Breaking News

পাশ–ফেল ফেরানোর কথা বললেই স্কুলছুটের ধুয়া ওঠে কেন?

পাশ–ফেল চালুর দাবি জোরালো হলেই শাসক শিবির আওয়াজ তোলে, স্কুলছুট ছাত্রের সংখ্যা বাড়বে৷ সত্যিই কি তাই?

স্কুলছুটের জন্য দায়ী প্রাথমিকে ইংরেজি এবং পাশ–ফেল– এমন অদ্ভুত তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেয় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পূর্বতন সিপিএম সরকার৷ কীসের ভিত্তিতে সিপিএম এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিল? তারা কি কোনও সমীক্ষা করেছিল? স্কুল ধরে ধরে শিক্ষকদের মতামত নিয়েছিল? প্রকাশ্য বিতর্কের অবতারণা করেছিল? বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক–ধ্যাপক–শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিকদের অভিমত নিয়েছিল? না, কিছুই করেনি৷ একতরফা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা পাশ–ফেল তুলে দিয়েছিল৷ আর তার পক্ষে গলাবাজি করে গিয়েছিলেন সরকারি প্রসাদভোগী মুষ্টিমেয় কিছু ঘোলাটে বুদ্ধিজীবী৷ এমনকী চাটুকারবৃত্তি করতে গিয়ে তাঁরা সরকারি নীতির বিরোধিতায় রাস্তায় নামার অপরাধে সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিকদের প্রকাশ্যে গালাগালি দিতেও পিছপা হননি৷ রাজনৈতিক দল হিসাবে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) সেদিন সরকারি নীতির প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল৷ যার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষ৷ কিন্তু তার থেকে কোনও শিক্ষাই সিপিএম সরকার নেয়নি৷ এমনকী ১৯৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ও পাশ–ফেল চালুর ইস্যুতে সর্বাত্মক বাংলা বনধ হলেও সিপিএম সরকার জনমতকে উপেক্ষা করেছে৷ পরে ইংরেজি চালু করতে বাধ্য হলেও পাশ–ফেল চালু করেনি৷

বিরোধী দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস সেদিন ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার বিরোধিতা না করলেও, জনমত লক্ষ করে সরকারে এলে পাশ–ফেল ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তৃণমূল প্রতিশ্রুতির পুরো উল্টো দিকে গিয়ে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের আনা ‘শিক্ষার অধিকার আইন–২০০৯’ মেনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দেয়৷ বিজেপি শাসিত রাজ্য সহ অন্যান্য রাজ্যগুলিও তুলে দেয়৷ এস ইউ সি আই (সি)–র পক্ষ থেকে যতবারই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে পাশ–ফেল চালুর দাবি নিয়ে সাক্ষাৎ করা হয়েছে, তিনি বলেছেন, পাশ–ফেল তাঁরাও চান৷ উল্লেখ করেছেন, এ ক্ষেত্রে বাধা শুধু কেন্দ্রীয় আইনের৷ ইতিমধ্যে একদিকে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি, অন্যদিকে শিক্ষার মানের মারাত্মক অবনমন, নানা সমীক্ষা রিপোর্ট, বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ ইত্যাদির ফলে কেন্দ্রীয় সরকারও পাশ–ফেল চালুর কথা বলতে বাধ্য হয়৷ কেন্দ্রীয় সরকারই বলে ২৫টি রাজ্য পাশ–ফেল চালুর পক্ষে৷ অনেক টালবাহানার পর অবশেষে লোকসভা এবং রাজ্যসভাতেও শিক্ষার অধিকার আইনের সংশ্লিষ্ট সংশোধনী পাশ হয়েছে৷ ঘোষিত হয়েছে, রাজ্য চাইলে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল ফেরাতে পারে৷ আন্দোলন যখন এইভাবে কয়েক ধাপ সাফল্য অর্জন করেছে, ঠিক তখনই সংবাদ মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলেন, স্কুলছুটের প্রশ্নটি নাকি তাঁকে ভীষণ ভাবাচ্ছে৷ কিন্তু পাশ–ফেল তুলে দিয়ে কি স্কুলছুটের রাস্তা বন্ধ হয়েছে? না কি তার জমিই উর্বর হয়েছে?

শিক্ষামন্ত্রী কি এমন কোনও সমীক্ষার কথা বলতে পারবেন, যেখানে বলা হয়েছে পাশ–ফেল না থাকায় স্কুল–ছুট কমেছে? বরং ঠিক এর বিপরীত কথাটাই সত্য৷ দেখা যাচ্ছে ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ২৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৫৯ জন৷ তাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ২০১৮ তে৷ সে বছর মাধ্যমিক দিয়েছে ১১ লক্ষ ২ হাজার ৯২১ জন (কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত)৷ এই বছরগুলিতে তো পাশ–ফেল ছিল না৷ বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কহীন কিছু ঘোলাটে বুদ্ধিজীবী যেমন চাইছেন সেই ‘আনন্দঘন, চাপমুক্ত পরিবেশ’ই তো একেবারে সশরীরে বিরাজ করেছে তাহলে প্রায় ১৩ লক্ষ ছাত্র–ছাত্রী মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছাল না কেন? কোথায় গেল তারা? তাদের পাওয়া যাবে হোটেলের বাসন ধোওয়ার জায়গায়, ইটভাটায়, বাজি কারখানায়৷ মিড–ডে মিলে হয়ত কিছুদিন এক বেলা পেট ভরেছে৷ কিন্তু তাদের ঘরের হাঁ করে গিলতে আসা অভাবের রাহু যে আরও শক্তিশালী তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট৷ এই পরিস্থিতি পাল্টাতে সরকার কী করেছে?

