রামমোহন–বিদ্যাসাগরের চিন্তা বিজেপির সামনে বড় বাধা

বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহের ঘোষিত পরম ‘ভক্ত’ এক অভিনেত্রী পায়েল রোহতগি ভারতীয় নবজাগরণের উদগাতা রামমোহনকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং ‘ব্রিটিশের চামচা’ বলে অভিহিত করে তাঁর গোত্রীয় আরও কিছু ভক্তের প্রচুর পিঠচাপড়ানি কুড়িয়েছেন৷ সম্ভবত তাঁর আরাধ্য নেতাদের প্রশংসা এবং সমর্থনেরও অভাব ঘটেনি না হলে অন্তত একটি শুকনো তিরস্কারের ভানও নেতাদের তরফে দেখা যেত৷ এ শুধু দ্বিতীয়বার ক্ষমতা দখলের উল্লাসে এক ভক্তের মনের কথা বেরিয়ে পড়া নয়, এ আসলে আরএসএস–বিজেপির তথাকথিত দেশপ্রেমিক আদর্শেরই ‘মন কি বাত’৷ আশার কথা যে সারা দেশ জুড়েই এই জঘন্য মন্তব্যের প্রতিবাদ শোনা গেছে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের মধ্য থেকে৷

‘ভক্ত’ অভিনেত্রীর মতে, সতীদাহ প্রথা কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া হত না৷ মুঘল রাজাদের হাত থেকে নিজেদের সম্মান বাঁচাতে স্বামীর মৃত্যুরপর মহিলারা নিজেরাই এই প্রথা অবলম্বন করতেন৷ আরও বলেছেন, রামমোহন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন, ব্রিটিশরা সমাজকে ভাঙার কাজে রামমোহনকে ব্যবহার করেছিল৷ কেন হঠাৎ এমন আক্রমণ রামমোহনের বিরুদ্ধে বিজেপি শিবির শুরু করল? মনে রাখা দরকার, কিছুদিন আগে তাদের দলের সভাপতির রোড শোতে আগত লোকেরা কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে৷ আসলে এদেশের সত্য ইতিহাসকে বিকৃত করতে ও মুছে না ফেলতে পারলে আরএসএস–বিজেপি তাদের বিকৃত চিন্তাধারাকে দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবে না৷ ঐতিহ্যের নামে বস্তাপচা ধ্যানধারণা ও অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন চিন্তার প্রসার ঘটানো, কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা ও অন্ধ বিশ্বাসকেই সত্য হিসাবে তুলে ধরা, যুক্তিবাদীদের আক্রমণ এমনকী হত্যা করার মতো কাজ আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকেই চালিয়ে যাচ্ছে৷ বিজেপি এই চিন্তার অনুসারী হিসাবে গুজরাটের মতো কিছু রাজ্যে এই অপচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে ২০১৪–তে দ্বিতীয়বার কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতায় বসে সারা দেশজুড়ে প্রবল উৎসাহে এই কাজে নেমেছে৷ ২০১৯–এ সেই উৎসাহ আরও প্রবল হয়েছে৷ রামমোহন, বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ এই মনোভাবেরই ধারাবাহিকতাতে ঘটেছে৷ মনে রাখা ভাল, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথা বর্তমানে মেঘালয়ের রাজ্যপাল রবীন্দ্রনাথ সুকান্ত নজরুলকে একত্রে ‘রসুন’ বলে কটাক্ষ করতেও পিছপা হননি৷

ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত বলা হয় রাজা রামমোহন রায়কে৷ মোগল শাসন অবলুপ্ত হয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ধীরে ধীরে দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে, সেই সময় রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব৷ সেই সময় একদিকে জীবনধারায় মধ্যযুগীয় ব্যাভিচার, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও শোষণ সমগ্র সমাজকে অচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসকদের সাথেই আসা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পেয়ে একদল মানুষ ইউরোপীয় নবজাগরণের চিন্তার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন৷ এই যুগসন্ধিক্ষণে রামমোহন সর্বপ্রথম ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও সামন্তী চিন্তার বিরুদ্ধে এক সর্বব্যাপী লড়াই শুরু করেছিলেন৷ ইউরোপীয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি ইউরোপের মানবতাবাদী চিন্তার আলোকে সামাজিক সাংসৃক্তিক ক্ষেত্রে প্রবল আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘‘আমাদের ইতিহাসের আধুনিক পর্বের আরম্ভ কালেই এসেছেন রামমোহন রায়৷ তখন এ যুগকে কি স্বদেশি কি বিদেশি কেউ স্পষ্ট করে চিনতে পারেনি৷ তিনিই সেদিন বুঝেছিলেন, এ যুগের যে আহ্বান সে সুমহৎ ঐক্যের আহ্বান৷ তিনি জ্ঞানের আলোক প্রদীপ্ত আপন উদার হৃদয় বিস্তার করে দেখিয়েছিলেন সেখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কারো স্থান সংকীর্ণতা নেই৷ তাঁর সেই হূদয় ভারতের হৃদয়৷ তিনি ভারতের সত্য পরিচয় আপনার মধ্যে প্রকাশ করেছেন৷ ভারতের সত্য পরিচয় সেই মানুষে যে মানুষের মধ্যে সকল মানুষের সম্মান আছে, স্বীকৃতি আছে৷’’ রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়নই দেখিয়ে দেয়, কেন বিজেপি–আরএসএসের চিন্তায় রামমোহন পরিত্যাজ্য৷ ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ, বিদ্বেষের প্রসারই যাদের রাজনীতির ভিত্তি, তারা কী করে সকল মানুষকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেবে? আরএসএস তো হিন্দু ছাড়া আর সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকার বিধান দিয়েছে বহু আগেই৷

