Breaking News

‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করুন — বাসদ (মার্কসবাদী)

‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করুন

ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন গড়ে তুলুন

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র আহ্বান

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দর চৌধুরি ৪ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বলেন,

গোটা প্রশাসন যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে গায়ের জোরে কার্যত একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় এল আওয়ামি লিগ৷ ১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচনই জনগণের গ্রহণযোগ্য হয়নি৷ কিন্তু এই নির্বাচন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ‘ভোট ডাকাতি’র অনবদ্য কৌশলের জন্য৷ রাষ্ট্রের সকল সংস্থাকে প্রত্যক্ষভাবে রিগিংয়ের কাজে আর কোনও নির্বাচনে এভাবে নামানো হয়নি৷

নির্বাচনের আগের দিন রাতে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই একটা বিরাট সংখ্যক ব্যালটে নৌকা মার্কায় ছাপ মারা হয়েছে৷ নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা, মধ্যাহ্ণভোজের বিরতির কথা বলে কিংবা নকল লাইন তৈরি করে বুথগুলিতে ভোট বন্ধ রেখে ছাপ মারা–এ রকম অভিযোগ অসংখ্য৷ নৌকায় ভোট না দেওয়ার অপরাধে নোয়াখালিতে চার সন্তানের জননীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে৷ সংঘাতে এ পর্যন্ত ২০ জন মানুষ মারা গেছেন৷ ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামি লিগ পেয়েছে ২৫৬টি আসন, মহাজোট সব মিলিয়ে পেয়েছে ২৮৮টি আসন, বিএনপি–র ৫টি সহ ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছে ৭টি আসনে৷ বিজয়ী হয়েছে না বলে বিজয়ী করা হয়েছে বলাই অধিক সঙ্গত, কারণ এই নির্বাচনের জয়–পরাজয়ে জনগণের ভোটের কোনও ভূমিকা ছিল না৷ নির্বাচনী নাটককে একটু কম হাস্যকর করার জন্য এই ৭টি আসন কোরবানি দিয়েছে আওয়ামি লিগ৷ দেশ ও বিদেশের দু’একটি সংবাদমাধ্যম ছাড়া গোটা মিডিয়ায় এই ব্যাপক ‘ডাকাতি’ চেপে যাওয়া হয়েছে৷ মানুষ জেনেছেন গুটিকয়েক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় আর নিজেদের ও কাছের মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে৷ গোটা দেশ মানতে না পারার ও অপমানের একটা তীব্র জ্বালার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে৷ একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশ জুড়ে৷

পুলিশ, সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড, সচিবালয় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন সহ রাষ্ট্রের সমস্ত সংস্থা আওয়ামি লিগের পক্ষে কাজ করেছে৷ কাজ করেছে মিডিয়া৷ যারা একটু নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে চেয়েছে তাদের উপর আক্রমণ এসেছে৷ ঢাকার নবাবগঞ্জে যমুনা টিভি, দৈনিক যুগান্তর সহ বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ হয়েছে নির্বাচনের আগেই৷  আওয়ামি লিগ যাকে কিনতে পেরেছে তাকে কিনেছে, যে বিক্রি হয়নি তাকে ভয় দেখিয়েছে৷ যে তারপরও সমর্থন দেয়নি তাকে আক্রমণ করেছে৷ বিখ্যাত খেলোয়াড়, সিনেমার স্টার, অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, সাহিত্যিক– কে দাঁড়ায়নি আওয়ামি লিগের পিছনে যেন নষ্ট হওয়ার উৎসব লেগে গেছে দেশে৷ এই নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা, যা তারা অর্জন করেছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও তহবিলের সীমাহীন লুটপাটের মধ্য দিয়ে৷

ভারত সরকার কালবিলম্ব না করে আওয়ামি লিগকে অভিনন্দন জানিয়েছে৷ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে শেখ হাসিনার জয়বাদ্য বেজেই চলেছে৷ ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতার ফলেই আওয়ামি লিগের এই বিজয় সম্ভব হয়েছে৷ ভারতের নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনকে গোল্ড সার্টিফিকেট দিয়েছেন৷ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সার্ক, ওআইসি, নেপালের পর্যবেক্ষক দল৷ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যাদের নিজেদের পক্ষে কথা বলানো যাবে বলে নিশ্চিত করা গেছে তাদেরই আসার অনুমতি দিয়েছে সরকার৷ বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ছাড়পত্র ও ভিসা দেওয়া হয়নি৷ আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘এনফ্রেল’ এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক  প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে৷ কিন্তু সরকার কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেনি৷