অন্যদিকে শিক্ষার মানের হাল কেমন দাঁড়িয়েছে? সিপিএম সরকারের আমলের অশোক মিত্র কমিশন থেকে শুরু করে সম্প্রতি প্রতীচী ট্রাস্টের সমীক্ষা এমনকী সরকারি সমীক্ষা পর্যন্ত দেখিয়েছে পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার পর থেকে শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনমন ঘটেছে৷ পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র–ছাত্রীরা দ্বিতীয় শ্রেণির পড়াও বুঝছে না৷ তার উপর পড়ানোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত শিক্ষক৷ তা কি সরকার দিয়েছে? সারা দেশেই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকপদ শূন্য৷ সম্প্রতি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এক তথ্য থেকে জানা যায়, প্রাথমিকে (এলিমেন্টারি স্কুল) শিক্ষকের শূন্যপদের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ৮৭,৭৮১, ছত্তিশগড়ে ৪৮,৫০৬, বিহারে ২,০৩,৯৩৪, উত্তরপ্রদেশে ২,২৪,৩২৯৷ তথ্য আরও বলছে উচ্চ–প্রাথমিকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ভীষণ অভাব৷ মহারাষ্ট্রে ৭৭ শতাংশ স্কুলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই৷ এই সংখ্যা উত্তরপ্রদেশে ৪৬ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ৪০ শতাংশ, বিহারে ৩৭ শতাংশ৷ বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকার অর্থ হল, হয় অঙ্কের শিক্ষক নিচ্ছেন ইংরেজি ক্লাস, বা বাংলার শিক্ষক নিচ্ছেন বিজ্ঞানের ক্লাস অথবা ক্লাস হচ্ছেই না৷ সারা দেশে এক লক্ষেরও বেশি স্কুল চলছে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে৷ শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে মাধ্যমিক স্তরেও৷ শুধু তাই নয়, কেরানির কাজে, মিড–ডে মিলের কাজে, ভোটার লিস্ট তৈরির কাজে, সরকারি নানা কর্মসূচিতে শিক্ষকদের ব্যস্ত রাখা হচ্ছে৷ পড়াবে কে? ফলে দরিদ্র ঘরের সন্তানরা দিনের পর দিন কিছুই না বুঝে ক্লাসে বসে থাকতে থাকতে শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছে৷ বেড়েছে স্কুলছুট৷ এই সব দূর না করে পাশ–ফেলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে রেহাই মিলবে?

 যারা দারিদ্রের কারণে বেসরকারি স্কুল বা প্রাইভেট টিউশনের সুযোগ– কোনওটাই নিতে পারছেন না, স্বাভাবিকভাবেই ড্রপআউটের অভিঘাত এইসব পরিবারেই বেশি৷ ফলে একটু সঙ্গতি থাকলেই অভিভাবকরা সরকারি স্কুলকে টা–টা করে সন্তানদের নিয়ে বেসরকারি স্কুলমুখো হচ্ছেন৷ কলকাতা সহ শহরাঞ্চলে সরকারি বহু স্কুল উঠেই যেতে বসেছে৷ বাড়ছে প্রাইভেট টিউশন নির্ভরতা৷ স্কুল শিক্ষাকে পঙ্গু করার সরকারের এই পদক্ষেপের পরিণামে স্কুল স্তর থেকেই শিক্ষার বেসরকারিকরণ–ব্যবসায়ীকরণের রমরমা বেড়েছে৷

রাজ্য সরকার শিক্ষার অধিকার আইনের অজুহাত দিয়ে পাশ–ফেল চালু নিয়ে টালবাহানা করছে৷ অথচ সেই আইনেরই ৩০ জন ছাত্র প্রতি এক জন শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম আজও কেন্দ্র–রাজ্য কোনও সরকারই কার্যকরী করল না৷ এক্ষেত্রে আইন না মানার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তাদের শাস্তিও হল না৷ তাহলে  পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য যে শিক্ষার বেসরকারিকরণের রাজপথ খুলে দেওয়া তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি? শিক্ষাকে নিশ্চিত ধ্বংসের  হাত থেকে  রক্ষা করতে প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চালু করার দাবিতে এস ইউ সি আই (সি) বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছে৷ ৩০ জানুয়ারি কলকাতায় মহামিছিল৷ শুরু হবে হেদুয়া পার্ক থেকে, বেলা ১টায়৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২২ সংখ্যা)