-র সংক্ষিপ্ত রূপ) গ্রহণ করে৷ ১৯৫০ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত চালু এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় কানাডার কমিউনিস্টদের ও কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্নদের চিহ্ণিত করা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে কোনও অভিযোগ ছাড়াই কমিউনিস্ট ও তাদের সমর্থকদের দ্রুত দলে দলে আটক করা৷

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্টরা ইতালিতে মুসলিনিকে, গ্রিসে ফ্যাসিস্টদের এবং ফ্রান্সে নাৎসিদের দখলদারির বিরোধিতা করেছিল৷ এর ফলে কমিউনিস্টদের সম্মান অনেকটাই বেড়ে যায়৷ মার্কিন ও ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ না থাকলে কমিউনিস্টরা মস্কোর সমর্থন ছাড়াই গ্রিসে ক্ষমতা দখল করতে পারত এবং ১৯৪৮ সালে ইতালিতে জয়লাভ করতে পারত৷ ফ্রান্সে কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধ পরবর্তী প্রথম নির্বাচনে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷

ন্যাটোর রূপকাররা ভীত হয়ে পড়েছিল যে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণি ও কায়েমি শক্তিগুলির আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগবে৷ ক্রমবিকাশমান বাম দলগুলি ও তাদের আন্দোলনগুলির মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের ধনিক শ্রেণির আত্মবিশ্বাস বাডানোর জন্য পশ্চিম ইউরোপে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করা হয়৷ কমিউনিস্ট দলগুলি যাতে ক্ষমতা অর্জন না করতে পারে সেজন্য ‘গোপন কমিউনিস্টবিরোধী প্রোটোকল’ গ্রহণ করেছিল সদস্য দেশগুলির গোয়েন্দা সংস্থাগুলি৷ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এলে ন্যাটো, সিআইএ এবং এম–১৬ ‘স্টে–বিহাইন্ড’ অপারেশন চালাবার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যার অর্থ সৈন্যবাহিনী ও অর্থ, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করা, মিথ্যা সংবাদ রটনা প্রভৃতির সাহায্যে যার প্রতিরোধ করা যায়৷ সোভিয়েত আগ্রাসনের গল্পও ছড়ানো হয়৷ কিন্তু বাস্তবে সে রকম কিছুই ঘটেনি৷ কোথাও কোনও সোভিয়েত আগ্রাসন না হলেও ন্যাটোর গোপন বাহিনী বিভিন্ন দেশে অস্ত্রশস্ত্র জমা করেছিল এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে গোপন যুদ্ধ চালাচ্ছিল৷ তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও মানবাধিকার লঙঘনের ঘটনা ঘটাত কিন্তু সেগুলির জন্য মিথ্যা কমিউনিস্টদের দায়ী করে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করত৷

