নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (৯)

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বি–শত জন্মবার্ষিকী আগতপ্রায়৷ সেই উপলক্ষ্যে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য৷

(৯)

নারীশিক্ষা ও বিদ্যাসাগর

বিধবাবিবাহ প্রবর্তন, বাল্যবিবাহ–বহুবিবাহ বন্ধ করার কঠিন আন্দোলনের পাশাপাশি নারীশিক্ষার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং সেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তিনি বিরল ও ঐতিহাসিক লড়াই করেছিলেন৷

উনিশ শতকের শুরুতেই এদেশের রামমোহন–সহ আরও কয়েকজন নারীশিক্ষার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন৷ কলকাতায় প্রথম মহিলা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮১৯ সালে ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ নামক এক খ্রিস্টান সমিতির উদ্যোগে৷ সেগুলি ছিল ইংরেজি–মাধ্যম স্কুল৷ মেয়েদের মধ্যে বাংলা শিক্ষা প্রসারের জন্য ১৮২২ সালে তাঁরা একটি বই প্রকাশ করেন, ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’৷ যদিও এসবের তেমন কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি৷ ১৮২৪ সালে গঠিত ‘লেডিজ সোসাইটি’র উদ্যোগে আরও কয়েকটি মহিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়৷ ১৮২৫ সালে গঠিত ‘লেডিজ অ্যাসোসিয়েশন’ নামে আর একটি সংস্থা কলকাতার মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং কিছু মুসলিম পুরুষ এমনকি দু–এক জন মুসলিম মহিলাও এই কাজে তাঁদের ব্যাপক ভাবে সাহায্য করেন৷ কিন্তু সামগ্রিক অর্থে হিন্দু–মুসলিম কোনও অংশেরই সাধারণ নারীসমাজে এই উদ্যোগগুলির প্রভাব পড়েনি৷ এমনিতেই মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার ব্যাপারে ভারতীয় সমাজ ছিল মারাত্মক রক্ষণশীল৷ তার উপর, এই স্কুলগুলি সম্পর্কে জনমনে ধারণা ছিল, এদের আসল উদ্দেশ্য হল খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং এই ধারণার কিছু বাস্তব ভিত্তিও ছিল৷

সে–সময় বাংলার বিভিন্ন জেলায় ধনী এবং কিছুটা উদারমনা ব্যক্তিরাও মহিলা বিদ্যালয় করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন৷ কিন্তু নানা বাধায় কোনও উদ্যোগই ফলপ্রসু হচ্ছিল না৷ ইতিহাসের এই পর্বে উনিশ শতকের মধ্যভাগে এলেন বিদ্যাসাগর৷ বিদ্যাসাগর রাজা তো ননই, ধনীও নন৷ কেবল তাঁর দেশের কোটি কোটি জনসাধারণের, বিশেষত নারীদের দুরবস্থায় বেদনাহত এক মানুষ৷ ধর্ম–বর্ণ কুসংস্কারের ঘোর অন্ধকারে ন্যুব্জকুব্জ দেশবাসীর ব্যথা তাঁকে কাঁদিয়েছে৷ অশিক্ষার সেই নিকষ তমসাকে ছিন্ন করে দেশবাসীকে আলো দেখাতে বিদ্যাসাগর সমাজসংস্কারে হাত দিলেন এবং নারী–পুরুষ সহ সমাজের সকলের জন্য শিক্ষার লড়াই শুরু করলেন৷

এই সময়ই বেথুন সাহেবের উদ্যোগে ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’ (পরবর্তীকালে ‘বেথুন স্কুল’) প্রতিষ্ঠা হল৷ কিন্তু শুধু স্কুল হলে কী হবে, মেয়েরা কি পড়তে আসবে? বাড়ি থেকে তাদের ছাড়বে? স্কুল চালনার ব্যাপারে বেথুনসাহেব বিদ্যাসাগরের সাহায্য চাইলেন৷ তৎকালীন সমাজের প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে এবং অতীতের স্কুলগুলির করুণ ইতিহাস জেনেও বিদ্যাসাগর সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন৷ তখন তাঁর একটাই লক্ষ্য, নারীসমাজ তথা দেশের মানুষকে আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রাচীন গোঁড়ামির অন্ধকার থেকে মুক্ত করে সভ্যতার আলোয় আনতেই হবে৷