তাই ‘ভক্ত’ অভিনেত্রীর এই মন্তব্য আসলে বিজেপি–আরএসএসের সত্য ধ্বংস করার চিন্তা প্রক্রিয়ারই ফসল এতে কোনও সন্দেহ নেই৷ বিজেপির অসংখ্য নেতা নেত্রী আগেও এধরনের মন্তব্য করেছেন৷ যথার্থ সত্যকে মেরে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসকে জাগিয়ে দিতে চায় তারা৷ বিজেপি–আরএসএস জানে, মানুষ বৈজ্ঞানিক চিন্তার অধিকারী হলে শোষণ জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলবেই৷ জাতপাত–ধর্ম–বর্ণে মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে বিভেদের রাজনীতি ছড়াচ্ছে বিজেপি৷

এদেশের বুকে রামমোহন বিদ্যাসাগরের চিন্তাকে ভিত্তি করে যে যুক্তিবাদী চিন্তার ধারা গড়ে উঠেছিল তাকে দাবিয়ে দিতে চেয়েছে সকল শাসক৷ এখন বিজেপি–আরএসএস সবচেয়ে বেশি করে সেই চেষ্টায় নেমেছে৷ এদেশে নবজাগরণের চিন্তার শিকড়ের সাথে আরএসএসের কোনও সংযোগ কোনও দিন ছিল না৷ তাই ভারতীয়ত্ব বলতে তারা প্রাচীন ধর্মীয় কুসংস্কারগুলিকে তুলে ধরেছে৷ কিন্তু প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিকতা এবং ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা কীভাবে তাকে শেষ করে দিয়েছে এই চর্চাই তো ভারত সভ্যতাকে জানার সত্যিকারের পথ৷ যে চর্চা করেছেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ৷ বিজেপি এই চর্চা করবে কী করে?  নবজাগরণের পথ বেয়ে নতুন করে যে জ্ঞানের আলো রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের মতো মনীষীরা এ দেশের বুকে জ্বালাতে চেয়েছেন, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই আরএসএস ছিল তার তীব্র বিরোধী৷ বিজেপি তারই অনুসরণ করে৷

রামমোহন ধর্মীয় সংস্কারের পথে চলেই নবজাগরণের হাত ধরে আসা চিন্তাকে এদেশের মাটিতে প্রোথিত করার কাজ শুরু করেছিলেন৷ হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, বহু কুপ্রথা, নারী জাতির উপর নির্যাতন, সমাজপতিদের অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন৷ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, যতদিন না সমাজ ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামন্ততান্ত্রিক অন্ধতা থেকে মুক্ত না হয় ততদিন সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়৷