মহান স্ট্যালিনের জীবদ্দশায় তো বটেই, পরবর্তী সময়েও সাম্রাজ্যবাদীরা কোথাও সরাসরি ন্যাটোকে দিয়ে আগ্রাসন ঘটায়নি৷ তাদের ভয় ছিল পাল্টা সোভিয়েত প্রতিরোধের৷ ইরাকে প্রথম মার্কিন আগ্রাসনের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলেও, গরবাচভের নেতৃত্বে সোভিয়েত তার সমাজতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছিল৷ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর ন্যাটো, তাদের ‘আত্মরক্ষার ঢাল’–এর মুখোশ ছেড়ে দাঁত–নখ বের করে এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের সীমানা পর্যন্ত, সম্পূর্ণ উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও তাদের সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করে৷ ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে ন্যাটোর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক আক্রমণ হয় ক্ষুদ্র দেশ যুগোস্লাভিয়ায়৷ ন্যাটো ৭৯ দিন ধরে ওই দেশটির উপর আগ্রাসন চালায়৷ বিল ক্লিন্টন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ হাজার হাজার ক্লাস্টার বোমা, নাপাম বোমা ফেলে স্কুল, হাসপাতাল, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়৷ আসামরিক ঘরবাড়ি লক্ষ্য করে ২৩ হাজারেরও বেশি বোমা বর্ষণ করে ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং কসোভো দখল করে নেয়৷ ইউনাইটেড নেশনস কমিশনার অফ রিফিউজি বলেছে, প্রথম নথিভুক্ত উদ্বাস্তু হল কসোভো থেকে, যুগোস্লাভিয়ায় বোমাবর্ষণ শুরু হবার তিন দিন পর৷ যুগোস্লাভিয়ায় এই আক্রমণ দরকার ছিল বলে জনমত সংগঠিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালায় পশ্চিমি রাজনীতিকরা ও প্রচারমাধ্যমগুলি৷ এজন্য তারা সার্বদের নৃশংসতার অবিরাম অভিযোগ তুলতে থাকে৷ অথচ এটা প্রমাণিত যে যুগোস্লাভিয়ার ওপর আক্রমণ করে অনেক অনেক বেশি নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে ন্যাটো৷ তারা যুগোস্লাভিয়ায় আন্তর্জাতিক ভাবে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা এবং ইউরেনিয়ামযুক্ত বোমা নিক্ষেপ করেছে৷ বাস্তবে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে এই মারাত্মক আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল যে সমস্ত দেশ স্বাধীনভাবে চলতে চাইবে তাদের ভয় দেখানো৷ শান্তি চুক্তির নামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যুগোস্লাভিয়ার অর্থনীতি ধবংস করতে চেয়েছিল৷ কারণ যুগোস্লাভিয়ার অর্থনীতি ছিল শক্তিশালী এবং তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প ছিল৷ সেখানকার জনসাধারণ ব্যাপক বেসরকারিকরণের প্রতিরোধ করছিল৷ যুগোস্লাভিয়া নিজেদের ওষুধপত্র, বিমান এবং মোটরগাড়ি তৈরি করত৷ তারা তাদের দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে অনুমতি দিতে অস্বীকার করে৷ যুগোস্লাভিয়া নিরপেক্ষ নীতি নিয়ে চলছিল এবং তারা ন্যাটোয় যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল যা সাম্রাজ্যবাদীরা মানতে পারেনি৷ কসোভোয় ন্যাটো বাহিনী প্রবেশ করার পর নিউইয়র্ক টাইমস ঘোষণা করেছিল যে কসোভোর নতুন মুদ্রা হবে ডলার বা জার্মান মার্ক৷ ওয়াশিংটন টাইমসের বলকান বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল সেরওয়ের বলেন, বেলগ্রেডে এমন একটি সরকার আছে যারা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক যে ধরনের অর্থনীতি চায় তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়৷ ২০০১ সালের পর আফগানিস্থানে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও আফগানিস্থান দখলের ক্ষেত্রেও ন্যাটোর ভূমিকা ছিল৷ ইরানে বিধ্বংসী আক্রমণ চালায় ন্যাটো৷ ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’–এর অজুহাতে ২০১১ সালে লিবিয়ায় আক্রমণ ন্যাটো করেছিল৷ বাস্তবে বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ন্যাটো প্রাথমিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ সম্প্রতি ভেনেজুয়েলায় মাদুরো সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য ন্যাটো কলম্বিয়া ও ব্রাজিলকে, যেখানে চরম দক্ষিণপন্থী সরকার আছে, তাদের বিশ্বব্যাপী অংশীদার হবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷

কানাডা সরকার ভান করে যে তারা মানবাধিকারকে সম্মান করে৷ কিন্তু বাস্তবে তারা গণতন্ত্র ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব, যা মানবাধিকার রক্ষার গ্যারান্টি, তা বিশ্বায়নের নামে লঙঘন করে৷ ন্যাটোর সদস্য দেশ হিসাবে কানাডার স্থল ও বিমান বাহিনী বিভিন্ন দেশে ন্যাটোর আগ্রাসনের অংশীদার৷ শুধু তাই নয়, কানাডার বাহিনী পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর ঘাঁটিতে মোতায়েন হয়ে ইউক্রেনের ফ্যাসিস্ট সরকারকে সাহায্য করছে৷ ২০১৭ সালে কানাডার ট্রুডো সরকার ন্যাটোর প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে নতুন যুদ্ধজাহাজ ও ফাইটার জেট কেনার জন্য তাদের বার্ষিক সামরিক বাজেট ৭০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি করেছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করার অঙ্গীকার করেছে৷ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ন্যাটোর সদস্য দেশগুলিকে আহ্বান করেছে তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট দেশের জিডিপির ৪ শতাংশ করতে৷ প্রতিরক্ষা বাজেট এতটা বৃদ্ধি করতে হলে হয় বিপুল হারে ট্যাক্স বাড়াতে হবে, নয়ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যাপক ভাবে বরাদ্দ হ্রাস করতে হবে অথবা দুটিই করতে হবে৷ যাই হোক না কেন সাধারণ মানুষকেই এর ফল ভোগ করতে হবে৷

বর্তমানে ন্যাটো ও আমেরিকা লক্ষ লক্ষ সেনা মোতায়েন করছে ডেনমার্ক, সুইডেন, প্রভৃতি নর্ডিক দেশগুলির পাশাপাশি এস্টোনিয়া, লাটভিয়ার মতো বাল্টিক দেশগুলি থেকে শুরু করে বুলগেরিয়া পর্যন্ত৷ গত বছর সুইডেন ও নরওয়েতে ৫০ হাজার সেনার মহড়া চালানো হয়েছিল৷ নরওয়ে, পোল্যান্ড ও রোমানিয়াতে বসানো হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা৷

