মুখ্যমন্ত্রীর নিষ্ঠুর তামাশা

‘চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হবে’– এই কথা বলে পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সহ রাজ্যের নানা জেলা থেকে আইটিআই, কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত প্রায় দশ হাজার বেকার যুবক-যুবতীকে দিয়ে খড়গপুরের ‘উৎকর্ষ বাংলা’র সভাস্থল ভরানো হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের জন্য। বড় আশায় বুক বেঁধে এসেছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের অপর্ণা, বাঁকুড়ার সুহৃদ, পুরুলিয়ার সোমা, ঝাড়গ্রামের বিকাশরা। কিন্তু অন্তঃসারশূন্য কথার চাষ ছাড়া আর কিছুই জুটল না।

তাই ‘উৎকর্ষ বাংলা’য় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেওয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের অপর্ণা, ঝাড়গ্রামের শ্রেয়া ভট্টাচার্যরা বলেন, ‘আমাদের তো বলা হয়েছিল এই কর্মসূচি থেকেই নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। কিছুই দেওয়া হল না।’ বদলে মুখ্যমন্ত্রী তাদের পুজোয় কেটলি আর ভাঁড় জোগাড় করে চা, ঘুগনি, তেলেভাজা বিক্রির পাশাপাশি কচুরিপানার ব্যাগ থালা, কাশফুলের বালিশ তৈরির পরামর্শ দেন।

অপরদিকে গত ১২ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের মঞ্চ থেকে কয়েক হাজার প্রশিক্ষিতের হাতে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, ঘরের দরজায় এসে ডাকবে চাকরি।’ এই বিলি হওয়া নিয়োগপত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে এক তীব্র বিতর্ক। বাইরে যাওয়ার দরকার নেই বলে হুগলি এইচ আইটিতে ডেকে যে চিঠিটি ধরানো হয়েছে যুবক-যুবতীদের হাতে, অনুষ্ঠান শেষে তারা দেখল তাতে ফানফার্স গ্লোবাল স্কিলার্সের সহযোগিতায় গুজরাটের সুরেন্দ্রনগর সংস্থায় দু’বছরের জন্য ‘ভেহিকল টেকনিশিয়ান’ হিসাবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কাছে গুজরাটের ওই সংস্থার সেন্টার ম্যানেজার বেদপ্রকাশ সিংহ দাবি করেছেন ওই কাগজ ভুয়ো। সংস্থাটি গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে এই ধরনের প্রশিক্ষণের কাজে যুক্ত থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের কোনও সংস্থা বা এই রাজ্যের সরকারের সঙ্গে তাদের কোনও যোগ নেই। খোদ সরকারের তরফ থেকে রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের প্রতি এই চরম প্রতারণাকে, জালিয়াতিকে কোন ভাষায় আখ্যায়িত করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না পশ্চিমবাংলার জনগণ।

এরকমই এক প্রতারণার শিকার হয়েছিল বাংলার যুবক-যুবতীরা ২০১৩ সালে যুবশ্রী প্রকল্প চালু করার সময়। ওই দিন নেতাজি ইন্ডোরের সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নথিভুক্ত বেকারদের মধ্যে থেকে প্রতি বছর এক লক্ষ যুবক-যুবতীকে যুবশ্রী প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। সরকারের নানা দপ্তরের কাজে, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স সহ বিভিন্ন পদে এই ১ লক্ষ যুবশ্রীকে নিয়োগ করা হবে। এইভাবে প্রতি বছর এক লক্ষ করে যুবশ্রীকে চাকরি দেওয়া হবে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এই আশ্বাস পেয়ে আনন্দের সঙ্গে ঘরে ফেরা যুবশ্রীরা আজ হতাশ। তারা আন্দোলন গড়ে তুলছে মুখ্যমন্ত্রীর ২০১৩ সালের প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবিতে।