রামমোহন চেয়েছিলেন আধুনিক শিক্ষার প্রচলন৷ তাই তিনি বলছেন– ‘‘সংস্কৃত শিক্ষাপদ্ধতি দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণোদিত৷ এই দেশে ইতিমধ্যেই দু’হাজার বছর ধরে এই শিক্ষা চলে আসছে৷ ব্রিটিশ সরকার হিন্দু পণ্ডিতদের দিয়ে তাই পুনরায় চালু করছে৷ যার ফলে মিথ্যা অহঙ্কার জন্মাবে৷ অন্তঃসারশূন্য চিন্তা, যেটা স্পেকুলেটিভ মানুষেরা করেছেন, সেটাই বাড়বে৷ বেদান্ত শিক্ষার দ্বারা যুবকরা উন্নত নাগরিক হতে পারবে না৷ বেদান্ত শেখায়, এই পরিদৃশ্যমান জগতের কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই৷ উন্নততর ও উদার শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অঙ্কশাস্ত্র, প্রাকৃতিক দর্শন, কেমিস্ট্রি, অ্যানাটমি ও কার্যকরী বিজ্ঞান শিক্ষা’’( লেটার টু লর্ড আমহার্স্ট–রামমোহন রায় রচনাবলি)৷ পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর এই চিন্তাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন৷ আরএসএস–বিজেপি ঠিক এর বিপরীত কাজটি করছে এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে৷ একদিকে বলছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ হবে, অন্যদিকে পৌরাণিক গল্প, আখ্যান এগুলিকেই বিজ্ঞান বলে চালাতে চাইছে৷ প্রচার করছে বৈদিক যুগেরও বহু আগে থেকে মুনি–ঋষিদের মহাকাশযান ছিল৷ স্টেমসেল থেরাপি নাকি মহাভারতের আমলেই আবিষৃক্ত৷ আরএসএসের চিন্তাধারা অনুযায়ী বিজেপি সরকার বিজ্ঞান–ইতিহাসের সিলেবাসে বেদান্ত, যাগ–যজ্ঞকে সত্য বলে তুলে ধরার চেষ্টা করছে৷ এর পরেও কি বুঝতে অসুবিধা হয়– কেন রামমোহন–বিদ্যাসাগ শিক্ষা, তাঁদের ঐতিহ্য বিজেপির সামনে এক দুর্লঙঘ্য বাধা বিজেপি ‘ভক্ত’রা রামমোহনকে সহ্য করতে পারবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক৷ তদানীন্তন সমাজে বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল৷ বিধবা নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ না করা এবং তাকে পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করার প্রবণতা থেকেই এই প্রথার জন্ম হয়৷ দেখা গেছে, মৃত স্বামীর পরিবারের পরবর্তী উত্তরাধিকারীরাই জোর করে সদ্য বিধবা নারীকে চিতার আগুনে ঠেলে দিত৷ কয়েক শত বছর ধরে বন্দি জীবন যাপন করা, শিক্ষা, সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত নারীর ক্ষমতা ছিল না এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর৷ রামায়ণ–মহাভারত থেকে শুরু করে নানা শাস্ত্রের দোহাই পেড়ে কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কারে পূর্ণ সমাজে ধর্মের নামে এই অনাচারকে ভয়ে মেনে নিত বহু মানুষ৷ নারীকে বোঝানো হত স্বামীই দেবতা, মেয়ে মানে তার একমাত্র কর্তব্য পুরুষের সেবা৷ তাই স্বামীকে সেবা করতেই তার স্বামীর সাথে স্ত্রীকেও স্বর্গে কিংবা নরকে যেতে হবে৷ এতেই মঙ্গল নারীর৷ এই পরিবেশের জন্যই বহু নারীও হয়ত একে সমর্থন করত, ভাবত পরজন্মে সুখ পাবে৷ এদিকে সহমরণের চিতায় তোলা অসহায় মেয়েটির আর্তনাদ যাতে কারও কানে না যায় তার জন্য ঢাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা পিটিয়ে উদ্দাম নৃত্য জুড়ে দিত ধর্মধ্বজ সমাজপতিরা৷ ফলে মুঘল রাজাদের হাত থেকে বাঁচতে নারীরা স্বামীর সাথে সহমরণে যেত এ কথা অনৈতিহাসিক৷

ইংরাজ মিশনারীরা অনেকে এই প্রথার বিরুদ্ধতা করলেও শাসক ইংরাজরা কোনও দিন সমাজকে ঘাঁটিয়ে এর বিরুদ্ধে কিছু করতে চায়নি৷ যদিও ১৮০৫ সালে লর্ড ওয়েলেসলি সতীদাহ প্রথার উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা নিষিদ্ধ হয়নি৷ রামমোহন যখন ইউরোপীয় নবজাগরণের ধ্যানধারণার আলোকে ধর্ম, শাস্ত্রকে নতুন করে দেখার দৃষ্টি নিয়ে উপস্থিত হলেন, শুধু সতীদাহ নয়, নারীর মর্যাদা হানিকর ধর্মীয় বিধানগুলির বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়ালেন৷ সতীদাহের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৮ বছর আন্দোলন করেন, আইনি লড়াইয়ের পথও নেন৷ দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তিনি একাজে সফল হন৷ ব্রিটিশ সরকার ‘সতীদাহ’ নিষিদ্ধ করার আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়৷ পাশাপাশি নারী স্বাধীনতা, নারীর সমতা, নারীর মর্যাদাবোধ, পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সচেষ্ট হন৷ সমাজে জাতিভেদ প্রথারও বিরুদ্ধতা করেন তিনি৷

বিজেপি ‘ভক্ত’রা এই রামমোহনকে ভয় তো পাবেই৷ তারা ভারতের প্রকৃত ঐতিহ্যকে জানে না, এদেশের মনীষীদের সম্মান করে না৷ আরএসএস বিজেপি বারেবারেই প্রমাণ করছে প্রকৃত দেশপ্রেমের রাস্তা থেকে তারা আসলে অনেক দূরে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)