আওয়ামি লিগ কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে, কার্যত মুক্তিযুদ্ধকে সে ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে৷ এ দেশের উন্মেষকালে লক্ষ কোটি মানুষের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার সেই চেতনার ধারেকাছেও এখন সে নেই৷ ‘এক দেশ এক অর্থনীতি’ বলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়ামি লিগ দাঁড়িয়েছিল, সেই ‘এক দেশ এক অর্থনীতি’ এখনও বিদ্যমান৷ গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে৷ ষাট–এর দশকে ভোটের অধিকারের জন্য আওয়ামি লিগ লড়েছে,  অথচ আজ সে নিজেই জনগণের ভোটাধিকারকে নির্মমভাবে পদদলিত করছে৷ আজ জনগণকে সেই একই দাবি আবার তুলতে হচ্ছে, যে দাবিতে স্বাধীনতার পূর্বে লড়েছিল, জীবন দিয়েছিল৷ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামি লিগ–বিএনপি–জাতীয় পার্টি–জামাত সহ  ধনিক শ্রেণির সরকারগুলি ক্ষমতায় থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হয়নি সত্য, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে  গদি দখলের কাজে বিক্রি ও ব্যবহার এ ভাবে আর কোনও দল করতে পারেনি৷

ভোটের গণতন্ত্রের উপর যারা বিশ্বাস আজও রাখেন, যারা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুক্তি লাভ সম্ভব বলে মনে করেন– তাঁদের নিশ্চয় জানা আছে যে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের দেশে দেশে আজ একই কাণ্ড ঘটছে৷ এক সময় বুর্জোয়া রাষ্ট্রে বিভিন্ন মতের দ্বন্দ্বকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মত, আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণের কাছে যেত৷ জনগণ তাদের পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করত৷ সেই গণতন্ত্র আজ আর দুনিয়ায় নেই৷ আজ বুর্জোয়া দলগুলির কোনওটিই জনগণের ম্যান্ডেটের উপর নির্ভর করে না৷ তারা নির্ভর করে প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের উপর৷ ফলে আজ গোটা বিশ্বে মানুষের মত ধুলায় লুটাচ্ছে, গণতন্ত্র আজ নাম বদলে হয়েছে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’৷ যারা মনে করেন বিএনপি, জামাত কিংবা ঐক্যফ্রন্ট এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারবে তাদের সে চিন্তাও ভুল৷ এরা ক্ষমতায় এলেও একই কাজ করবে৷ এরা একই শ্রেণির দল, এই ব্যবস্থায় এ ছাড়া তাদের টিকে থাকার  কোনও উপায় নেই৷ একটু অতীতের দিকে তাকালেই দেখবেন, ২০০৮ সালে আওয়ামি লিগকে বিরাট ব্যবধানে জনগণ জিতিয়ে নিয়ে এসেছিল মুক্তির আকাঙক্ষা থেকেই, অথচ আজ সে তার হাত থেকেই মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করছে৷ ফলে আওয়ামি লিগ না হয় বিএনপি– এই করে করে জনগণ বারবার ঠকছেন৷ এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটিয়ে সরকার পরিবর্তনের সকল চেষ্টাই শেষপর্যন্ত ব্যর্থ চেষ্টা হবে৷

নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে সেনাপ্রধান, নৌ বাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান, কোস্টগার্ড প্রধান, নির্বাচন কমিশনের সচিব সহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান ও সংস্থার মুখপাত্ররা অভিনন্দিত করেছেন৷ এই সংস্থাগুলি সরকার নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় সংস্থা৷ রাষ্ট্র এবং সরকার এক নয়৷ সরকার মানে একটি দলীয় সরকার৷ একটি দলীয় সরকারকে রাষ্ট্রের কোনও সংস্থার প্রধানরা অভিনন্দন জানাতে পারেন না৷ অথচ তাঁরা তা করলেন৷ এ থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রের শক্তিকেন্দ্রগুলির মধ্যে যে ভারসাম্য সেটা ভেঙে গিয়ে কীভাবে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে৷ একটা পরিণত প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হয়েছে যা সমস্ত বিরোধী চিন্তাকে নির্মমভাবে দমনে প্রস্তুত৷

এই অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র ও প্রগতিমনস্ক্, শিক্ষিত, সমস্ত নাগরিকবৃন্দ, কৃষক–শ্রমিক–পেশাজীবী ছাত্র ও যুবসমাজ–সবার সামনেই এক কঠিন দায়িত্ব এসে পড়েছে৷ লাখো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশকে আমরা এ ভাবে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারি না৷ বামগণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে নিয়ে আমরা এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়ব৷ যত ব্যর্থতার ইতিহাসই থাকুক না কেন, এই অন্ধকারে তাদেরই দাঁড়াতে হবে৷ আমরা সবাইকে এই লড়াইয়ে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২২ সংখ্যা)