বিদ্যাসাগর নিজে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করলেন৷ তাদের বাবা–মা এবং পরিবারের অন্যান্যদের ধৈর্য ধরে বোঝাতে শুরু করলেন৷ কারও বাড়িতে অপমানিত হলেন, কোথাও প্রত্যাখ্যাত হলেন, কোথাও বা একটু ক্ষীণ আশ্বাস পেলেন৷ যেখানে যতটুকু যা পেলেন তাকেই আঁকড়ে ধরলেন তিনি৷ বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা অনুমোদন করালেন৷ শুরু হল স্কুল৷ স্বঘোষিত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা তেড়েফুঁড়ে উঠলেন৷ বললেন, ‘শাস্ত্রে মেয়েদের লেখাপড়া শেখায় নিষেধ আছে৷ বই পড়লে মেয়েরা বিধবা হবে৷ সমাজ উচ্ছন্নে যাবে৷’ তাঁরা বলতে শুরু করলেন, ‘মেয়েদের কখনই ঘরের বাইরে বেরতে দেওয়া যায় না৷ তাদের স্বাধীনতা নেওয়া মানে সমাজের সর্বনাশ করা৷ মেয়েদের অবশ্যই শৈশবে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন রাখতে হবে৷’ এইভাবে গোঁড়া পণ্ডিতদের দাপটে নারীশিক্ষার আয়োজন ফের একবার অতীতের কলঙ্কিত অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে বসল৷

তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের আক্রমণের সামনে রুখে দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগর৷ বললেন, ‘শাস্ত্র কিছু আমিও পড়েছি৷ মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার কথা কোন শাস্ত্রে লেখা আছে দেখান৷’ পণ্ডিতের দল থমকে গেল, কিছুই দেখাতে পারল না৷ কিন্তু থমকেও তাঁরা থেমে গেল না৷ সমাজে তাঁদের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি ছিল সাংঘাতিক৷ তাঁরা সর্বত্র নারীশিক্ষাকে শাস্ত্রবিরোধী বলে প্রচার করতে লাগলেন৷ বিদ্যাসাগর সারাদিন স্কুল–কলেজ সামলে রাত জেগে পড়তে লাগলেন যাবতীয় শাস্ত্রীয় পুঁথিপত্র৷ যেভাবেই হোক অপপ্রচারকারীদের মুখ বন্ধ করতে হবে৷ ওদের অস্ত্রেই ওদের ঘায়েল করতে না পারলে যে চলবে না, এ–তিনি বেশ বুঝতে পারলেন৷ অবশেষে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর সমর্থনে শাস্ত্র থেকে একটি শ্লোক উদ্ধার করলেন, ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ’ এবং স্কুলের গাড়ির গায়ে বড় বড় হরফে সেই শাস্ত্রবচন লিখিয়ে দিলেন৷ শুধু প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতের দলই নয়, বেথুন স্কুল শুরু হওয়ার পর নারীশিক্ষার তীব্র বিরোধিতা করতে আরম্ভ করেছিলেন ইংরেজি শিক্ষার ডিগ্রিধারী দেশীয় একদল ব্যক্তিও৷ তাঁদেরও সমাজে, বিশেষত শিক্ষিতমহলে যথেষ্ট প্রতাপ ছিল৷ এই ধরনের বিরোধীদের সঙ্গেও মতামতের তীব্র লড়াই হয়েছে বিদ্যাসাগরের৷

১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগরের অভূতপূর্ব এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বিধবাবিবাহ আইনসম্মত হল৷ ১৮৫৭ সালের শুরু থেকেই গ্রামে গ্রামে বালিকা–বিদ্যালয় তৈরির কাজে হাত দিলেন তিনি৷ মে মাসে বর্ধমানের জৌগ্রামে তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন৷ ইতিমধ্যে ছেলেদের জন্য তিনি বেশ কিছু মডেল স্কুল করেছেন৷ সেভাবেই মেয়েদের জন্যও মডেল স্কুল নির্মাণেরও উদ্যোগ নিলেন৷ ছ–সাত মাসের মধ্যে হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া, মেদিনীপুরে মোট ৩৫টি বালিকাবিদ্যালয় তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এবং আরও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন করেন৷ কিন্তু এই সময়েই সংঘটিত হয় সিপাহি বিদ্রোহ৷ এই ঘটনায় হিন্দু–মুসলিম সিপাহিদের ঐক্য দেখে ইংরেজ শাসকরা ভীত হয়ে পড়ে এবং তাদের শাসননীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায় ভারতশাসন৷ শিক্ষা প্রসারের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ জেলায় জেলায় স্কুল করার জন্য আর্থিক সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল তা থেকে তারা সরে দাঁড়ায়৷

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর পড়ে গেলেন মহা বিপদে৷ তিনি সরকারকে চিঠি দিয়ে এই জটিল সমস্যার কথা বিশদে জানালেন৷ কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা নির্বিকার থাকল৷ এই সময়েই ব্রিটিশ শিক্ষাবিভাগের নিয়ামকদের সাথে নীতিগত বিরোধের কারণে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ সহ সমস্ত সরকারি পদ থেকে ইস্তফা দিলেন৷ তাঁর মাইনেপত্র সব বন্ধ হয়ে গেল৷ তার ওপর এতগুলি স্কুল সরকারের সাহায্য ছাড়া কোনও ভাবেই চলতে পারে না৷ অন্য যে–কেউ হলে সম্ভবত এই কারণটা দেখিয়ে স্কুলগুলি বন্ধ করে দিতেন৷ কিন্তু দেশের জনসাধারণকে জ্ঞানে–চেতনায় সোজা করে দাঁড় করাবার জন্য যে স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটির অকল্পনীয় সংগ্রামের কথা আমরা একটু–আধটু জানছি, তাঁর নাম বিদ্যাসাগর৷ স্বদেশের হিতসাধনে যে কোনও দুর্লঙঘ্য বাধা অতিক্রম করতে যিনি নিজের সর্বস্ব নিয়ে সদা প্রস্তুত৷ সরকারি সাহায্য বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি গড়ে তুললেন ‘নারীশিক্ষা–প্রতিষ্ঠান ভাণ্ডার’৷ সর্বাগ্রে নিজের সর্বস্ব দিলেন৷ তারপর আগ্রহী প্রত্যেকের কাছে গিয়ে বোঝালেন এই বিশেষ প্রয়োজনের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য৷ সাধারণের শিক্ষার জন্য এমন ঐতিহাসিক গণউদ্যোগের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগরই৷

প্রবল প্রতিকূলতার মোকাবিলাতে বিদ্যাসাগরকে নানা ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে৷ পরিস্থিতিকে খুব নিখুঁত ভাবে বিচার করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হয়েছে৷ কোনও কারণে যাতে আরব্ধ কার্যক্রম ব্যাহত না হয়, সেদিকে সর্বদা তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়েছে৷ মূল উদ্দেশ্যকে রক্ষা করার জন্য কখনও এক পা এগিয়েছেন আবার কখনও এক পা পিছিয়েছেন৷ কেউ কেউ সেজন্য তাঁকে ভুল বুঝেছেন, তাঁর উপর অভিমান করেছেন, এমনকি তাঁকে দোষারোপও করেছেন৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর সমস্ত কিছুই অটল পর্বতের মতো সহ্য করেছেন এবং অতলান্ত ধৈর্যের সাথে ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা–চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ গড়ে তোলার কাজ করে গেছেন৷ (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৭ সংখ্যা)