শুধু তো এবারই নয়, এর আগেও মুখ্যমন্ত্রী এরকম কথা বলেছেন। বলেছেন, সরকারি চাকরির প্রত্যাশা না করে, খাতা-পেনের দোকান খোলো, মাটি কাটো, তেলেভাজা বিক্রি করে খুঁটে খাও। একইরকম ভাবে পকোড়া ভেজে বেকারত্ব ঘোচাবার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্রী হোক বা প্রধানমন্ত্রী বা অন্য নেতা-মন্ত্রীরা নির্বাচনকে সামনে রেখে বছরে লক্ষ, কোটি যুবককের বেকারত্ব ঘোচাবার প্রতিশ্রুতি দেন আর ভোট পেরোলেই বলেন ওসব জুমলা, কথার কথা, ভোটের জন্য বলতে হয়। এইসব বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ‘মিম’ হয়, হাসির রোল ওঠে। কিন্তু এগুলো সত্যিই কি এত হালকা বিষয়? হাসির খোরাক? বেকার যুবক-যুবতী এবং তাদের পরিবারের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি না করে যারা ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসার জন্য অনায়াসে চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন আর তারপর বলেন যে ভোট পাওয়ার জন্য তা বলতে হয়, কিংবা চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়ার নাম করে ডেকে জ্ঞান বিতরণ করে বলেন, যাও চা, ঘুগনি তেলেভাজা বেচে খেটে খাও, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না বুর্জোয়া ব্যবস্থার এই শাসকদের ভাণ্ডারে জনগণকে দেওয়ার আর কিছু নেই।

খড়গপুরে উৎকর্ষ বাংলার সভায় মুখ্যমন্ত্রী হাজার হাজার বেকার যুবকদের খেটে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, একটু খাটলেই নাকি বিপুল রোজগারের কোনও অভাব নেই। মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে আমরা জনবিচ্ছিন্ন শাসকের কথা শুনতে পাচ্ছি। উনি কি জানেন না, উদয়াস্ত না খাটলে বাংলার শ্রমজীবী মানুষের নুন ভাতটুকুও জোটে না? এত তাড়াতাড়ি সোনারপুরের অতনু মিস্ত্রীকে কি ভুলে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী? উচ্চশিক্ষিত অতনু হোটেলে ঘর মোছার কাজ করত। শুধুমাত্র অতনু নয়, শিক্ষিত বেকাররা বাসে, ট্রেনে হকারি করে গান গেয়ে যেমন করে হোক উদয়াস্ত শরীরের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে কিছু উপার্জন করে কোনও রকমে প্রাণধারণ করে আছেন। প্রাণধারণ করা আর বেঁচে থাকা তো এক নয়! বেঁচে থাকা আরও কিছু বেশি দাবি করে। কিছু অধিকার দাবি করে। যেমন বেঁচে থাকার জন্য কাজের অধিকার কংগ্রেস-বিজেপি কোনও সরকার দিয়েছে কি? এই বাংলায় কাজ না পেয়ে খেটে খাওয়ার জন্যই তারা এই রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে এমনকি ভিন দেশে পাড়ি দিচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে এই খেটে খাওয়া মানুষরাই তো মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। আসলে বেকারত্বের ভয়াবহ এই সমস্যায় কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের মতো রাজ্যের তৃণমূল সরকারও জর্জরিত। ধনীর স্বার্থরক্ষাকারী প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি সেই সমস্যাকে প্রতিদিন আরও গভীরতর করে তুলছে। বাঁচার কোনও পথ কেউ দেখাতে পারছে না। তাই যেখানে পারছেন যা খুশি তাই বলে সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার মিথ্যা চেষ্টা করছেন নেতা-মন্ত্রীরা। গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি জনসভায় ডবল চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নেতাজি ইন্ডোরের সভায়, খড়গপুরের বত্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে রাজ্য সরকার লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। দেশে যখন প্রবল বেকারত্ব তখন নাকি তাঁর শাসনে রাজ্যে বেকারত্ব ৪০ শতাংশ কমে গেছে এবং আগামী ৪-৫ বছরে রাজ্যকে কর্মসংস্থানে তিনি এক নম্বরে নিয়ে যাবেন। রাজ্যে যদি বেকারত্ব কমেই থাকে, আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গ কর্মসংস্থানে এক নম্বর হয় তা হলে আইটিআই ও কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত যুবকদের চাকরির সুলুক সন্ধান না দিয়ে চা, ঘুগনি তেলেভাজা বিক্রির পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রী কেন দিলেন?

