পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার কী হাল হয়েছে, পর্দা ফাঁস করল সরকারি রিপোর্টই


পাশ–ফেল তুলে দিয়ে সরকার চালু করেছিল কনটিনিউয়াস কমপ্রিহেনসিভ ইভ্যালুয়েশন (সিসিই), যার অর্থ নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন৷ কী তার হাল? দেখিয়ে দিয়েছে অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন এডুকেশন–২০১৮৷ স্কুল শিক্ষার উপর করা সমীক্ষা রিপোর্ট, যা ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে৷ রিপোর্টটি তৈরি করতে সমীক্ষকরা গ্রামীণ ভারতের ৫৯৬টি জেলার ১৭,৩৩০টি গ্রামের ৩,৫৪,৯৪৪ জন মানুষের মতামত নিয়েছে এবং ৫, ৪৬, ৫২৭ জন ৩–১৬ বছর বয়সের শিশুর সাথে সাক্ষাৎ করে প্রাথমিক শিক্ষায় তাদের অগ্রগতি জানতে চেয়েছে৷ কোন জেলা ও কোন গ্রামে তারা সমীক্ষা করবে তা পুর্বনির্দিষ্ট না করে ইচ্ছে মতো বেছে নিয়েছে৷

রিপোর্টে যা যা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে এবং তার যতটুকু সংবাদমাধ্যমে এসেছে তাতে এ দেশের শিক্ষাপ্রেমী মানুষের চক্ষু চড়কগাছ৷ দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে যে পড়ুয়ারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির মাতৃভাষার কিছু গদ্যপাঠ, দুই অঙ্কের বিয়োগ এবং তিন অঙ্কের একটি সংখ্যাকে এক অঙ্কের একটি সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে বলা হয়েছিল৷ অঙ্কের ওই প্রশ্ণগুলি ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির মানের৷ এ ছাড়া মাতৃভাষার কিছু অক্ষর ও শব্দ এবং এক ও দুই অঙ্কের  কিছু রাশি চিনতে পারে কি না তা দেখার চেষ্টা হয়েছিল–যা প্রথম শ্রেণির পাঠের মধ্যে পড়ে৷ রিপোর্ট বলছে, তৃতীয় শ্রেণির ৭৩ শতাংশ পড়ুয়া ওই গদ্য পড়তে পারেনি এবং ৭২ শতাংশ পড়ুয়া ওই সহজ অঙ্ক করতে পারেনি৷

২০০৯–এ ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ সংসদে পাশ হওয়ার পর ২০১০ সাল থেকে তা ধীরে ধীরে গোটা দেশে চালু হয়েছিল এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেলের অবলুপ্তি ঘটেছিল৷ এই আইন চালু হওয়ার ঠিক আগে পরিস্থিতি কী ছিল? ‘অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন এডুকেশন’ ২০০৮এর সমীক্ষা বলছে, তখন অন্তত ৩৯ শতাংশ পড়ুয়া অঙ্ক করতে পারত৷ ২০১০ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৬ শতাংশ, ২০১২–তে ২৬ শতাংশ, ২০১৪–তে ২৫ শতাংশ, ২০১৬–তে ২৬ শতাংশ, ২০১৮–তে ২৮ শতাংশ৷ অর্থাৎ ওই আইন চালু হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীদের অঙ্ক শেখার মান নিম্নমুখী৷

তৃতীয় শ্রেণির যে ছাত্রছাত্রীরা অন্তত সেই শ্রেণির সহজ বিয়োগ অঙ্ক কষতে পারে তার সর্বভারতীয় গড় মাত্র ২০.৯ শতাংশ৷ বেশিরভাগ রাজ্যেই এই মান নিম্নমুখী৷ মাতৃভাষার সহজ গদ্য পড়ার ক্ষেত্রে  সমীক্ষা রিপোর্টে যা পাওয়া যাচ্ছে তা সত্যই ভয়ঙ্কর৷ যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের তৃতীয় শ্রেণির  ছাত্রছাত্রীরা গদ্য দূরের কথা  দুই অক্ষরের সহজ শব্দও পড়তে পারে না৷

পঞ্চম শ্রেণির  ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাও ভয়াবহ৷ দ্বিতীয় শ্রেণির মানের মাতৃভাষার গদ্য পড়তে পারার সংখ্যা যেখানে ২০০৮–এ ছিল ৫৬ শতাংশ, তা ২০১০– তে হয় ৫৩.৭ শতাংশ, ২০১২–তে হয় ৪৬.৮ শতাংশ, ২০১৩–তে ৪৮ শতাংশ, ২০১৬–তে ৪৭.৯ শতাংশ, ২০১৮–তে হয় ৫০.৩ শতাংশ৷ অর্থাৎ অর্ধেক বা তার বেশি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী দ্বিতীয় শ্রেণির  গদ্য পড়তে পারছে না৷ সহজ অঙ্ক কষতে পারার ক্ষেত্রে  ২০০৮ সালে যেখানে ছিল ৩৭ শতাংশ তা এখন নেমে দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশ–এর মতো৷ অর্থাৎ ৭০ শতাংশের বেশিই অঙ্ক  করতে পারে না৷

ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের উপর সমীক্ষা রিপোর্ট অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক৷ তীব্র সমালোচনা করে রিপোর্ট বলছে, উচ্চ প্রাথমিকের এই স্তরগুলিতে শিক্ষার কোনও উন্নতিই হয়নি৷ বলা হয়েছে, সহজ ভাগ অঙ্ক  করতে পারে ষষ্ঠ শ্রেণির ক্ষেত্রে মাত্র ৩৪.৭ শতাংশ, সপ্তম শ্রেণিতে ৩৯ শতাংশ এবং অষ্টম শ্রেণিতে ৪৩.৯ শতাংশ৷ বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মান এত নিম্নমুখী যে তারা সহজ ভাগ অঙ্ক করতে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং বছরের পর বছর এই অবস্থার কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না৷ সামান্য অঙ্ক করার বুনিয়াদি ক্ষমতা এই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি–যা উচ্চ প্রাথমিকের এই শ্রেণিগুলিতে প্রত্যাশিত৷ ২০০৮ সালে যেখানে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী ৮৪.৮ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির গদ্য পড়তে পারত, ২০১০ সালে তা দাঁড়ায় ৮৩.৫ শতাংশ, ২০১২ সালে ৭৬. ৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৭৪.৬ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৭৩ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৭২ . ৮ শতাংশ৷ তথাকথিত শিক্ষার অধিকার আইনের এই হল পরিণতি৷ রিপোর্ট তার উপসংহারে সঠিকভাবেই বলেছে অষ্টম শ্রেণির পাঠ সমাপ্ত করে যে ছাত্রছাত্রীরা  বেরোচ্ছে , তারা না পারবে উচ্চশিক্ষায় যেতে, না পারবে শ্রমের বাজারে নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে৷

৩–১৬ বছর বয়সী শিশুদের শিক্ষার মানের কঙ্কালসার যে চিত্রটি  উঠে এল  তা একটি নিরপেক্ষ সমীক্ষার রিপোর্টে পাওয়া গেছে৷ ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেলের অবলুপ্তির ফলেই যে এটা ঘটেছে তা আজ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না৷ বছর ধরে ধরে রিপোর্ট দেখিয়েছে, যতটুকু মান আগে ছিল ওই আইন চালু হওয়ার পর থেকে তার ক্রম–বনমন ঘটেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার সমস্ত কিছু  জেনেও এখনও প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি৷ পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল চালু করার সিদ্ধান্ত যে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে তা এস ইউ সি আই (সি)–র নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলনের জয়৷ যদিও দরকার প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু করা৷