মধ্যপ্রাচ্য এখন সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে যুদ্ধ উত্তেজনার স্থান৷ সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে৷ পরমাণু চুক্তি বাতিল করে ইরানকে হুমকি দিচ্ছে৷ প্রতিদিন ইজরায়েলের দ্বারা প্যালেস্টিনীয়দের হত্যা চলছে৷ তুরস্ককে দিয়ে সিরিয়া ও ইরাকে আগ্রাসন করা হয়েছে, ইয়েমেনে আগ্রাসন চালানো হয়েছে সৌদি আরবকে দিয়ে৷

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন, সিরিয়ার গোলান হাইটস অঞ্চল যা ৫২ বছর ধরে ইজরায়েল দখল করে রেখেছে, তা দখলদার ইজরায়েলের হাতে তুলে দেওয়া হবে৷ গত ফেব্রুয়ারি মাসে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা এক সভায় সিদ্ধান্ত করেছেন, এমন প্রস্তুতি রাখতে হবে, যাতে ৩০টি যুদ্ধজাহাজ, ৩০ ব্যাটেলিয়ান সৈন্য ও ৩০টি যুদ্ধ বিমান ইউনিট ৩০ দিনের মধ্যে পৃথিবীর যে কোনও স্থানে নিয়োগ করা যায়৷

এ কথা পরিষ্কার যে, দক্ষিণ–পূর্বভুমধ্য অঞ্চলে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, তেল ও পণ্যের পরিবহণ পথের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবাধীন অঞ্চলকে সামরিকভাবে কব্জা করার জন্য প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে৷ এই দ্বন্দ্ব সমগ্র বিশ্বজুড়েই চলছে– অ্যান্টার্টিক অঞ্চল থেকে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, ককেশাস থেকে বলকান অঞ্চল ও আফ্রিকা– কোনও অঞ্চল বাইরে নেই৷ আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে৷ সমগ্র বিশ্ব যেন একটা ভূমিকম্পের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, ছোট ছোট বিস্ফোরণ এখানে–সেখানে ঘটছে, যেন বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷

ন্যাটোর সাম্প্রতিক আগ্রাসী ভূমিকার কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে কার্যকলাপ  বাড়িয়ে ন্যাটো রাশিয়ার সীমান্তে অস্ত্রসম্ভার মজুত করতে চাইছে৷

 দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপে সামরিক ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে যুদ্ধজাহাজ জমা করা হচ্ছে৷ গ্রিসে পুরনো সামরিক ঘাঁটি আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে৷ বলকান অঞ্চলে উত্তর ম্যাসিডোনিয়াকে ন্যাটোর সদস্য করে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে৷ ল্যাটিন আমেরিকাতেও ন্যাটো জাল বিস্তার করতে কলম্বিয়াকে সদস্য করতে যাচ্ছে৷ এমনকী ব্রাজিলকেও ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গণহত্যাকারী এই সংস্কৃতি তার নতুন রণনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছে, ভবিষ্যতে যুদ্ধ আটকাতে হলে ন্যাটোর নিজস্ব যুদ্ধক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ এর অর্থ ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না৷ তাদের টার্গেট ব্যাখ্যা করা হয়েছে– রাশিয়া, দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া অঞ্চলে সমরশক্তি বৃদ্ধি৷ এর পূর্ব শর্ত হিসাবেই ন্যাটোর সদস্য সকল রাষ্ট্রকে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়ার মানে আগে বলা হয়েছে সামরিক প্রয়োজনে ন্যাটোর কী দরকার তাই হবে এদের প্রয়োজন, দেশের পৃথক নিজস্ব প্রতিরক্ষার কোনও প্রয়োজন থাকবে না৷

সুতরাং, ন্যাটোর ৭০ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে, এরা জনগণের ভয়ানক দুশমন৷ সাম্রাজ্যবাদের সামরিক হাতিয়ার হিসাবে এই খুনি সংগঠনটি বিশ্বব্যাপী পুঁজির শোষণের স্বার্থকেই রক্ষা করে৷ যখনই যেখানে পুঁজির শোষণ–লুণ্ঠনের বাধা আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়, সাম্রাজ্যবাদের ‘মানবাধিকার লঙঘনে’র ধুয়ার পথ ধরে ন্যাটোর পদার্পণ ঘটে সেখানে৷ ফলে, আজ বিশ্ব জনমতের দাবি হবে– ভেঙে ফেলো ন্যাটো৷ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির জনগণকেই প্রথম আওয়াজ তুলতে হবে৷ তার সাথে কণ্ঠ মেলাতে হবে বাকি সকল দেশগুলির জনগণকে৷ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শান্তি আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান– সাম্রাজ্যবাদের সামরিক হাতিয়ার ন্যাটো ভেঙে দাও৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা)