প্রথম দফায় বেকারি ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় দফায় কোথায় পৌঁছবে, মোদিজি?

ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি তাল ঠুকে ঠুকে বলে বেড়িয়েছেন, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি হয়েছেই, শুধু মানুষ তা দেখতে পাচ্ছেন না৷ ভোট বৈতরণী পার করতে বিজেপি সরকার এনএসএসও–র সমীক্ষা রিপোর্টটাই চেপে রেখেছিল৷

কিন্তু এবারে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে৷ আর তা বেরিয়ে এসেছে খোদ বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের সরকারি তথ্য থেকেই৷ নির্বাচনের কিছুদিন আগেই জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের একটি রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়৷ তাতে দেখা যায়, নোটবন্দির পরে দেশের বেকারত্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ পরিসংখ্যানবিদদের অভিমত, গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে এই বেকারত্বের হার সর্বাধিক৷ ফলে গত সরকারের আমলে বছরে দু’কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি দিয়েছিলেন, তা যে কত বড় মিথ্যা সে কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ এই রিপোর্টই প্রথম দফায় বিজেপি সরকার ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছিল৷ প্রতিবাদে দু’জন পরিসংখ্যানবিদ জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল৷

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা মোদির নেতৃত্বে শপথ নেওয়ার পরপরই সরকার বাধ্য হয়ে ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিসের (এনএসএসও)–র সেই সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে৷ কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের দ্বারা প্রকাশিত এই ‘পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস, জুলাই ২০১৭– জুন ২০১৮) নামক এই সমীক্ষা বাস্তবে ভোটের আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়া রিপোর্টকেই সঠিক বলে প্রমাণ করেছে৷ ঢাক পিটিয়ে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশে আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে৷ তথ্য বলছে, ঘটেছে ঠিক উল্টোটাই৷ নোট বাতিলের পরই দেশের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি ৬.১ শতাংশ৷ শহরে কর্মক্ষম বেকার ৭.৮ শতাংশ, গ্রামের ৫.৩ শতাংশ, যা গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ শুধু তাই নয়, তথ্য থেকে আরও দেখা যাচ্ছে বেকারত্ব পরবর্তী সময়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ২০১৮–র অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে বেকারের হার ৯.৭ শতাংশ হয়েছে৷ যাঁরা কাজ খুঁজছেন তাঁদের মধ্যে কাজ পেয়েছেন মাত্র ৪৬.৮ শতাংশ৷ ৫৩.২ শতাংশ–র কোনও কাজ নেই৷ অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষের অর্ধেকের অনেক বেশি মানুষ কর্মহীন৷

মনে রাখা দরকার, বেকারত্ব সম্পর্কিত এই তথ্যগুলো বাস্তবে দেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যার এক ক্ষুদ্র অংশকেই প্রতিফলিত করছে৷ অর্থাৎ কর্মক্ষমতা থাকলেও যাদের সামনে উপার্জনের কোনও রাস্তাই খোলা নেই৷ এর বাইরেও আছে এ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত হয়ে থাকা কোটি কোটি শ্রমজীবী জনতা যাদের কাজ অনিশ্চিত এবং উপার্জন যৎসামান্য৷ কাজও অত্যন্ত অনিয়মিত৷ গ্রামীণ ক্ষেত্রে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক খেতমজুর, প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র চাষিরাও৷ তারাও আজ একদিকে কৃষক বিরোধী সরকারি নীতির ফলে ক্রমবর্ধমান চাষের খরচ যোগাতে না পেরে এবং ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ঋণভারে জর্জরিত৷ লাখ লাখ কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন৷ দেশের প্রান্তে প্রান্তে বারবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃষকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন৷ এই বিপুল সংখ্যক ‘প্রচ্ছন্ন বেকার’ সরকারি হিসেবের বাইরে থেকে যাচ্ছেন৷

এই বিরাট সংখ্যক বেকার–র্ধবেকারদে ক্রয়ক্ষমতা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ তীব্র বাজারসংকট৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নোট বাতিল এবং জিএসটি–র মতো সর্বনাশা নীতি৷ যার ফলে বাজারে নগদ যোগান ভয়াবহভাবে কমেছে এবং করব্যবস্থাও জটিল হয়েছে৷ যে অসংখ্য ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নগদে লেনদেন করতেন এবং যাদের সাথে গরিব মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক, তারাও বাজারে নগদের যোগান হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপর্যস্ত৷ এই তীব্র সংকটের ফলে কারখানাগুলির উৎপাদন কমতে বাধ্য৷ তথ্যে প্রকাশ, গত এপ্রিলে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার কমতে কমতে ২.৬ শতাংশে নেমে এসেছে৷ প্রাকৃতিক গ্যাস, অশোধিত তেল, সারের মতো আবশ্যকীয় পণ্যগুলিরও উৎপাদন কমেছে৷

