Breaking News

বিভেদ ছড়িয়ে বিশ্বাস অর্জনের ভড়ং

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসে বিজেপি স্লোগান তুলেছে– ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস৷’ গতবারের পুরনো স্লোগানের সাথে এবার ‘সব কা বিশ্বাস’ যোগ করতে হল কেন? সব কা সাথ, সব কা বিকাশ– এই স্লোগানেরই বা কী পরিণতি হয়েছে?

নোট বাতিল করে, জিএসটি চাপিয়ে, সাধারণ মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক–কর্মচারীদের অশেষ দুর্গতির মধ্যে ফেলেছে বিজেপি৷ চাষিরা ফসলের দাম পায়নি, তাদের ঋণ মকুব হয়নি, বেকাররা কাজ পায়নি, তাহলে কার সাথে ছিল তাদের সরকার, কার বিকাশ ঘটেছে তাদের রাজত্বে? বিকাশ হয়েছে, সরকার সাথে থেকেছে শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের– বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের, আদানি–আম্বানিদের৷ কৃষকদের ঋণ মকুব না হলেও পুঁজিপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্কঋণ মকুব করে দিয়েছে বিজেপি সরকার৷ স্বাভাবিকভাবেই তাদের মুনাফা আকাশ ছুঁয়েছে৷

আর গত পাঁচ বছরে বিজেপি শাসনের ইতিহাস তো অসহিষ্ণুতারই ইতিহাস৷ এসবই বিজেপি নেতাদের জানা বিষয়৷ জনগণের বিশ্বাস যে বিজেপি অর্জন করতে পারেনি তাও বিজেপি নেতারা ভালোই জানতেন৷ তাই ভোটে জনগণের সমর্থনের উপর নির্ভর না করে তাদের পুলওয়ামায় জঙ্গি হানাকে আশ্রয় করতে হল, বালাকোটে জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমান হানার খবর ছড়াতে হল৷ সঙ্গে ছড়ালেন অঢেল টাকা, দখল নিলেন মিডিয়ার৷ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে এই গরিষ্ঠতা নয়, তা বিজেপি নেতারাও জানেন৷

গত পাঁচ বছরের শাসনে যে বিজেপি নেতারা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি বরং বিভেদই ছড়িয়েছেন– দ্বিতীয় বার জিতে ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা আবার সব কা বিশ্বাসের আওয়াজ তুলছেন কেন?

গত পাঁচ বছরে বিজেপি শাসনে অসংখ্য সংখ্যালঘু, দলিত, নিম্নবর্ণ, পিছড়ে বর্গের মানুষকে খুন করা হয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে অজস্র মানুষ৷ প্রধানমন্ত্রী কিংবা কোনও বিজেপি নেতা তার কোনও প্রতিবাদ করেননি৷ যদি তাঁরা সত্যিই সবার বিশ্বাস অর্জন করতে চাইতেন তবে মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত, গান্ধিজির ঘাতক গডসেকে ‘দেশভক্ত’ বলা সাধ্বী প্রজ্ঞাকে নির্বাচনে প্রার্থী করতেন না, ওড়িশায় গ্রাহাম স্টেইন এবং তাঁর শিশুপুত্রকে হত্যায় অভিযুক্তকে মন্ত্রী করতেন না, অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি–আরএসএসের দুষ্কৃতীরা বিদ্যাসাগরের মতো মহান মনীষীর মূর্তি ভাঙচুর করল, রামমোহনের মতো নবজাগরণের পুরোধাকে ব্রিটিশ সরকারের ‘দালাল’ বলল তাঁদের এক পরমভক্ত, এ সবের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এমন করে চুপ থাকতেন না৷ এর পরেও ‘সব কা বিশ্বাস’–এর স্লোগান মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে কি?

একদিকে যখন ‘সব কা বিশ্বাস’ স্লোগান তুলছেন বিজেপি নেতারা, মানুষ দেখছে দেশের নানা স্থানে সংখ্যালঘু মানুষদের উপর একের পর এক আক্রমণ নামিয়ে আনছে বিজেপি–আরএসএস মদতপুষ্ট দুষৃক্তীরা৷ হরিয়ানার গুরুগ্রামে এক সংখ্যালঘু যুবকের উপর এই দুষ্কৃতীরা নির্যাতন চালায় ফেজ টুপি পরার অপরাধে বিহারের বেগুসরাই জেলায় মহম্মদ কাশিমকে শুধু পাকিস্তানে যাওয়ার নির্দেশই দেয়নি, সঙ্গে সঙ্গে গুলি ‘উপহার’ও দেওয়া হয়েছে৷ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি৷ ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে অধ্যাপক জিতরায় হাঁসদাকে গ্রেপ্তার করা হয় দু’বছর আগে পোস্ট করা গোমাংস বিষয়ে এক লেখার জন্য দিল্লিতে প্রাতঃভ্রমণকারী জনৈক ডাক্তার অরুণ গাদরেকে ঘিরে ধরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলার আদেশ দেয় দুষ্কৃতীরা৷ তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ায় তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তিনি আদৌ হিন্দু কি না তারপর উচ্চেঃস্বরে সেই স্লোগান দিয়ে তিনি কোনওক্রমে পরিত্রাণ পান৷ মধ্যপ্রদেশের সিবনী জেলায় গোমাংস বহন করার অভিযোগে তিন জন সংখ্যালঘু মানুষের উপর আক্রমণ করে স্ব–ঘোষিত ধর্মগুণ্ডারা৷ উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের এক সংখ্যালঘু ছাত্রীকে হস্টেলে ফেরার সময় ঘিরে ধরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে একদল ধর্মোন্মাদ দুষ্কৃতী৷ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে অন্যান্য ছাত্রীরাও৷ এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে দেশজুড়ে৷ এগুলির প্রতিকার দূরের কথা, মৌখিক দুঃখপ্রকাশ করতেও দেখা যাচ্ছে না কোনও বিজেপি নেতাকে৷ তাদের মদতপুষ্ট হয়েই দুষ্কৃতীরা নিরীহ মানুষের হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে বুক ফুলিয়ে৷ এই কি বিশ্বাস অর্জনের নমুনা? এভাবে কি বিশ্বাস অর্জন করা যায়? এর মধ্য দিয়ে এমনকী সংখ্যাগুরুদের মধ্যেও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করতে তারা সফল হয়েছেন৷