একদিকে রাজ্যে চাকরির নিয়োগের ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে চলে আসা, কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, দুর্নীতিতে জড়িত দলের নেতা-মন্ত্রী ও বশংবদ আমলাদের গ্রেপ্তারি, অন্যদিকে মেধা তালিকাভুক্তদের লাগাতার আন্দোলনে সরকার নাজেহাল। দীর্ঘবছর ধরে সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ বন্ধ। পিএসসি, এসএসসি-সহ সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগের দাবিতে প্রতিদিন রাস্তার আন্দোলনে বেকার যুবক-যুবতীরা। এই পরিস্থিতিতে দ্রুততার সাথে কলকাতা ও খড়গপুরে দুটি সভায় রাজ্যের হাজার হাজার বেকারকে ডেকে চাকরির নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে চালাকির আশ্রয় নিয়ে বাজিমাত করতে চেয়েছিল তৃণমূল সরকার। কিন্তু সে কৌশল সফল হয়নি। আসলে চালাকির দ্বারা যে কোনও দিন কোনও ভাল কাজ হয় না– এই আপ্তবাক্যটি মুখ্যমন্ত্রী ভুলে গেছেন। এই অপ্রয়োজনীয় কাজটি না করে সরকারের উচিৎ উৎসবের আগে সমস্ত পরীক্ষার মেধা তালিকাভুক্তদের নিয়োগপত্র দেওয়া এবং সমস্ত শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগের নোটিফিকেশন জারি করা। কোর্টও বলে দিয়েছে নিয়োগে কোনও বাধা নেই। তা হলে গড়িমসি কেন?

বর্তমানে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি যুবকের বাস এই ভারতবর্ষে। অথচ সেই যুবকদের নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা–কি কেন্দ্র, কি রাজ্য–কোনও সরকারেরই নেই। কাজ নেই তা তো নয়। দিল্লির কেন্দ্রীয় দপ্তরগুলিতে প্রধানমন্ত্রীর চোখের সামনে নয় লক্ষ এগারো হাজার শূন্যপদ। শুধুমাত্র দিল্লির কেন্দ্রীয় দপ্তরে যদি এত শূন্যপদ হয় তা হলে সমগ্র দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা দপ্তরে শূন্যপদ কত তা সহজেই অনুমেয়। একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গেরও। রাজ্যে শুধুমাত্র শিক্ষক পদ ফাঁকা তিন লক্ষাধিক। রাজ্যের বাকি দপ্তরগুলির শূন্য পদের সংখ্যা যদি ধরা হয় তা হলে কয়েক লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান যে সম্ভব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ তা না করে হয় পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে, না হয় কাটমানি নিয়ে অথবা ঠিকার ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছে। এমনকি সেনাবাহিনীতেও স্থায়ী নিয়োগে কোপ পড়েছে।

কেন এমন হচ্ছে? এমনিতেই পৃথিবীর প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের মতো ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থারও বেহাল দশা। উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ মজুত থাকলেও শিল্পপতিরা নতুন কলকারখানা খোলা দূরে থাক, একের পর এক সেগুলি বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। ফলে দেশ জুড়ে বিপুল ভাবে বাড়ছে বেকারত্ব। এই অবস্থায় সরকারি দফতর ও স্কুল-কলেজগুলির শূন্যপদ নিয়মিত ভাবে পূরণ করলে এই বিরাট সংখ্যক কর্মহীন মানুষের একটি অংশের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা-ভাণ্ডার ভরিয়ে তোলার কাজে নিবেদিতপ্রাণ সরকারগুলি খনি, বন্দর, বিমানবন্দর সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিচ্ছে তাদের হাতে। কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছে সাধারণ মানুষের প্রতি দায়দায়িত্ব। তাই সরকারি দফতরে নিয়োগে তাদের উদ্যোগ নেই। নিয়োগ করলেও তা চলছে ঠিকা ব্যবস্থায়, যাতে কর্মীর পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের দায়িত্ব সরকারকে না নিতে হয়। পাশাপাশি পুঁজিপতিদের শিক্ষা-ব্যবসায় মুনাফা-লুটের সুযোগ করে দিতে সরকারি বা সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজগুলিকে দুর্বল করে দেবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে সরকারগুলি। তাই নিয়োগ নেই স্কুল-কলেজেও।

এই অবস্থায় কর্মসংস্থানের যেটুকু সুযোগ এখনও আছে, তা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে সরকারকে বাধ্য করা প্রয়োজন। ফলে অবিলম্বে শূন্যপদে নিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থার দাবিতে সংগঠিত লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কর্মপ্রার্থীদের বাঁচার পথ নেই।