অপরদিকে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারও শোচনীয়ভাবে কমছে৷ গত পাঁচ বছরের মধ্যে গত আর্থিক বছরের শেষ তিন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ কমে হয়েছে ৫.৮ শতাংশ৷ অর্থ দপ্তরের সচিব জানিয়েছেন, বর্তমান আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাস এই হার আরও কমবে৷

এই সংকট কাটানোর জন্য কেন্দ্রের নীতি আয়োগ যে দাওয়াই বাতলেছে তাতে বলা হয়েছে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রথম একশো দিনের মধ্যেই সরকার ব্যাপক সংস্কারে হাত দেবে৷ প্রচলিত শ্রম আইনে এখনও যতটুকু শ্রমিক স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে, তা পুঁজিপতিদের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরেই পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারগুলি৷ অতীতে কংগ্রেস সরকার, পূর্বতন বিজেপি সরকার সকলেই এই ষড়যন্ত্র করে গেছে৷ এবারে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে সরকারে আসার ফলে বর্তমান মোদি সরকার সহজেই এই পরিবর্তন করবে৷ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাতেও ক্ষুদ্র গ্রাহকদের স্বার্থে যতটুকু রক্ষাকবচ ছিল, তা তুলে দিয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সংস্কার করবে৷ কর্পোরেট পুঁজিকে প্রায় বিনাপয়সায় জমি দেওয়ার জন্য গরিব মানুষের জমি কেড়ে তৈরি করবে জমি ব্যাঙ্ক৷ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অতি দ্রুত বেসরকারিকরণ করা হবে৷ এক কথায়, পুঁজিপতিদের টাকায় ক্ষমতায় এসে এবার মোদিজির তাদের কাছে ঋণ শোধ করার পালা৷ সাধারণ মানুষের উপর পুঁজিপতিদের শোষণের স্টিমরোলার চালানোর রাস্তাকে মসৃণ করার লক্ষ্যে এবার শুরু হচ্ছে মোদি–মিত শাহর নেতৃত্বে বিজেপি–র তথাকথিত ‘দ্বিতীয় দফা’৷

আগামী দিনে এ দেশের সাধারণ শোষিত মানুষের উপর শোষণ নির্যাতন আরও তীব্র রূপ নেবে৷ জাতীয় নীতি আয়োগের এই একগুচ্ছ পরিকল্পনা বেকারত্ব নিরসনে পথ তো দেখাতে পারবেই না বরং বেকারত্ব, অনাহার আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে৷ 

এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেই সরকারে থাকুক না কেন, ভয়াবহ বেকারত্বের সমাধান বাস্তবে সম্ভব নয়৷ যত দিন যাচ্ছে, শোষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, মানুষের  ক্রয়ক্ষমতা কমছে, বাজার সংকট বাড়ছে৷ এখনই উৎপাদিকা শক্তি যা উৎপাদন করে তা বাজারে বিক্রি না হয়ে বিশাল পরিমাণ পণ্য গুদামজাত হয়ে পড়ে আছে৷ একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন কর্মহীন হয়ে পড়ছে৷ যা আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করছে৷ এখানে মানুষের কত প্রয়োজন সেদিকে লক্ষ্য রেখে উৎপাদন হয় না৷ উৎপাদন হয় পুঁজিপতিরা কতটা উৎপাদন বিক্রি করলে তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা হবে সেদিকে লক্ষ্য রেখে৷ এই ব্যবস্থাকে বজায় রেখে আজ একটা কারখানা স্থাপিত হলে তার জায়গায় অসংখ্য কারখানার গেটে তালা পড়বে৷ যতদিন যাবে কাজ পাওয়ার পরিবর্তে মানুষ কর্মহীন হবে৷ তাই বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির ভাঁওতা দিয়ে গতবারে ক্ষমতায় এলেও মোদিকে বেকারত্ব নিরসনে পকোড়া ভাজার উপদেশ দিতে হয়েছে৷ আজ যদি সত্যি বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে হয় তবে এই শোষণব্যবস্থাকে ভেঙে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই৷ যেখানে উৎপাদন হবে মুনাফার লক্ষ্যে নয়, মানুষের প্রয়োজনকে ভিত্তি করে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)