আর এস এসের দর্শনকে ভিত্তি করে বাস্তবে যে রাজনীতি করছে বিজেপি, তাতে অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাস অর্জন কোনওভাবেই সম্ভব নয়৷ বিজেপি ও তার আদি সংগঠন আরএসএসের রাজনৈতিক আদর্শই উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ৷ তাদের গুরু গোলওয়ালকর মুসলিমদের উদ্দেশে স্পষ্ট সতর্কবাণী দিয়েছিলেন, ‘হিন্দুস্তানের অ–হিন্দু জনগণকে হিন্দু সংসৃক্তি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি এবং সংস্কৃতির প্রচার ব্যতীত অন্য কোনও ধারণা বর্জন করতে হবে …, এক কথায়, তাদের হয় বিদেশি হয়ে থাকা বন্ধ করতে হবে অথবা তারা এ দেশে থাকতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে, কোনও কিছু দাবি না করে, কোনও বিশেষ সুবিধার দাবিদার না হয়ে তো বটেই– এমনকী নাগরিক অধিকারের দাবিদার না হয়ে’ (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড, পৃঃ ৫৫–৫৬)৷ বিজেপির আর এক গুরু হিন্দু মহাসভার নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মনোভাবও ছিল মুসলিম বিদ্বেষী চিন্তায় পরিপূর্ণ৷ তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম সম্প্রদায়ের দেশবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব অখণ্ড ভারত গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা৷ … অখণ্ড ভারত সম্পর্কে যাদের সন্দেহ আছে তারা মনে করে মুসলমানরা এই মনোভাব পরিবর্তন করবে না৷ তাই যদি হয়, তবে ভারতে ছয় কোটি মুসলমানের অবস্থান ভারতের স্বার্থের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হবে’ (সুধাকর রাজে সম্পাদিত পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রন্থ থেকে)৷ তাদের পথ অনুসরণ করে প্রথমবার সরকারে বসেই বিজেপি নেতারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা বদলে দিলেন৷ বললেন, ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে সম্প্রদায় নিরপেক্ষতা৷ এইভাবে শুধু মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু নয়, উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বিরোধী মানসিকতাও জনমনে ছড়িয়ে দিতে শুরু করল বিজেপি–আরএসএস৷ এই বিজেপিকে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বিশ্বাস করবে কী করে? দেশবিভাগও যে মানুষদের আলাদা করতে পারেনি, তাদের বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার অশুভ চেষ্টা স্বাধীনতার সময় থেকে বারেবারেই করে চলেছে বিজেপি–আরএসএস৷ বিজেপির ইতিহাস ধ্বংসের ইতিহাস, বিভেদের ইতিহাস, বিভাজনের ইতিহাস৷ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখনও বিভেদের রাজনীতিই করে গেছে আরএসএস৷ এখন ভাল সাজার চেষ্টায় বিজেপি ‘সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস’ বলতে পারে, কিন্তু তাতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত হলে চলবে কি? ‘একটা মিথ্যা বারবার বললে তাকে সত্য বলে মনে করতে পারে মানুষ’– গোয়েবলসীয় এই তত্ত্বের উত্তরসূরিরা এই আশাতেই বিশ্বাসের বার্তা দিয়ে চলেছেন৷ ফ্যাসিস্ট জার্মানির রাষ্ট্রনায়ক হিটলারের প্রচারসচিব গোয়েবলসের সাথে ফ্যাসিস্ট বিজেপির স্বাভাবিক মিল এখানেই৷ ইহুদি নিধনের সময় যেমন জার্মান জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে হয়েছিল হিটলারকে, তেমনই এ দেশে সংখ্যালঘুদের হত্যা করতে গিয়ে, সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের কথায় কথায় পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি–আরএসএসকে৷ এভাবেই চলছে গায়ের জোরে, অস্ত্রের জোরে ‘বিশ্বাস’ অর্জন করার খেলা আর বাইরে ভালমানুষের ভেক ধরতে সব কা বিশ্বাসের স্লোগান তুলছেন তাঁরা৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)